অলকেশ দাস
শতবর্ষে আরএসএস। এই দশেরায় একশো বছরে পা রাখলো সঙ্ঘ পরিবার। ভেবেছিল লোকসভা নির্বাচনের পর স্বস্তিতে গান গাইবে— আহা কি আনন্দ আকাশে বাতাসে। বিধি বাম। আব কি বার, চারশো পার— হলো কই? কষ্টকল্পিত হয়ে গেল সংবিধান পরিবর্তন। অধরা হয়ে থাকল হিন্দুরাষ্ট্র। অথচ প্রাক আয়োজন চূড়ান্ত ছিল। এ বছরের গোড়ায় রাম মন্দিরের উদ্বোধন হয়েছিল। ঢাক ঢোল পিটিয়ে বলা হয়েছিল এটা নাকি জাতীয় চেতনার প্রতীক। দেশের অগ্রগতির অবিস্মরণীয় মুহূর্ত। তার আগে হিন্দুত্বের রোঁয়া ওঠা এক প্রখর অনুষ্ঠানে উদ্বোধন হয়েছিল নয়া সংসদ ভবনের। কাশীর জ্ঞানবাপী মসজিদ আর মথুরার ঈদগায় মন্দিরের অনুনাদ সর্বত্র ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। নাগরিকত্ব আইনের বিধি তৈরি করে পাকাপাকিভাবে সংবিধানকে টপকে নাগরিকত্বের সঙ্গে ধর্মকে জুড়ে তাকে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছিল। সংসদে 'ধর্মনিরপেক্ষতা' আর 'সমাজতন্ত্র' মুছে দেওয়া সংবিধান বিলি করা হয়েছিল। চিৎকার করে বলা হয়েছিল অভিন্ন দেওয়ানি বিধি চালু হবেই। সাম্প্রতিক সময়ে এ'রকম হিন্দুত্বের হুহুঙ্কার ভারতীয় জনগণ প্রত্যক্ষ করেনি। তবু শেষ রক্ষা হয়নি। একদলীয় নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা হয়নি। যাদের ঘাড়ে ভর দিয়ে সরকার তৈরি হয়েছে 'দলবদলু' কুখ্যাতিতে তাদের ঘাড় বড় তুলতুলে নরম। তারপরে কাশ্মীর। তাদের ঘাড় মটকে ৩৭০ ধারা বাতিল আর আত্মমর্যাদা কেড়ে রাজ্যকে টুকরো করার প্রতিশোধ নিলো রাজ্যের জনগণ। বিধানসভা নির্বাচনে। ক্রীড়াবিদদের যৌন হেনস্তার ঘটনায় ব্রিজভূষণ, মোদীদের মুখে ঝামাঘষা ভিনেশ ফোগাতও এদিকে হরিয়ানায় জিতে গিয়ে বিজেপি’র মুখে চুনকালি লাগিয়েছে। পড়ে রইলো সামনে ঝাড়খণ্ড আর মহারাষ্ট্রের নির্বাচন। খবর আসছে গেরুয়া ফিকে হয়ে যাচ্ছে। অগত্যা আবার সেই পুরানো অস্ত্র নতুন কায়দায় খুলছে সঙ্ঘ পরিবার। হেট স্পিচ। বিদ্বেষের ভাষণ। ধর্মান্ধ হিংস্র শক্তি তাদের ঘৃণা, মিথ্যা ও বিভেদের ছক নিয়ে সুপরিকল্পিতভাবে গণতন্ত্র, প্রগতিশীল চিন্তাভাবনা এবং সামাজিক, অর্থনৈতিক সমানাধিকারের যে কোনও ধারণাকে উড়িয়ে দিতে দৃঢ় সংকল্প। এখানেও বিভাজন আর আক্রমণের কেন্দ্রবিন্দু মুসলমানেরা। এখানেও ভয়ঙ্কর উচ্চারিত হচ্ছে ধর্ম ফ্যাসিস্তদের প্রিয় শব্দ-হিন্দু খাতরে মে হ্যায়।
কি হচ্ছে ঝাড়খণ্ডে? বিজেপি’র চারজন দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। চারজনাই মন্ত্রী। প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী, মুখ্যমন্ত্রী ইত্যাদি। নরেন্দ্র মোদী, অমিত শাহ, শিবরাজ চৌহান ,হেমন্ত বিশ্বশর্মা। মুখের ভাষা? অমিত শাহ বলেছেন- যারা ঝাড়খণ্ডের মেয়েদের অত্যাচার করবে তাদের মাথা নিচে আর পা উপরে করে ঝুলানো হবে। হিন্দি সিনেমার ফিল্মের ভিলেনদের মতো। এদিকে আর একজন মুখ্যমন্ত্রী আদিত্যনাথ যোগী বলেছেন মাফিয়াদের বুলডোজার দিয়ে পিষে দেওয়ার জন্য বিজেপি-কে আনুন। উত্তর প্রদেশে তিনি নাকি আইন-টাইনের তোয়াক্কা না করে তাই করেছেন।
