Explosion In Factory

গণেশ ষ্টিলের ভয়াবহ বিষ্ফোরণে প্রশ্নের মুখে শ্রমিকদের নিরাপত্তা

রাজ্য

Explosion In Factory



শ্রীরামপুর দিল্লীরোড সংলগ্ন ছাঁট লোহা ঢালাই কারখানা গণেশ ষ্টিলের ভয়াবহ বিষ্ফোরণ প্রশ্নের মুখে তুলে দিলো দিল্লীরোড সংলগ্ন একাধিক কারখানার শ্রমিকদের নিরাপত্তাহীনতাকে। 
প্রসঙ্গত বলে রাখা ভালো দিল্লীরোডের দুইপ্রান্ত জুড়ে হুগলী জেলার উত্তরে পোলবা-দাদপুর থেকে দক্ষিণে ডানকুনি পর্যন্ত একাধিক ছোট বড় কারখানা রয়েছে। অনেক শ্রমিক অভিযোগ করেন দিল্লী রোড সংলগ্ন এই অধিকাংশ কারখানায় শ্রমিকদের ন্যায্য অধিকারগুলিকে মূল্য দেননা মালিকেরা।

 শ্রমিকের অধিকার নিয়ে যাতে প্রশ্ন না ওঠে তাই ট্রেড ইউনিয়ন করার অধিকার নেই অধিকাংশ কারখানায়। শ্রমিকদের অর্জিত অধিকার শ্রম আইনের সুরক্ষাকবচ কে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে কারখানাগুলির মালিকেরা শ্রমিকদের ১২ ঘন্টা কাজ করতে বাধ্য করেন। কোথাও ২৮০ কোথাও ৩০০ বা সামান্য কিছু বেশি মজুরিতে কাজ করতে বাধ্য হন শ্রমিকেরা। পেনশন গ্র্যাচুয়িটি তো দূর অস্ত ইএসআই এর সুবিধেটুকুও নেই অধিকাংশ কারখানায়। 



এতদিন শ্রমিকদের বঞ্চনা লোকচক্ষুর আড়ালে আর বার্ব ওয়্যারে ঘেরা কারখানার উঁচু পাঁচিলের ওপারে লুকিয়ে ছিলো। গাফিলতি ও বিপজ্জনক কাজে জড়িয়ে ফেললেও আড়ালে ছিলো সবটাই। কিন্তু ভয়াবহ বিষ্ফোরণ অনেক কিছুই পরিস্কার করে দিলো। 
ঘটনাস্থলে দুজন পরে একজন গুরুতর আহত শ্রমিক কে নিয়ে এখনও পর্যন্ত তিনজন শ্রমিক মারা গিয়েছেন। আহত হয়েছেন অনেকেই তাদের মধ্যে একজন আহতের আত্মীয় রাজ্যধরপুর পঞ্চায়েতের পশ্চিমপাড়া গ্রামের বাসিন্দা ছবি ভাঙ্গি জানান, ইএসআই পি এফ এর সুবিধে নেই জানতাম না। তবে প্রচুর খাটুনির কাজ বলতো আমার দেওরের ছেলে। ১২ ঘন্টা ডিউটি দিতে হত। ওইদিন সকাল নটায় পাশের কলে জল তুলতে গিয়েছিলাম প্রবল বিষ্ফোরণে মাটি কেঁপে ওঠে। আমরা তো সব ভয়ে শিঁটিয়ে গিয়েছিলাম। দেওরের ছেলে তো হাসপাতালে ভর্তি। 



আহত শ্রমিক শুভজিৎ কটকির ঠাকুমা লক্ষ্মীরাণী কটকি জানান, ২৮০ টাকা রোজে কাজ করে আমার নাতি। ওদিন ঘটনা ঘটার পরে ওয়ালশে নিয়ে গিয়েছিলো। এখন কলকাতায় অ্যাপোলো হাসপাতালে ভর্তি করেছে শুনছি। ওই কারখানায় পিএফ গ্র্যাচুয়িটি নেই ইএসআইয়ের সুবিধেও নেই। এখন চাপে পড়ে ভর্তি করেছে শুনছি। 
শ্রমিক কৃষ্ণ কটকি জানান ছাঁট লোগা বিভিন্ন সিলিন্ডার আসে কারখানায় তবে এমন ভয়াবহ বিষ্ফোরণ হতে কোনদিন দেখিনি। ভাইপোটা খুব একটা কাছে ছিলোনা তবে টুকরো ছিটকে এসে লেগেছে। 



মৃত শ্রমিক গুঁইরাম দলুইয়ের বাড়ির অবস্থা থমথমে। শোকের ছায়া সেখানে স্পষ্ট। গুঁইরাম দলুইয়ের কনিষ্ঠ পুত্র বিস্তারিত কিছু বলতে না চাইলেও অস্ফুটে বলেন বাবা তো চলেই গেলো। ওফঃ এত ভয়াবহ মৃত্যু কি বলবো বলুন? 
শুক্রবার সিআইটিইউ হুগলী জেলা সম্পাদক তীর্থঙ্কর রায় সহ গণতান্ত্রিক আন্দোলনের নেতা মিঠুন চক্রবর্তী সহ একাধিক জনের প্রতিনিধিদল মৃত ও আহত শ্রমিকদের পরিবারের সঙ্গে দেখা করেন। নেতৃবৃন্দ ঘটনার পূর্নাঙ্গ তদন্তের দাবীও জানান। শ্রমিকদের পরিবারবর্গও তাদের স্বজনহারানো ব্যাথা স্বজনের আঘাতের দুঃখ ভাগ করে নেন নেতৃবৃন্দের সঙ্গে। সবরকম সহযোগিতার আশ্বাস দেন নেতৃবৃন্দ।



