আমাদের সব চলে গেল। এই ছোট ছোট দুটো বাচ্চাকে আমি মানুষ করবো কী করে? সবাই একদিন দুদিন দেখবে। তারপর কী হবে? স্বামী আমজেদ আলি সরদারকে অকালে হারিয়ে শোকে পাথর কারিমা বেওয়ার প্রশ্ন। এই একই প্রশ্ন আমিরুল সরদারের বাবা রব্বানী সরদারের। ঘরে ছোট দুটো বাচ্চা। কী করে মানুষ করবো ওদের? বাবা সুরজ মণ্ডলকে হারিয়ে শোক সামলে নিয়ে শনিবার মাধ্যমিকে ভূগোল পরীক্ষা দেওয়ার পরেও দুশ্চিন্তা পিছু ছাড়ছে না ছেলে কাশ্মীর মণ্ডলের। সে ইঞ্জিনিয়ার হতে চায়। সে কথা জানিয়েছিল বাবাকে। সে কী আর ইঞ্জিনিয়ার হতে পারবে না? কাশ্মীরের দিদি জ্যোতি খাতুনের শখ সে শিক্ষিকা হবে। ধান্যকুড়িয়া হাইস্কুলে একাদশ শ্রেণীর কলা বিভাগের ছাত্রী জ্যোতি। বাবাকে হারিয়ে তারও স্বপ্ন কী অধরাই থেকে যাবে? করিম সরদারের চাচা শেখ মানোয়ার হোসেন ধরা গলায় উচ্চারণ করলেন ঘরের সব আলো নিভে গেল। বাচ্চাগুলোর কী হবে? হাজারো মানুষের ভিড়ে সরদার পাড়ার ক্যানভাসে ফুটে উঠেছে এমনই হাজারো প্রশ্ন চিহ্ন! ময়নাতদন্তের পর রবিবার উড়িষ্যার জাজপুর থেকে বসিরহাটের নেহালপুরে এসে পৌঁছায় ৭জন পরিবহন শ্রমিকের নিথর দেহ। হাজার হাজার মানুষের চোখের জলে শেষ বিদায় নিল সুরজ মন্ডল, আমিরুল সরদার, মোয়াজ্জেম সরদার, করিম সরদার, জাহাঙ্গীর সরদার, আরিফ সরদার, আমজেদ আলি সরদার।
স্বজন হারানোর হাহাকারবুকফাটা কান্না আর শোকের পাথরে চাপা সরদার পাড়ায় দাঁড়িয়ে সিপিআই(এম) নেতা সঞ্জীব মণ্ডল জানান কঠিন বাস্তবের মুখে পড়ে গেল পরিবারগুলি। আজ কাল পরশু সবাই আসবে। তারপর? আমরাএ পার্টির পক্ষ থেকে অতীতে এদের পাশে ছিলাম। আজও আছি। ভবিষ্যতেও থাকবো।
রাজ্য সরকারের পক্ষ থেকে বনমন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক এদিন যান নেহালপুরের সরদার পাড়ায়। বসিরহাট জেলা পুলিশ সুপার জোবি থমাস কে, মহকুমা শাসক মৌসম মুখার্জি,বিডিও জয়দীপ চক্রবর্তী সহ অন্যান্য আধিকারীকদের উপস্থিতিতে তিনি মৃত শ্রমিক পরিবারগুলির হাতে ক্ষতিপূরণবাবদ ২ লক্ষ করে টাকা তুলে দেন। সেই সাথে তৃণমূলের স্থানীয় নেতৃত্বের পক্ষ ১০ হাজার করে টাকা তুলে দেওয়া হয়।
রাজ্যের সংখ্যালঘুদের জন্য সরকার অনেক কাজ করেছে। উন্নয়নের ফানুস উড়িয়ে মুখ্যমন্ত্রী এবং তার দল তৃণমূল কংগ্রেস প্রায়শই এমন প্রচার করে থাকে। নেহালপুরের সরদার পাড়া চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিল শ্রম বিক্রি এখন আর গ্রামে সম্ভব নয়। যুবক যুবতিদের স্বনির্ভর করে তুলতে সরকার কোটি কোটি টাকার বাজেট বরাদ্দের কথা বলে। ৭জন যুবকের তরতাজা প্রাণ নিথর হয়ে সরকারের মুখের উপর জবাব ছুড়ে দিয়ে বলে গেল তোমাদের ভেক কথা বন্ধ করো। শ্রম বেঁচতে গেলে ছাড়তে হয় ভিটেমাটি।
মৃত ৭ পরিবহন শ্রমিক পেটের তাগিদে ঘর ছেড়েছিল শুক্রবার। লক্ষ্য তাদের একটাই। শ্রমের বিনিময়ে নিজের এবং পরিবারের মুখে তুলে দেবে দুমুঠো অন্ন। সওয়ার হয়েছিল স্থানীয় কোম্পানির পোল্ট্রির গাড়িতে। শনিবার ভোররাতে জীবনের দাঁড়ি টেনে দিল উড়িষ্যার জাজপুর জেলার ধর্মশালা থানার ১৬নং জাতীয় সড়কে ঘাতক ট্রাকের ধাক্কা। অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে এঁদো গলির আঁকে বাঁকে গা ঘেষাঘেষি করে ভূমিহীন হতদরিদ্র মৃত ৭ জন শ্রমিক পরিবারগুলির বাস। জানাজা নামাজের পর তারই অদূরে এদিন সম্পন্ন হয় শেষকৃত্য।
Comments :0