10 killed in blast at illegal cracker factory in West Bengal's Egra

‘বোমাই তৈরি হতো’ স্পষ্ট জানালেন মৃতদের আত্মীয়রা

রাজ্য


রামশংকর চক্রবর্তী: এগরা

ঘটনাকে লঘু করেই রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী বলেছিলেন—‘এটা বেআইনি বাজি কারখানায় দুর্ঘটনা, রাজ্যের আইনশৃঙ্খলার সঙ্গে যুক্ত বিষয় নয়’।
  আর এদিন সেই ভয়াবহ বিস্ফোরণের ঘটনাস্থলে দাঁড়িয়েই, বিস্ফোরণে মা’কে হারানো ১৩ বছরের অসহায় কিশোর আকাশ বাগ কান্নাভেজা গলাতেই বলল, ‘ওখানে বড় বড় বোমা তৈরি হতো। লোককে মারার জন্য। মা বলেছিল। বাড়িতে এসে মা বলতো। মা বলেছিল, ইলেকশন এসেছে না, সেজন্য বোমা বানানো হচ্ছে। হুমকি দেওয়া হবে। যারা মানবে না, তাদের বোমা ছোঁড়া হবে। মাকে তো হুমকি দিয়েই কাজে নিয়ে গেছিল। যারা টিএমসিতে কাজ করে, তারা এসে ওখান থেকে বোমা নিয়ে যেত’। 
   বোমা বিস্ফোরণেই নিজের মা’কে হারিয়েছে আকাশ বাগ। ১৩ বছর বয়সি এক কিশোর এই বাংলায় বোমা তৈরির কারখানা, ইলেকশনের আগে কেন বোমার অর্ডার বেড়ে যায়, তারই ব্যাখ্যা দিচ্ছিল প্রকাশ্যে সংবাদমাধ্যমের সামনেই। মা হারানো ১৩ বছরের এক সন্তানের কথায় বেআব্রু হয়েছে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর দাবি।

  এগরা- ১ নম্বর ব্লকের সাহারা গ্রাম পঞ্চায়েতের খাদিকুল গ্রামে তৃণমূল নেতা ভানু বাগের বোমা তৈরির কারখানায় মঙ্গলবার দুপুরে ভয়াবহ বিস্ফোরণে মৃত্যু হয়েছে মাধবী বাগের। তাঁর বড় ছেলে আকাশ বাগ। মোহনপুর হাই স্কুলের ছাত্র।
বুধবার দুপুরে যখন ঘটনাস্থলে এসে পরিকল্পিতভাবে গোটা ঘটনাকে ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা চালাচ্ছিল মন্ত্রী মানস ভুঁইয়ার নেতৃত্বে তৃণমূলের প্রতিনিধিদল, আর গ্রামবাসীরা যখন তাঁদের ঘিরে বিক্ষোভ দেখাচ্ছিলেন সেই সময় কিছুটা দূরে ফাঁকা জায়গায় বসে আকাশ বাগের প্রতিটি কথাতেই ফুটে উঠছিল এই ভয়ানক, মর্মান্তিক বিস্ফোরণে ঘটনার পিছনে শাসক দল, পুলিশের নির্লজ্জ ভূমিকার ছবি, রাজ্যের আইনশৃঙ্খলার এক নিদারুণ চিত্র।