প্রধানমন্ত্রী সভায় বলছেন প্রমাণ এবং তথ্যের কোনও তোয়াক্কা না করে। কংগ্রেস যদি জেতে তাহলে হিন্দু শিশুদের সম্পত্তি সব মুসলমানদের ভাগ করে দেবে। দেশের পরমাণু বোমার ভাণ্ডার ফাঁকা করে দেবে। লক্ষ্য পাকিস্তান। যাদের হামলা করতে সুবিধা হবে। মোদী বলছেন বেআইনি অনুপ্রবেশের কথা। বলছেন এরা সন্তান পয়দা করে বেশি। এরা এসে ঝাড়খণ্ডের আদিবাসীদের রুটি,মাটি,বেটি কেড়ে নেবে। আর এক ধরনের লাভ জিহাদের হুঙ্কার। একবারও বলছেন না যে যদি অনুপ্রবেশ হয়েই থাকে তাহলে তার নিয়ন্ত্রণের বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্স ঘুমিয়ে থাকছে কেন? দায় কার? মোদি বলেছেন যে আদিবাসীদের জমি কাড়া হয়েছে তাদের জমি বিজেপি সরকার এলে ফেরত দেবে। মানে তিনি স্বীকার করে নিচ্ছেন যে আদিবাসীদের জমি কাড়ায় বড় ভূমিকা তার। তাদের কর্পোরেট ঘেঁষা খনি আর কয়লা নীতি আদিবাসীদের জল, জমি, জঙ্গলের অধিকার কেড়ে নিয়েছে। বিজেপি’র নির্বাচনী ইস্যু শেষ অবধি দাঁড়িয়েছে গোরুর মাংস, মঙ্গলসূত্র আর মুসলমানকাহনে। এখানেও বলা হচ্ছে কংগ্রেস যদি জেতে তাহলে হিন্দু মহিলাদের মঙ্গলসূত্রের সোনা মুসলমানদের বিলিয়ে দেওয়া হবে। কংগ্রেস- জেএমএম জোটকে বলা হচ্ছে ঘুষপেটিয়া বন্ধন, মাফিয়া কা গুলাম। বিকৃত করে বলা হচ্ছে মনমোহন সিং যখন প্রধানমন্ত্রী ছিলেন তখন নাকি বলেছিলেন যে দেশের সম্পদে মুসলমানদের প্রথম অধিকার থাকবে। উত্তেজনার পারদ চড়ানো হচ্ছে হিন্দুদের। বলা হচ্ছে বিজেপি ক্ষমতায় না আসলে মন্দিরে ঘণ্টা বাজবে না, কিন্তু মসজিদের মাইকে আজানের আওয়াজ বাড়বে। অমিত শাহ উত্তর প্রদেশে বলেছিলেন সমাজবাদী পার্টি সরকারে থাকলে রমজান মাসে বিদ্যুৎ সরবরাহ ঠিক থাকে। জন্মাষ্টমীতে থাকে না। কটাক্ষটা মুসলিম তোষণের দিকে। এখানেও অবিকল সেই প্রচার হচ্ছে। মুসলমানদের বলা হচ্ছে-'ইমপোরটেড'। সাম্প্রদায়িকতার ডালি নিয়ে সোশাল মিডিয়ায় নেমে পড়েছে সঙ্ঘ পরিবার। ফেসবুক থেকে সব জায়গায় অন্য তৃতীয় পক্ষের অ্যাকাউন্ট থেকে টাকা যাচ্ছে। পোস্টের রিচ বাড়াতে। আইটি সেল রসদ তৈরি করছে। যেখানে মুসলমান রেপিস্ট, মুসলমান ক্রিমিনাল। যত যৌন অত্যাচার যেখানে, সেখানে দায়ী সব মুসলমানেরা। মেটায় অভিযোগ আছড়ে পড়ছে। কোনও কাজ হচ্ছে না। মুখ্যমন্ত্রী হেমন্ত সোরেনকে দেখানো হচ্ছে মাথায় সিং গজিয়েছে। কখনো কখনো পোকার উপরে তার মুখ বসানো হচ্ছে। এক ভিডিও ক্লিপিং ছাড়া হয়েছে। একটু মুসলমান