Editorial

ব্যর্থতার ধারাবাহিকতা

সম্পাদকীয় বিভাগ

পহেলগামে জঙ্গি হামলার সময় ত্রিসীমানায় কোথাও কোনও নিরাপত্তা কর্মী না থাকলেও এবং ঘটনা ঘটে যাবার পর ঘটনাস্থলে নিরাপত্তা বাহিনীর হাজির হতে প্রায় এক ঘণ্টা লেগে গেলেও ঘটনার অব্যবহিত পরেই সন্দেহজনক তিন জঙ্গির নিখুঁত ছবি প্রকাশ করে দিয়েছে নিরাপত্তা বাহিনী। তারপর এক সপ্তাহ কেটে গেলেও সেই সন্দেহজনক জঙ্গিদের অবস্থান ও গতিবিধি সম্পর্কে কিছুই জানতে পারেনি। অথচ স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে অন্য মন্ত্রীরা এবং বিজেপি’র নেতারা সন্ত্রাসবাদীদের নিশ্চিহ্ন করে দেবার হুঙ্কার ছেড়ে যাচ্ছেন প্রতিদিন। দুর্ভাগ্যের হলেও তদন্তের কাজে অগ্রগতি সম্পর্কে ন্যূনতম কোনও আশ্বাসও মিলছে না সরকারি কর্তাদের কাছ থেকে। তাহলে কি এটাই ধরে নিতে হবে জঙ্গিরা এতটাই নিখুঁত পরিকল্পনা করে কাজ করছে যে তার ধারে কাছে পৌঁছাতে পারছে না নিরাপত্তা বাহিনী। তারা কোথা থেকে কীভাবে বৈসরণ ভ্যালিতে পৌঁছালো, কোথায় থাকল, হামলার পর কোথায় গা ঢাকা দিল বা কোন পথে সীমান্ত পার হলো তার স্পষ্ট কোনও ধারণা বা প্রমাণ দেশবাসী এখনও জানতে পারল না। যদি জঙ্গিদের হদিশই না মেলে তাহলে তাদের সাজা হবে কীভাবে? এই অবস্থায় ক্রমাগত তারস্বরে হুঙ্কার ছাড়া অনেকটা ফাঁকা আওয়াজ হচ্ছে না তো।
জঙ্গিরা তাদের লক্ষ্য পূরণ করে চলে গেছে। কিন্তু শত শত কোটি টাকা খরচ করে গোটা কাশ্মীর জুড়ে কয়েক লক্ষ সেনা মোতায়েন করে নিরাপত্তার জাল বিছিয়ে রাখার পর জঙ্গিরা পাকিস্তান থেকে সীমান্ত পেরিয়ে ভারতে ঢুকলো কি করে। অরক্ষিত বা নজরদারির ঢিলেমি অবশ্যই ছিল। ভারতে ঢোকার পর দীর্ঘ সময় ও দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে বহু দূরে অবস্থিত পহেলগামে পৌঁছে গেল কেউ টের পেল না। সেখান থেকে এত বড় ভয়ঙ্কর হত্যাকাণ্ড ঘটালো অথচ কোনও গোয়েন্দা সূত্র তার নাগাল পেল না। এমন অদক্ষতা, সীমাবদ্ধতা ও ব্যর্থতা একবারের জন্যও কবুল করতে দেখা যায়নি কেন্দ্রীয় কর্তাদের। ব্যর্থতা আড়াল করে শুধু হুঙ্কার ছেড়ে জঙ্গিদের মোকাবিলা করা যায়। এতে বরং জঙ্গিরা বাড়তি অক্সিজেন পায়। ক্ষমতার দম্ভ আত্মতুষ্টির জন্ম দেয়। কাশ্মীরে জঙ্গি দমনে ব্যর্থতার পর ব্যর্থতার পর শূন্যগর্ভ হুঙ্কার আত্মতুষ্টিজনিত ব্যর্থতা নয়তো।
আজ পর্যন্ত কাশ্মীরে যত ধরনের এবং যত বড় আকারের জঙ্গি হামলা হয়েছে পহেলগামের ঘটনা সব দিক থেকেই অভাবনীয়। পুলিশ-মিলিটারি, সরকারি আধিকারিক, রাজনৈতিক নেতা, এমনকি পরিযায়ী ও স্থানীয় মানুষ জঙ্গিদের লক্ষ্য ছিল। কিন্তু পর্যটকরা কখনোই লক্ষ্যবস্তু ছিল না। পহেলগামে সেই ধারা বদলে গেছে। ফলে এই ঘটনা গোটা দেশের হৃদয়কে উথাল পাথাল করে দিয়েছে। মানুষ চাইছেন কঠোর সাজা এবং এই ঘটনার পুনরাবৃত্তি বন্ধ করা। তারজন্য সমস্ত সরকারি ও রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাকে সমন্বিত করে গোটা দেশের জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করে যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়া। দেশবাসীকে একজোট করার ক্ষেত্রে সর্বাগ্রে প্রয়োজন ছিল সর্বদলীয় বৈঠক। সেটা সরকার করেছে। কিন্তু সেই বৈঠকের গুরুত্ব যে সরকারের কাছে বিশেষ ছিল না তা স্পষ্ট হয়ে যায় প্রধানমন্ত্রী তাতে হাজির না থাকায়। এমন কঠিন সময়ে সর্বদলীয় বৈঠকে হাজির থাকার থেকে প্রধানমন্ত্রী বেশি গুরুত্বপূর্ণ মনে করেছেন ভোটমুখী বিহারে জনসভায় ভাষণ দিতে যাওয়াকে। কেন বিহারের সভা এতটা গুরুত্ব পেল প্রধানমন্ত্রীর কাছে?
দুর্জনেরা বলছে মোদী সংখ্যালঘু কেন্দ্রীয় সরকার দাঁড়িয়ে আছে নীতীশ, চন্দ্রবাবুর হাত ধরে। আসন্ন ভোটে যদি নীতীশের সঙ্গে জোট সরকার যদি হেরে যায় তবে কেন্দ্রে মোদীর সরকার বিপন্ন হয়ে যেতে পারে। তাই সব ছেড়ে মোদীকে দৌড়াতে হয়েছে বিহারের জনসভায়। লক্ষ্য পহেলগামে জঙ্গি হামলায় ২৬টি মৃত্যুকে পুঁজি করে চড়া সুরে সাম্প্রদায়িক বিভাজন করা এবং উগ্র জাতীয়তাবাদের হাওয়া তোলা। কাশ্মীরে গোয়েন্দা ব্যর্থতা ও নিরাপত্তা বিপর্যয় অতি সঙ্কীর্ণ ক্ষমতার রাজনীতির মানসিকতার পরিণতি নয়তো। পুলওয়ামায় এবং উরিতে এমন ব্যর্থতা এখনো আমাদের তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে।

 

Comments :0

Login to leave a comment