আকাশ বলছিল, ‘আমার মা তো ওখানে প্রথমে কাজ করতে যায়নি। ওরা এসে হুমকি দিয়ে কাজে নিয়ে গেছিল, না গেলে ঘর উড়িয়ে দেবে বলেছিল। মাকে হুমকি দেওয়া হতো, না হলে বাড়ি পুড়িয়ে দিত। ভয়ে চুপ করতে থাকত মা। সিভিক পুলিশও চুপ করতে থাকতে বলে আমাদের। মা বাড়িতে এসে বলতো ইলেকশন আসছে বলে অর্ডার অনেক বোমের’। ঐ কারখানায় কতজন কাজ করত? আকাশের কথায়, ২০-৩০ জন কাজ করত। কালকে কুড়ি জনের মতো ছিল। আমার মা ৩-৪মাস আগে কাজে ঢুকেছিল। এখানকার লোকেরাই বোমা ফাটাতো, টেস্ট করত। খুব আওয়াজ হতো। দিনে দুবার কাজ করতে যেত মা। সকাল সাড়ে সাতটা থেকে নটা, বিকালে তিনটে থেকে ছটা। মাঝে মাঝেই বোমা টেস্ট হতো। 
  মঙ্গলবারের বিস্ফোরণের ঘটনার আরও যা বিবরণ তার কাছ থেকে শোনা গেছে, তা রীতিমতো মর্মান্তিক। আকাশ বলছিল, ‘‘বাড়িতে মাংস রান্না হচ্ছিল। তখন বেলা বারোটা মতো বাজে। বাবা, আমরা দুই ভাই ছিলাম। আর দিদা এসেছিল। মশলা কোথায় রেখেছে তা মায়ের কাছে জানতে চেয়েছিলাম। আমাকে দেখে বলল আধঘণ্টা পরেই বাড়ি যাচ্ছি। মায়ের কথা শুনে আমি বাড়িতে চলে আসি। তারপর একটা বোমা ফাটার শব্দ শুনতে পাই। পুরো বাড়িটা কেঁপে উঠেছিল। পুরো কারখানায় পরপর বোম ফাটছে আর চারিদিকে আগুন জ্বলছে। আমরা কেউই কাছে যেতে পারিনি। তখন দেখছি জলন্ত কিছু লোক দৌড়াদৌড়ি করছে।’’
  বিস্ফোরণস্থল থেকে মৃত মাধবী বাগের বাড়ির দূরত্ব ১০০ মিটারের কিছু কম।

  কী চলছিল এই গ্রামের ভিতরে, কীভাবে পুলিশ-শাসক দলের মদতে প্রকাশ্যে চলছিল বোমা কারখানা, পঞ্চায়েত ভোটের আগে কীভাবে আরও বেশি বোমার অর্ডার আসা শুরু হয়ে গিয়েছিল তা এদিন প্রকাশ্যেই বলেন সাধারণ গ্রামবাসীরা। ভয় ভেঙে গেছে গতকালের ঘটনার পরে। গ্রামবাসীদের কথায়, ভানু বাগ দাপুটে তৃণমূল নেতা। বাড়ির মহিলাদের তার কারখানায় জোর করে কাজে যোগ দেওয়াতো। না গেলে হুমকি, মিথ্যা মামলায় বাড়ির লোকেদের জড়িয়ে দেবার হুমকি দিত। যেসব মহিলারা কাজ করতে যেতেন না তাদের স্বামী বা বাড়ির লোকেদের মিথ্যা মামলা দিয়ে জেলবন্দিও করত এই ভানু বাগ।    কিন্তু একজন স্থানীয় তৃণমূল নেতার এত দাপট কীভাবে হয়? মৃত জয়ন্ত জানার স্ত্রী ও তাঁর পরিবারের সদস্যরা এদিন প্রকাশ্যেই জানালেন, নিয়মিত পুলিশের সঙ্গে টাকার লেনদেন চলত। গ্রামবাসীরাও তাতে সায় দিয়ে তখন বলছিলেন, সাহারা গ্রাম পঞ্চায়েতের একসময়ের উপপ্রধান তৃণমূল নেতা প্রভুপদ দাস ও এলাকার সিভিক পুলিশ হরিপদ দাস ভানু বাগের হয়ে এলাকায় দাপিয়ে বেড়াতো। শুধু তাই নয় জানা গেছে ভানু বাগের ছেলে পৃথ্বীজিৎ বাগ (প্রসেনজিৎ) জাল সারের ব্যবসা করে। গোপীনাথপুরে পেল্লাই বাড়ি তাঁর। ঘটনার পর থেকে সেও পলাতক বাবা-মায়ের মতো। 
  