ছাঁট লোহার মধ্যে প্রতিরক্ষায় ব্যাবহৃত কামানের গোলা বা মর্টারের শেল ছিলো। শ্রমিকরা জানিয়েছেন দেখতে লম্বাটে লোহার জং ধরা ক্যানেষ্টারের মতো। মৃত্যুফাঁদ তার মধ্যেই লুকিয়ে ছিলো, যেগুলো কাটতে গিয়ে বিষ্ফোরণ হয় বৃহস্পতিবার। স্থানীয় শ্রমিকেরা জানালেন বিষ্ফোরণের তীব্রতা এতটাই ছিলো শ্রীরামপুরের বিস্তীর্ণ এলাকায় আওয়াজ শোনা গিয়েছে। গ্যাস কাটারের আগুনের ফলা লোহা ভেদ করতেই তীব্র শব্দ আর ধুলো ধোঁয়ায় ভরে যায় পড়ে থাকে লাশ। যে দুজন ওই শেলগুলো কাটার কাজে যুক্ত ছিলেন মুহুর্তেই তাদের দেহ ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়। 



প্রশ্ন হল বিষ্ফোরক সমেত গোলা বা মর্টারের শেল ছাঁট লোহার কারখানায় এল কিভাবে? মালিকপক্ষ কি এব্যাপারে কিছু জানতেন না? না জেনে চেপে গেলেন? যদি জেনেই থাকেন তাহলে ঝুঁকির এই কাজ শ্রমিকদের দিয়ে করানোর সাহস পেলেন কিকরে? যতদূর জানা যায় প্রতীরক্ষা সংক্রান্ত সরঞ্জামের টেন্ডার ডাকা হয় তাতে নিশ্চই বিষ্ফোরক সমেত ব্যাবহারের অযোগ্য যুদ্ধাস্ত্র খোলা বাজারে পাঠিয়ে দেওয়া হবেনা। নিশ্চিত বিষ্ফোরক বিশেষজ্ঞের তত্বাবধানে সেগুলিকে আগে নিষ্ক্রিয় করা হবে। 
আমাদের দেশের বিষ্ফোরক আইন ১৮৮৪ র ৬ ও ৬/ক ধারায় সরকারকে বিষ্ফোরক তৈরি পাচার নিষিদ্ধ করার কথা বলা রয়েছে। এই আইনের ৮ ধারায় বলা হয়েছে দুর্ঘটনার কারণে বিষ্ফোরণের ঘটনা ঘটলে মৃত্যু হলে চিফ কন্ট্রোলার এক্সপ্লোসিভ বা স্থানীয় থানায় জানানোর কথা বলা হয়েছে। ৯ নং ধারায় ৮ নং ধারায় বর্নিত ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে জেলাশাসকের নির্দেশে তদন্তের কথা বলা রয়েছে। আইনে যথোপযুক্ত কঠিন শাস্তির কথা লিপিবদ্ধ আছে।
প্রসঙ্গত বলা ভালো শ্রমিকদের নিরাপত্তা ভারতের সংবিধান সুরক্ষিত করেছে। ভারতীয় সংবিধানের ৪২ নং ধারায় বলা হয়েছে মানবিক কার্যক্ষেত্র নির্মান করার কথা। ১৯৪৮ সালের ফ্যাক্টরি আইন, ১৯৫২ সালের খনি আইন, বন্দর শ্রমিকদের নিরাপত্তা ও স্বাস্থ্য সংক্রান্ত আইন ১৯৮৬ ও ১৯৯০, বিপজ্জনক মেশিন রেগুলেশন আইন ১৯৮৩ এ শ্রমিকের নিরাপত্তার কথা উল্লেখ করা রয়েছে। 



সিআইটিইউ হুগলী জেলা সম্পাদক তীর্থঙ্কর রায় বলেন অমানবিক ভাবে কারখানাটিতে শ্রমিকদের যেভাবে শ্রমিকদের শোষণ করা হচ্ছে তা অমানবিক। আমরা চাই মৃত ও ক্ষতিগ্রস্থদের সম্পূর্ণ ক্ষতিপূরণ দিতে হবে, এবং ঘটনার পূর্নাঙ্গ তদন্ত করতে হবে। আমরা অবিলম্বে মালিক ও ঠিকাদারের উপযুক্ত শাস্তির দাবী সহ এই ঘটনার উচ্চ পর্যায়ের তদন্তের দাবী জানাচ্ছি। শ্রমিকদের পেনশন গ্র্যাচুয়িটি দিতে হবে।

Comments :0

Login to leave a comment