ধর্মনিরপেক্ষতা মামুলি কোনও শব্দবন্ধ নয়। আধুনিক সভ্য সামাজিক ভাবনায় যে রাষ্ট্রকাঠামোর নির্মাণ তার অন্যতম প্রধান উপাদান ধর্মনিরপেক্ষতা। রাষ্ট্রের চরিত্র যদি উদার হয়, মানবিক হয় এবং গণতান্ত্রিক হয় তাহলে সেখানে ধর্মনিরপেক্ষতার সংযোজন অপরিহার্য। ধর্মনিরপেক্ষতাকে বাদ দিয়ে গণতন্ত্রের ধারণাটাই অচল, অসম্পূর্ণ। ভারত একটি ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র। স্বাধীন ভারতের জন্মলগ্ন থেকে আম্বেদকরের নেতৃত্বে সংবিধান প্রণেতারা ভারত রাষ্ট্রের গ্রন্থিতে গ্রন্থিতে গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার সুর বেঁধে দিয়েছিলেন। সেটাই ভারতের জাতীয় সংহতির প্রধান ভিত্তি। নানা ধর্ম, নানা ভাষা ও সংস্কৃতির এই ভারতের অন্তর্গত শক্তির উৎস নিহিত আছে ধর্মনিরপেক্ষতা ও গণতন্ত্রের প্রসারিত ভূমিতে। তাই ধর্মনিরপেক্ষতাকে বাদ দিয়ে গণতন্ত্রের অস্তিত্ব যেমন থাকতে পারে না তেমনি এই দু’টোকে বাদ দিয়ে ভারতের ও ভারতীয়ত্বের বিকাশ অসম্ভব। ধর্মনিরপেক্ষতা যদি পরিত্যক্ত হয় তার সাথে সাথে গণতন্ত্রেরও অন্তর্জলিযাত্রা শুরু হয়ে যাবে। ভারত তখন হয়ে উঠবে বহুমুখী দ্বন্দ্ব-সংঘাতময় অশান্ত এক ব্যর্থ রাষ্ট্র। ফ্যাসিস্ত চরিত্রের অতি দক্ষিণপন্থী হিন্দুত্ববাদী শাসনের কড়া চাবুকেও তাকে বেঁধে রাখা যাবে না। চূড়ান্ত বিশৃঙ্খলার মধ্যে খণ্ড-বিখণ্ড হয়ে যাবে ঐক্যবদ্ধ ভারত।
ধর্মের ভিত্তিতে দেশ ভাগের ফলে মুসলিমদের জন্য পাকিস্তান তৈরি হয়েছিল ঠিকই কিন্তু পরবর্তীকালে মুসলিম পাকিস্তানও ভাষার ভিত্তিতে ভাগ হয়ে বাংলাদেশ তৈরি হয়েছে। ভারত জন্ম থেকেই সব ধর্মের, সব জাতিগোষ্ঠীর, সব ভাষার ও সব সংস্কৃতির মানুষের দেশ। ধর্মনিরপেক্ষতা মানে ভারতে কোনও একটি ধর্মের মানুষের প্রাধান্য নয়। সব ধর্মের মানুষেরই সমান প্রাধান্য। ধর্ম মানুষের ব্যক্তিগত বিশ্বাস ও আচরণের বিষয়। সব মানুষেরই তার বিশ্বাস মতো ধর্মাচরণে অধিকার আছে। সেই অধিকারে রাষ্ট্র বা অন্য কোনও ধর্মবিশ্বাসী হস্তক্ষেপ করতে পারে না। প্রকৃত গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের যেন কোনও ধর্মীয় পরিচিতি থাকতে পারে না। তেমনি সংখ্যাগুরুর দোহাই দিয়ে কোনও ধর্মীয় গোষ্ঠী রাষ্ট্রের উপর ছড়ি ঘোরাতে পারে না। সরকারের পরিচালক মন্ত্রী-আমলা-কর্মীরা ব্যক্তিগতভাবে যে কোনও ধর্মের হতে পারেন কিন্তু কোনোভাবেই সরকারি কাজে, নীতি নির্ধারণ, সরকারি আচরণে ধর্মের বহিঃপ্রকাশ ঘটাতে পারেন না। নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বে আরএসএস-বিজেপি’র সরকার গত দশ বছর ধরে সেই গর্হিত কাজটাই করে চলেছে। রামমন্দির উদ্বোধনে, নতুন সংসদ ভবন উদ্বোধনে এমনকি কাশী বিশ্বনাথ করিডোর উদ্বোধনে প্রধানমন্ত্রী হিন্দু ধর্মযাজকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে ধর্মীয় ঘরানায় যাবতীয় উপাচার পালন করেছেন এবং তাকে রাষ্ট্র প্রযোজিত ইভেন্টে পরিণত করেছে। সচেতনভাবে সংবিধানের ধর্মনিরপেক্ষতাকে কদর্যভাবে লঙ্ঘন করেছেন। নতুন নাগরিকত্ব আইন (সিএএ) ধর্মের ভিত্তিতে নাগরিকত্ব প্রাপ্তির অধিকার স্পষ্টভাবে ধর্মনিরপেক্ষতাকে নস্যাৎ করা।
ধর্মীয় সংখ্যালঘু বিশেষ করে মুসলিমদের ঘৃণা বিদ্বেষ তীব্র গতিতে বাড়ছে সরকার ও শাসক দলের মদতে। সশস্ত্র সাম্প্রদায়িকতাকে উসকানি দিয়ে দাঙ্গার আবহ তৈরি করা হচ্ছে ধর্মীয় বিভাজন ও মেরুকরণের জন্য। দিল্লির দাঙ্গা তারই পরিণতি। দাঙ্গার উসকানিদাতা নেতা-মন্ত্রীদের বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা নেওয়া না হলেও আক্রান্তকে জেলে বন্দি করা হয়েছে। দেশজুড়ে সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা চালানোর বেসরকারি ঠ্যাঙাড়ে বাহিনীকে বৈধতা দেওয়া হয়েছে। বুলডোজার নীতি আমদানি করে সংখ্যালঘুদের বাড়ি-ঘর, ব্যবসার কাঠামো ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। পদে পদে ধর্মনিরপেক্ষতাকে পদদলিত করে সংখ্যাগুরুবাদের জয়গান করে হিন্দুত্বের আধিপত্যের নাগপাশে গোটা সমাজ ও প্রশাসনকে জড়িয়ে ফেলা হচ্ছে। তাই এই শক্তিকে শুধু ক্ষমতাচ্যুত নয়, নাগরিক সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দিতে হবে। এই নির্বাচন তারই এক মস্তবড় সুযোগ। ধর্মনিরপেক্ষতা ও গণতন্ত্রকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করতে বিরোধীদের জয়যুক্ত করতে হবে। এরাজ্যে অবশ্যই পরাজিত করতে হবে তৃণমূল ও বিজেপি’কে। এই দুই দল আসলে একে অন্যের পরিপূরক।
SECULARISM MUST WIN
জয় হোক ধর্মনিরপেক্ষতার
×
Comments :0