আভাস রায় চৌধুরি
লোকসভা নির্বাচনে জনগণের কাছে ধাক্কা খাওয়ার পরও আরএসএস/বিজেপি’র নেতৃত্বে এনডিএ সরকার পূর্ববর্তী মোদী সরকারের পথ ও লক্ষ্য থেকে সরে আসেনি। বর্তমান সরকারও দেশের সম্পদ ও জনগণকে দুনিয়া জুড়ে ক্রমবর্ধমান লুটতন্ত্রের মধ্যেই ঠেলে দিতে চায়। লাভজনক রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্রগুলিকে নানাভাবে অবাধে বেসরকারি লুটেরা পুঁজির মালিকদের হাতেই তুলে দিচ্ছে সরকার। রেল, প্রতিরক্ষা, কয়লা, ইস্পাত, বিদ্যুৎ, পোস্টাল, টেলিকমিউনিকেশন, বন্দর, বিমানবন্দর, ব্যাঙ্ক, বিমা ইত্যাদি রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্রগুলিতে লক্ষ লক্ষ শূন্য পদ। স্থায়ী কাজে হাজার হাজার ঠিকা ও অস্থায়ী কর্মী দিয়ে কাজ করানো হচ্ছে। অসংগঠিত ক্ষেত্র ও গ্রাম-শহরে দিনমজুরদের মজুরি কমছে। সারা দুনিয়ার সবথেকে বেশি বেকার বসবাস করে ভারতে। কৃষিতে প্রকৃত কর্মসংস্থান ও প্রকৃত আয় কমছে। একশ দিনের কাজের প্রকল্পে কেন্দ্রীয় বরাদ্দ ক্রমহাসমান। পশ্চিমবাংলায় দুর্নীতি এবং কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকারের ‘উপরে কুস্তি ভিতরে দোস্তি’ নীতির ফলে একশো দিনের কাজ বন্ধ। এই সমস্ত ঘটনাগুলির নিট ফল, বেকারের সংখ্যা লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়ে চলা।
ক্রমবর্ধমান জীবন যন্ত্রণা
সাম্প্রতিক সময়ে ইনস্টিটিউট ফর হিউম্যান ডেভেলপমেন্ট এবং ইন্টারন্যাশনাল লেবার অর্গানাইজেশনের যৌথভাবে প্রকাশিত 'ইন্ডিয়া এমপ্লয়মেন্ট রিপোর্ট ২০২৪' অনুযায়ী ২০২২ সালে ভারতের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড ও কাজের বাজারে তরুণ অংশের অংশগ্রহণ কমেছে ৩৭ শতাংশ। সেন্টার ফর মনিটরিং ইন্ডিয়ান ইকোনমি (সিএমআইই) রিপোর্ট দেখাচ্ছে ২০২৪ 'র জুনে ভারতে বেকারির হার ছিল ৯.২ শতাংশ, মে মাসে যা ছিল ৯ শতাংশ। ২০২৩ সালের জুনে বেকারির হার ছিল ৭.৭ শতাংশ। বিশ্বব্যাপী নয়া উদারবাদে উৎপাদনের ক্ষেত্রের বদলে ফাটকার মাধ্যমে লুটতন্ত্রকে প্রতিষ্ঠা করলে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয় না, এটা স্পষ্ট। আমাদের দেশ, রাজ্য দুই সরকারই আন্তর্জাতিক এই লুটতন্ত্রের অক্ষের মধ্যেই আটকা পড়েছে। আরএসএস/বিজেপি, তৃণমূল কংগ্রেস সহ অতি দক্ষিণপন্থীরা লুটতন্ত্রকে অটুট রাখতে ওদের প্রভুদের কাছে দায়বদ্ধ। কাজ নেই, ন্যূনতম মজুরির নিশ্চয়তা নেই। ক্রমবর্ধমান দারিদ্র ও অভাবে দেশ ও রাজ্যের বহু মানুষ কার্যত সরকারি ভাতার উপর নির্ভরশীল হয়ে অনির্দিষ্ট ভবিষ্যৎহীন জীবনযাপন করতে বাধ্য হচ্ছেন।