  বিস্ফোরণের যে স্থল সেই এলাকার ভূগোলও গুরুত্বপূর্ণ। সাহারা গ্রাম পঞ্চায়েতের খাদিকুল গ্রামের ঠিক মাঝ বরাবর প্রধানমন্ত্রী গ্রামীণ সড়ক যোজনার রাস্তার পাশে জলা জমির উপর ভানু বাগের বোমা কারখানা। এই গ্রামের পশ্চিমে বারান্দিয়া, দক্ষিণে সাহারা, পূর্বে সুনিয়া শ্রীপুর, উত্তরে গোপীনাথপুর গ্রাম। পশ্চিম দিকে বারান্দিয়া গ্রামের পর সিয়ারি গ্রাম, যা ওডিশায়। আবার দক্ষিণ দিকে সাহারা গ্রামের পর ওডিশা। 
  সাহারা গ্রাম পঞ্চায়েতের বর্তমান উপ প্রধান মিলন দে বলেন, বর্তমান গ্রাম পঞ্চায়েতের প্রধান স্বপন দণ্ডপাট তো তৃণমূলেরই নেতা। একসময় তৃণমূলের ব্লক কমিটির ও সাহারা অঞ্চল সহ সভাপতির দায়িত্বে ছিলেন। এই বুথে ভানু বাগের বৌমা কবিতা বাগ তৃণমূল প্রার্থী হিসাবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে হেরে যায়। মমতা ব্যানার্জি দাবি করছেন এই এলাকায় তৃণমূল নেই। অথচ সাহারা গ্রাম পঞ্চায়েত তৃণমূলের দখলে।

  প্রথম থেকেই এই ভানু বাগ বোমার কারবারি। ভালো বোমা তৈরি করে বলে নামডাক রয়েছে ভানুর। এলাকাবাসীর কথা অনুযায়ী হাত বোমা, এমনকি মাইন তৈরিরও কারবার ছিল তার। সেই অনুযায়ী ওডিশা, পূর্ব-পশ্চিম মেদিনীপুর, ঝাড়গ্রাম, হাওড়া, হুগলী, কলকাতার বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে তার ব্যবসা। ঝাড়গ্রাম এবং পশ্চিম মেদিনীপুরে ভানুর লেনদেনের কারবার ছিল। 
  এলাকাবাসীর এই মারাত্মক অভিযোগ আরও স্পষ্ট হলো মৃত ১৯ বছরের অলক মাইতির বাবা গৌরাঙ্গ মাইতির কথায়। তিনি অভিযোগ করেন, তাঁর ছেলেকে ভুল বুঝিয়ে কাজে নিয়ে গিয়েছিল ভানু বাগ। তিনি বলেন, ‘‘তাকে আমি বলতে যাই আমার ছেলেকে যেন কাজে না নেয়। উলটে আমাকে হুমকি দেখায় ভানু। ওর কঠোর শাস্তি হোক। আমার ছেলেকে মেরে দিয়েছে ও। বাইরের জেলাতেও ভানুর লোক কাজ করে। সেখানে বোমা সাপ্লাই হয়। মাওবাদীরা যেমন হাত বোমা তৈরি করে সেই রকমই বোম এখানে তৈরি হয়।’’
 ভানুর এই বোমার কারখানায় মহিলা শ্রমিক সংখ্যায় বেশি। মুর্শিদাবাদ থেকে ৪ জন কারিগর কাজ করত। যদিও ঘটনার পর থেকে সেই চারজনের কোনও হদিশ নেই। স্থানীয় বাসিন্দারা বলছেন, হয় তাদের দেহ লোপাট করা হয়েছে, নয়তো তারা গা ঢাকা দিয়েছে।

Comments :0

Login to leave a comment