ছেলে তরবারি নিয়ে একজন হিন্দুকে তাড়া করেছে। গায়ে তার সবুজ পোশাক। গেরুয়াধারী হিন্দু পালাচ্ছে। রাস্তায় সে সাথি পেয়ে যায় অনেক হিন্দুকে। এবার একসঙ্গে মিলে তারা মুসলিম ছেলেটিকে তাড়া করে। একেবারে শেষে দেখানো হয়— বাটেঙ্গে তো কাটেঙ্গে। সংগঠিত রহিয়ে। সুরক্ষিত রহিয়ে। মানে সব হিন্দুরা এক হও। এই একই কথা এ'বছরের বিজয়া দশমীর ভাষণে মোহন ভাগবত বলেছেন— দুষ্ট শক্তিকে প্রতিহত করতে সব হিন্দুদের একত্রিত হতেই হবে। ঝাড়খণ্ড চৌপল নামে বিজেপি’র এনজিও প্রচার করছে সমাজ মাধ্যমে-যদি হেমন্ত সোরেন আবার মুখ্যমন্ত্রী হয় তবে মুসলিম ঘুষপেটিয়ারা দীপাবলীর দীপ আর জ্বালাতে দেবে না। বিজেপি’র আইটি সেলের কাজ হচ্ছে নিয়মিত ফেক খবর দেওয়ার জন্য পোর্টাল খোলা। এখানেও সেই হিন্দু মুসলমান ন্যারেটিভ। হিন্দি হিন্দু হিন্দুস্তান। ঘুষপেটিয়া। উইপোকা বা মছলিখোর ইত্যাদি।
লোকসভা নির্বাচনের সময় মোদী যে ১৭৩টি ভাষণ দিয়েছিলেন তার মধ্যে ১১০ টি ছিল ইসলামোফোবিয়ায় ভরা। নির্বাচন কমিশন সব জানতো, সব জানানো হয়েছিল। টানা এক কুম্ভকর্ণের ঘুম দিয়েছিল। এবারও তাই। কংগ্রেস, ইন্ডিয়া ব্লক নির্বাচন কমিশনে আবেদন করেছে, কিন্তু তাতে বরফ গলছে না। নির্বাচন কমিশন নিজে মডেল কোড অব কন্ডাক্টকে চাপা দিয়ে রেখেছে। চাপা দিয়ে রেখেছে সেকশন ১৫৩। যেখানে দাঙ্গায় প্ররোচনা দেওয়ার বিরুদ্ধে নিদান রয়েছে । উলটে রেখেছে সেকশন ১২৩(৩)কে। রিপ্রেজেন্টেশন অব দি পিপলস অ্যাক্ট। যেখানে লেখা আছে প্রার্থী এবং তার সঙ্গীরা কোনও ভোটারের কাছে ধর্ম, জাতি বর্ণ, সম্প্রদায়, ভাষার ভিত্তিতে আবেদন করতে পারবে না।
যদি ধর্ম এগিয়ে আসে তাহলে জাতপরিচিতিই বা পিছিয়ে থাকবে কেন? বিজেপি খুল্লামখুল্লা প্রচার করছে যদি কংগ্রেস ক্ষমতায় আসে তাহলে এসসি, এসটিদের সংরক্ষণ কেড়ে নিয়ে তা মুসলমানদের দিয়ে দেবে। এই কথা যারা বলছে তাদের নেতা অমিত শাহ এই লোকসভা ভোটের মধ্যে চেতাবনী দিয়েছিল-পূর্ণ ক্ষমতায় এলে সংরক্ষণ তুলে দেবো। জল্লাদেরা প্রেম বিলাচ্ছে।
গরিব মানুষের ধর্ম নিয়ে অত ঘোর প্যাঁচ ভাবার সময় নেই। জীবন জীবিকার সঙ্কটে সে জর্জরিত। তাকে ঘৃণা আর উত্তেজনার অন্ধ গলিতে ঢুকিয়ে দিতে চাইছে দাবার ছকে। ধর্মব্যবসায়ীরা। যারা ঠিকা নিয়েছে কর্পোরেটদের। এই হলো কর্পোরেট-কম্যুনাল নেক্সাস। ঝাড়খণ্ড খনির রাজা রাজ্য। এখানে কয়লা, খনিজ লোহা, মাইকা, বক্সাইট, লাইমস্টোনের খনি। এখানে ইস্পাত কারখানা, বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র। সরকারের জিডিপি’র ৫০ শতাংশ আসে সার্ভিস ট্যাক্স থেকে। আবার কৃষি ক্ষেত্র মোট কাজের ৫০ শতাংশের জোগান দেয়। মহারাষ্ট্রের মুম্বাই দেশের অর্থনৈতিক রাজধানী। এই দুই রাজ্য মৃগনাভির মতো আকর্ষণ করে কর্পোরেটদের। মানুষকে ধর্ম আর জাতে ভাগ করে যদি সঙ্ঘীদের হাত ধরে ক্ষমতা আর অর্থের নিয়ন্ত্রণ পাওয়া যায় তাহলে মন্দ কি! তাতে যদি মুসলমানদের বলির পাঁঠা করা হয়, হোক না! টলস্টয় বলেছিলেন ইতিহাসের বিষয়বস্তু মানুষের জীবন এবং মানবিকতা নিয়ে। ঝাড়খণ্ড আর মহারাষ্ট্রের নির্বাচনের প্রচারে মানবিকতাকে ইতিহাসের পাতা থেকে সরিয়ে দেওয়া হচ্ছে।