খাদ্যপণ্য সহ নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে। চলতি সেপ্টেম্বর মাসে বিগত ৯ মাসের তুলনায় নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম ৫.৫ শতাংশ বেড়েছে। তার মধ্যে খাদ্য পণ্যের দাম বেড়েছে ৯.২ শতাংশ। সংখ্যাগরিষ্ঠ ভারতবাসীর মাসিক আয়ের অর্ধেকের বেশি খরচ হয় খাবার কিনতে। গত বছরের তুলনায় টমেটো, পেঁয়াজ ও আলুর দাম বেড়েছে যথাক্রমে ৪২.৪ শতাংশ, ৬২.২ শতাংশ এবং ৬৫.২ শতাংশ। শারদ উৎসবের সময়েই গত তিন মাসের তুলনায় ভোজ্য তেলের দাম বেড়েছে ৪৫ শতাংশ। বড় বড় কোম্পানিগুলি বেপরোয়া মুনাফা বাড়িয়েছে, অথচ সাধারণ মানুষ খাবারের পরিমাণ ও পুষ্টি থেকে বঞ্চিত। অনেক নিম্নবিত্ত পরিবারে মাছ-মাংস তো দূরের কথা, ভাতের থালায় ডিম জোগাড় করতেও পারছেন না। নিরুত্তাপ দুই সরকারই।
চলতি সময় পেট্রোল, ডিজেল ও রান্নার গ্যাসের দাম ধারাবাহিকভাবে বেড়ে চলেছে। অথচ চলতি বছরের এপ্রিল থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত আন্তর্জাতিক বাজারে অপরিশোধিত খনিজ তেলের দাম ১৮ শতাংশ কমেছে। ৯ নভেম্বর, ২০২৪ আন্তর্জাতিক বাজারে অপরিশোধিত খনিজ তেলের দাম ছিল ব্যারেল প্রতি ৫৯৫০ টাকা। অর্থাৎ ৪৯ টাকা ৫৮ পয়সা প্রতি লিটার। অথচ ঐদিন কলকাতায় পেট্রোলের দাম ছিল ১০৪ টাকা ৯৫ পয়সা লিটার। বলাবাহুল্য পেট্রোল-ডিজেলের চড়া মূল্যের প্রত্যক্ষ প্রভাব পড়ে পরিবহণ খরচ ও নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দামে। এদিকে ওষুধের দাম নিয়ম করে বেড়ে চলেছে। এমন অনেক পরিবার আছে যেখানে বাধ্যতামূলকভাবে ওষুধ কিনতে হয়, অথচ তাঁদের ঠিকভাবে খাবার জোগাড় করার সংস্থানও নেই। কর্পোরেটের স্বার্থে সম্প্রতি কেন্দ্রীয় সরকার কয়েকটি অত্যাবশ্যকীয় ওষুধের দাম ৫০ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি করার অনুমোদন দিয়েছে। ফলে বোঝা যায় ইলেক্টোরাল বন্ডের মাধ্যমে বিজেপি ও তৃণমূল কংগ্রেসের ফান্ডে কেন বহুজাতিক ও দেশীয় ওষুধ কোম্পানিগুলো বিপুল অর্থ দেয়। বিগত এক দশক ধরে ছাত্র-ছাত্রীদের লেখাপড়ার খরচ কয়েকগুণ বেড়ে গিয়েছে এবং তা বেড়েই চলেছে। এই সব সমস্যাগুলোই দেশের প্রধান সমস্যা বলে বিবেচনা করা উচিত।
অথচ দেশ ও রাজ্যের সরকার সাধারণ মানুষের জীবন-জীবিকার এই বিষয়গুলি সম্পর্কে উদাসীন।
আক্রান্ত দেশের বহুত্ববাদ
বহু ভাষা, বহু ধর্ম, বহু জাতিসত্তা, বহু সংস্কৃতি, বৈচিত্রপূর্ণ ভৌগোলিক পরিবেশ নিয়েই ভারতের জাতীয়তাবাদের চরিত্র বহুত্ববাদী এবং এটি একটি বহুজাতিক দেশ। স্বাধীনতার লড়াইয়ের সময়েই বহুত্ববাদী ভারতের রাজনৈতিক ঐক্য এবং জাতীয়তাবাদের ধারণা গড়ে উঠেছে। প্রাক স্বাধীনতা পর্বে গণপরিষদে এই বিষয়কে কেন্দ্র করে বিতর্ক ও আলোচনার মধ্য দিয়ে শেষ পর্যন্ত বহুত্ববাদী ভারতে বৈচিত্রের মধ্যে ঐক্যকে আরও শক্তিশালী ও প্রসারিত করার লক্ষ্যেই গড়ে উঠেছিল ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্র। অনেক সীমাবদ্ধতা সত্বেও ভারতীয় সংবিধানের এই বৈশিষ্ট্যটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, ইতিবাচক ও প্রগতিমুখী।
‘এক দেশ এক নির্বাচন’-র বিপদ
১৯৭০ 'র দশকে পৃথিবীব্যাপী পুঁজিবাদের নতুন সঙ্কটের পরিপ্রেক্ষিতে ভারতের সমাজ অর্থনীতিতেও সঙ্কট সৃষ্টি হয়। এই সংকট ভারতেও গণতন্ত্র ও যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার ওপর বাধা ও আক্রমণ সংগঠিত করে। এই দশকের মাঝামাঝি সময় থেকে অনেকবার সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় কেন্দ্রীকরণের প্রবণতা শুরু হয়। ১৯৭৫ সালে জারি হয়েছিল অভ্যন্তরীণ জরুরি অবস্থা। তার আগে ১৯৬৭ সালেই প্রথম ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস জাতীয় ও আঞ্চলিক স্তরে প্রথম নির্বাচনী ধাক্কার সম্মুখীন হয়েছিল। এই সময় আটটি রাজ্যে অকংগ্রেসি সরকার তৈরি হয়েছিল। কিন্তু সবকটি সরকার পূর্ণ মেয়াদ টিকে থাকেনি। যেমন পশ্চিমবঙ্গেই পাঁচ বছরের মধ্যে চারটি বিধানসভা নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। অন্যান্য রাজ্যগুলিতেও কমবেশি একই অবস্থা হয়। ফলে ১৯৬৭ পরবর্তী কালে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। আবার ১৯৭৭ সালের পর থেকে রাজ্যগুলিতে পূর্ণ মেয়াদের সরকার চললেও বেশ কয়েকবার ঘনঘন লোকসভা নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। ভারতের মতো বৃহৎ যুক্তরাষ্ট্রের সংসদীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় এটা অত্যন্ত স্বাভাবিক ঘটনা।
২০১৪ সালের আগে পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ে সংসদে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতায় থাকা কেন্দ্রীয় সরকারগুলি সংবিধান সংশোধন করে অধিকাংশ ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় রাজ্যগুলির হাতে থাকা ক্ষমতাকে কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে কেন্দ্রীভূত করার চেষ্টা করেছে। কিন্তু কখনই কেউ জোর করে একটি নির্বাচন প্রক্রিয়ার মধ্যে একসাথে তিনটি স্তরের নির্বাচনকে নিয়ে আসার বিপজ্জনক চেষ্টা করেনি। ২০১৪ সালে একক গরিষ্ঠতায় আরএসএস/ বিজেপি ভারতের শাসন ক্ষমতা দখল করার পর মোদী সরকার এই বিষয়ে উদ্যোগী হয়ে ওঠে। মোদী সরকারের স্থাপনায় ভারতীয় সমাজ সম্পর্কে শতবর্ষ লালিত সংকীর্ণ মতাদর্শ ও রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিকে কার্যকর করার সুযোগ পেয়ে যায় আরএসএস। আরএসএস প্রথম থেকেই ভারতীয় সংবিধানকে অস্বীকার করে, বৈচিত্রের মধ্যে ঐক্য'র বহুত্ববাদী ভারতীয় সমাজ সংস্কৃতিকে মানে না। অতীতে বারবার স্পষ্ট করেই তারা ঘোষণা করেছে গণতান্ত্রিক, যুক্তরাষ্ট্রীয় ভারত রাষ্ট্রের পরিবর্তে তাদের প্রস্তাবিত হিন্দু রাষ্ট্র হবে এককেন্দ্রিক ও কর্তৃত্ববাদী। ২০২০ সালে মোদী ঘোষণা করেন, ওয়ান নেশন ওয়ান ইলেকশন কোনও বিতর্কের বিষয় নয়, এটা ভারতের প্রয়োজনীয়তা। এক জাতি এক নির্বাচন, ভারত বা ভারতবাসীর নয়, আসলে প্রয়োজন আরএসএস/বিজেপি’র।