দু' রাজ্যের নির্বাচনে প্রচারের বড় জায়গা দখল করেছে রাম। জোটবন্ধনের বিরুদ্ধে বড় অভিযোগ যে তারা রাম মন্দির চায়নি। যে রামের কথা এত আসছে, যার মন্দির নিয়ে এত বিতর্ক, সেই রাম রাবণের কাছ থেকে ফিরে আসার পর সীতাকে বলছে-পরহস্ত গতাং নারীং মুহুর্তমপি ধারয়েৎ। সুবৃত্তা মসুবৃত্তাং বা ত্বামহমদ্য মৈথিলী। নোৎসাহ পরিভোগায় শ্বাবলীয়ং হবির্যথা ।
অর্থাৎ যে নারী পরগৃহে বাস করেছে তাকে কিভাবে গ্রহণ করা যায়? সচ্চরিত্রই হোক আর অসচ্চরিত্রই হোক, তোমাকে আমি গ্রহণ করতে পারি না, কুকুরে চাটা ঘিয়ের মতো। আমাদের রাজ্যেও এখন এই রামের রামনবমী নিয়ে প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে। সরকারের নরম হিন্দুত্বের ছড়াছড়ি। পুজো অনুদান, এক হাতে বারোশো পুজোর উদ্বোধন, রাতকে দিন করা বিলাসের কার্নিভাল, সতীর নামে সাগর আরতি, দীঘায় জগন্নাথ মন্দির, ধনতেরাস, দিওয়ালি, গণেশ চতুর্থী, বজরংবলী, কার্তিক পুজো, জন্মাষ্টমী...। ক্রমশ সংখ্যা বাড়ছে। হুজুগ বাড়ছে। বাঙালির পান ছিল। পানপরাগ ছিল না। বাজারি সংস্কৃতি, পণ্যাকারে দখল করছে আমাদের অভ্যাসের অঙ্গন। চেনা মানুষগুলো নতুন করে পরিচিত হচ্ছে। বদলে যাচ্ছে মানুষ। যন্ত্রণা জর্জর সংসারে উৎসব আর অনুদান যে প্রভাব ফেলতে পারছে না তা কেউ বলবে না। ফাঁকে তৈরি হচ্ছে বসিরহাট ,বাদুড়িয়া, তেলিয়াপাড়া ইত্যাদি। সরকারের বাধ্যতায় এবং প্রশ্রয়ে রাজ্যে বাড়ছে সঙ্ঘীদের কাণ্ড। এরা ধর্ষিত হলে ধর্ষকদের ধর্ম খোঁজে আর সরকারি দল ধর্ষকদের আড়াল করে। বাবরি মসজিদ ভাঙা হয় ১৯৯২-তে। যারা ভেঙেছিল তাদের উপর নজর রাখা হয়।। তাদের প্রত্যেকের পরনে গেরুয়া। কৌপিন। পিছনে সুতোর মতো লেজ। তাদের সকলকে নাম জিজ্ঞাসা করা হয়। প্রত্যেকে বলে তাদের নাম -রাম। অনেকটা গেরুয়া মিছিলে মোদীর মুখোশ পরে অনেকের হাঁটার মতো। আত্মপরিচয় ভুলিয়ে একটা ভ্রান্ত পরিচয়ের মাদকতার মধ্যে রাখা। মাদকতা এমনই একটা গোটা মসজিদ ভেঙে ফেলে দিতে পারে। একটা সংস্কৃতির অপমৃত্যু ঘটাতে পারে। একটা ইতিহাসের সামনে কালো পর্দা ঝুলিয়ে দিতে পারে। দেশ এবং রাজ্যের শাসকেরা হিন্দু পরিচিতি আর হিন্দুত্বের মতাদর্শের পথে। বাকিটা অভিনয়। অথচ এদেরই পরিচালিত করার কথা জনগণকে। শেকসপিয়র ঠিকই বলেছিলেন— এ হলো কালের পীড়া, যখন অন্ধ মানুষদের পথ দেখায় উন্মাদ মানুষেরা।
Comments :0