অষ্টাদশ লোকসভা নির্বাচন ভারতের জনগণ এই উগ্র হিন্দুত্ববাদী, বিকৃত ও জঙ্গি জাতীয়তাবাদী ভাবনাকে প্রত্যাখ্যান করেছেন। বলা বাহুল্য এর মধ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ ধর্ম পরিচয়ের দিক থেকে হিন্দু। আরএসএস/বিজেপি জানে একই সঙ্গে একটি নির্বাচনের মধ্য দিয়ে দেশের লোকসভা, বিধানসভা এবং স্থানীয় স্বায়ত্তশাসনের নির্বাচন করতে গেলে সংবিধানের গুরুতর সংশোধন প্রয়োজন। এই উদ্দেশ্যে সংবিধান সংশোধনের জন্য সংসদে প্রয়োজনীয় গরিষ্ঠতা থেকে বিজেপি’র নেই। তা সত্ত্বেও রাজনৈতিক হিন্দুত্ববাদীরা, বহুত্ববাদের দৃষ্টিভঙ্গি বাতিল করে কর্তৃত্ববাদী সাম্প্রদায়িক রাজনীতির পক্ষে পরিবেশ গড়ে তুলতে মরিয়া। এক জাতি এক ভোট আরএসএস/বিজেপি’র মস্তিষ্কপ্রসূত সন্তান, যা ভারতকে কেন্দ্রীভূত এককেন্দ্রিক রাষ্ট্র গড়ার দিকে নিয়ে যেতে চায়। এক জাতি, এক ধর্ম, এক ভাষা, এক সংস্কৃতি এবং তারপরেই আসবে এক নেতা। এটাই স্পষ্ট ফ্যাসিস্ত দৃষ্টিভঙ্গি। নির্বাচন একটা হবে, কিন্তু সেখানে বৈচিত্রের মধ্যে ঐক্যে কিংবা ভিন্ন মতের কোনও জায়গা কার্যত থাকবে না। সবই একমুখী এবং গণতন্ত্র বিরোধী ও আধিপত্যবাদী।
কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার প্রস্তাব মতো একই সঙ্গে লোকসভা, বিধানসভা এবং পৌরসভা ও পঞ্চায়েত নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে হবে। এতে নাকি খরচ কমবে। ১৯৬৭ সালের পর থেকে এক একটি নির্বাচন এক একটি সময়ে অনুষ্ঠিত হচ্ছে। এমন কোনো তথ্য ও প্রমাণ নেই, যাতে বলা যায় তিনটি নির্বাচন পৃথক পৃথকভাবে অনুষ্ঠিত হবার ফলে উন্নয়নের কাজ ব্যাহত হয়েছে বা হচ্ছে। রইল বাকি খরচের কথা। ২০২৪ সালে সর্বশেষ লোকসভা নির্বাচনে ভারতীয় সংসদ নির্বাচন কমিশনকে মাত্র ৪৬৬ কোটি টাকা নির্বাচনের জন্য বরাদ্দ করেছিল।
রামনাথ কোবিন্দ কমিটির সুপারিশ মতো এক জাতি এক নির্বাচন ব্যবস্থা কার্যকর হলে যদি কোনও মন্ত্রিসভা সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারায়, তাহলে যে নির্বাচন হবে তার কার্যকালের মেয়াদ হবে কেবলমাত্র অবশিষ্ট সময়ের জন্য, কেন্দ্রীয় সরকার বা রাজ্য সরকার উভয় ক্ষেত্রেই। একটি সরকার তার সিদ্ধান্তগুলিকে কার্যকর করতে করতে নির্দিষ্ট সময়ের আগেই পড়ে গেলে বাকি সময়টুকুর জন্য যে সরকার গঠিত হবে, তাতেই বরং উন্নয়নের কাজ ব্যাহত হবে। লোকসভা, বিধানসভা, পৌরসভা কিংবা পঞ্চায়েতের নির্বাচনে একই নির্বাচকমণ্ডলী ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি ও ভাবনায় ভোট দেন, বহুত্ববাদী সমাজে গণতন্ত্রের জন্য যা স্বাভাবিক ও কার্যকরী ব্যবস্থা। কিন্তু তিনটি ভিন্নধর্মী নির্বাচনকে এক ছাঁচে ফেলে দিলে নির্বাচকমণ্ডলীর স্বাধীন ভাবনাকে নিয়ন্ত্রণ করার কর্তৃত্ববাদী পরিবেশ সৃষ্টি হতে বাধ্য।
ভারতের মতো বৃহৎ ও বহুত্ববাদী গণতন্ত্রে পক্ষে এটি অত্যন্ত বিপজ্জনক প্রবণতা হয়ে উঠতে পারে। ধর্মনিরপেক্ষতা, গণতন্ত্র, সাধারণতন্ত্র, বহুত্ববাদ, যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা, সামাজিক ন্যায়ের ধারণা ভারতীয় সংবিধানের মৌলিক ভিত্তি। সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী জাতীয় মুক্তি সংগ্রামের মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠা 'ভারত ভাবনা'র সম্পূর্ণ বিরোধী আরএসএস/বিজেপি ভারতের যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো, ধর্মনিরপেক্ষ গণতন্ত্র ও সামাজিক ন্যায়ের ধারণাকে ধ্বংস করতে চায়।
আক্রান্ত দলিত, নারী, প্রান্তিক মানুষ
কর্পোরেট ও রাজনৈতিক হিন্দুত্ববাদীদের আঁতাতের পরিপ্রেক্ষিতে নরেন্দ্র মোদীর দু’দফার কার্যকলাপ সমাজ, অর্থনীতি, রাজনীতি ও সংস্কৃতিতে ফ্যাসিবাদের পদধ্বনি শুনিয়েছে। আরএসএস ভারতীয় সমাজে ধর্মনিরপেক্ষ গণতন্ত্র ও বহুত্ববাদকে সরিয়ে দিয়ে যে ফ্যাসিবাদ প্রতিষ্ঠা করতে চায় তা একান্তভাবেই ভারতীয় সমাজের বৈশিষ্ট্যযুক্ত। এখানে ভারতীয় ফ্যাসিবাদের আধার ও বৈশিষ্ট্য হলো রাজনৈতিক হিন্দুত্ববাদ। রাজনৈতিক হিন্দুত্ববাদের আঁতুড়ঘর মনুবাদ। মনুবাদ তথাকথিত বর্ণাশ্রম প্রথার মাধ্যমে সামন্ততান্ত্রিক ভারতীয় সমাজে ব্রাহ্মণ্যবাদকে প্রতিষ্ঠা করেছে। ব্রাহ্মণ্যবাদই ভারতীয় সমাজের পুরুষতান্ত্রিকতাকে দৃঢ় ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠা করেছে। শত শত বছর ধরে সামন্ততন্ত্রকে ধরে রেখেছে। আধুনিক পৃথিবীতে সাম্রাজ্যবাদবিরোধী সংগ্রামের মধ্য দিয়ে ভারতীয় সমাজে আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গির প্রসার ঘটলেও, পুঁজিবাদের বিকাশ ঘটলেও, বলার অপেক্ষা রাখে না যে আজও ভারতীয় সমাজের মূল প্রবণতা সামন্ততন্ত্র, পুরুষতন্ত্র ও ব্রাহ্মণ্যবাদ। এই সমাজ কাঠামোতে রাজনৈতিক হিন্দুত্ববাদীদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠার অন্যতম হাতিয়ার দলিত, সংখ্যালঘু ও নারীদের উপর শারীরিক ও মানসিক ভাবে আক্রমণ সংগঠিত করা। নরেন্দ্র মোদীর দশ বছরের শাসনকালে নারী নির্যাতন রাজনৈতিক আধিপত্য প্রতিষ্ঠার অন্যতম হাতিয়ারের পরিণত হয়েছে। নারীদের উপর অত্যাচার ও যৌন নিপীড়নের ঘটনা উত্তরোত্তর বেড়ে চলেছে। অত্যাচারীদের দমনের পরিবর্তে বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলিতে তাদের মাথায় করে রাখা হয়েছে।
তেরো বছর ধরে পশ্চিমবাংলায় সরকারে প্রতিষ্ঠিত তৃণমূল কংগ্রেস রাজনৈতিক হিন্দুত্ববাদের জন্যই পরোক্ষে কাজ করে চলেছে। এখানেও নারীদের উপর অত্যাচার ও যৌন নিপীড়নের ঘটনাগুলি সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করছে। কলকাতার আর জি কর মেডিক্যািল কলেজ ও হাসপাতালে পিজিটি ছাত্রীর উপর নৃশংস অত্যাচার ও খুনের ঘটনার বিরুদ্ধে প্রবল বিক্ষোভ ও প্রতিবাদের মধ্যেই প্রায় প্রতিদিনই পশ্চিমবাংলার কোথাও না কোথাও নারীদের উপর অত্যাচার ও নিপীড়নের ঘটনা ঘটছে। আরএসএস প্রধান মোহন ভগবত কলকাতায় এসে আর জি কর ইস্যুতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারকে ক্লিনচিট দিয়ে যাওয়ার ঘটনা শুধুমাত্র আরএসএস/বিজেপি ও তৃণমূল কংগ্রেসের মামুলি বোঝাপড়া নয়। সারা ভারতে দলিত, সংখ্যালঘু, আদিবাসী ও নারীদের উপর অত্যাচারের যে প্রক্রিয়ায় পুরুষতান্ত্রিকতা ও ব্রাহ্মণ্যবাদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হচ্ছে, পশ্চিমবাংলার ঘটনাগুলিও একই সূত্রে বাঁধা। নারী নির্যাতন এখন যুক্তিবিনাশী প্রতিক্রিয়াশীল রাজনীতির অন্যতম প্রধান হাতিয়ার। পশ্চিমবঙ্গ আজ তার ব্যতিক্রম নয়। এই হাতিয়ারকে ব্যবহার করে তৃণমূল কংগ্রেস রাজ্যে রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নকে ধরে রেখেছে।
গণশত্রুদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে মানুষ
আর জি কর মেডিক্যাইল কলেজ ও হাসপাতালে পিজিটি ছাত্রীর ওপর নৃশংস অত্যাচার ও খুনের প্রতিবাদে তিন মাস ধরে পশ্চিমবাংলার জনগণ প্রতিবাদী আন্দোলনে রয়েছেন। তেরো বছরে পশ্চিমবাংলায় তৃণমূল কংগ্রেসের শাসনে থ্রেট কালচার প্রতিষ্ঠা ও দৃঢ় করা হয়েছে। আর জি করের ঘটনায় প্রতিবাদ আসলে তার বিরুদ্ধে মানুষের পুঞ্জীভূত ক্ষোভের বারুদ স্তুপে একটি আগুনের স্ফুলিঙ্গ। চলমান এই আন্দোলনে অংশ নিয়ে রাজ্যের সাধারণ মানুষ দিন-প্রতিদিন উপলব্ধি করতে পারছেন আধিপত্যবাদী মতাদর্শ, রাজনীতি ও রাষ্ট্র ব্যবস্থার নিরিখে আরএসএস/বিজেপি ও তৃণমূল কংগ্রেস আসলে একই জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে। তাই প্রতিবাদী মানুষ উৎসবের মধ্যেও আন্দোলনে ছিলেন। ন্যায়বিচার ছিনিয়ে আনার মানসিকতায় আন্দোলনের মধ্যেই মানুষ রয়েছেন। গণতন্ত্রের আকাঙ্ক্ষার জন্য এই আন্দোলনে থাকতে থাকতেই সাধারণ মানুষকে জীবন-জীবিকার আন্দোলনের কথা ভাবতেই হবে। না হলে এই সুযোগকে ব্যবহার করে আরএসএস/বিজেপি ও তৃণমূল কংগ্রেস, সবমিলিয়ে কর্পোরেটের স্বার্থবাহী ক্ষমতাসীন দক্ষিণপন্থী শক্তি মানুষের জীবনকে আরও দুর্বিষহ করে তুলবে। আজকের দিনে স্বৈরাচার, আধিপত্যবাদ যে নাম, ঢং কিংবা রঙেই আসুক না কেন, আসলে তা কর্পোরেটের স্বার্থে লুটতন্ত্রকে সুরক্ষিত রাখতেই সক্রিয়। আরএসএস/বিজেপি ও তৃণমূল কংগ্রেস শাসন ক্ষমতায় থেকে সব মানুষকে ভাত দেওয়ার ক্ষমতা নেই, অথচ কর্পোরেটের স্বার্থে কিল মারার গোঁসাইগিরি করছে। এই গণশত্রুদের বিরুদ্ধে খেটেখাওয়া ভুক্তভোগী মানুষকে যুক্ত করে যথাসম্ভব সর্ববৃহৎ ঐক্য গড়ে তুলে সর্বাত্মক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে।
Comments :0