Bombay High court

নির্বাচন বন্ড নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের পরে বম্বে হাইকোর্টে জোর ধাক্কা খেল মোদী সরকার

জাতীয়

 মত প্রকাশের স্বাধীনতা কেড়ে নিতে গিয়ে আদালতে জোরালো ধাক্কা খেল মোদী সরকার। দেশের তথ্য প্রযুক্তি বিধির ২০২৩ সালের সংশোধনীকে অসাংবিধানিক বলে খারিজ করে দিল বম্বে হাইকোর্ট। সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে ‍‌(সোস্যাল মিডিয়া) সরকার-বিরোধী পোস্ট ও সরকারের সমালোচনার মুখ বন্ধ কর‍‌তে ২০২১ সালের তথ্য প্রযুক্তি বিধিতে এই সংশোধনী এনেছিল মোদী সরকার। ও‍‌ই সংশোধনীতে সরকার সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে উপস্থাপিত ‘ভুয়ো, মিথ্যা ও বিভ্রান্তিকর’ তথ্যকে চিহ্নিত করার জন্য ‘ফ্যাক্ট চেক ইউনিট’ গঠনের ক্ষমতা হাতে নিয়েছিল। বিরোধী দলগুলি তখনই ব‍‌লেছিল, মোদী সরকারের সমালোচনাকে ‘ভুয়ো, মিথ্যা ও বিভ্রান্তিকর’ বলে দাগিয়ে দিয়ে সোস্যাল মিডিয়া থেকে মুছে ফেলা এবং বিরোধিতার কণ্ঠরোধ করাই এই ইউনিট গঠনের লক্ষ্য। বম্বে হাইকোর্টের শুক্রবারের রায়ে তাকেই কার্যত স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে।
এদিনের রায়ে হাইকোর্ট বলেছে, সরকারের সংশোধনী সংবিধানের তিনটি ধারাকে লঙ্ঘন করছে। এগুলি হলো ১৪ নম্বর ধারা (সমতার অধিকার), ১৯(১)(এ) নম্বর ধারা (বাক স্বাধীনতার অধিকার) এবং ১৯(১)(জি) নম্বর ধারা (পেশা বেছে নেওয়ার স্বাধীনতার অধিকার)। লোকসভা নির্বাচনের আগে সুপ্রিম কোর্ট যখন মোদী সরকারের নির্বাচনী বন্ড প্রকল্পকে অসাংবিধানিক বলে খারিজ করে দিয়েছিল, তখনও ওই প্রকল্প বাক স্বাধীনতার অধিকারের পরিপন্থী বলে রায় দিয়েছিল, যা নাগরিকদের অন্যতম সাংবিধানিক মৌলিক অধিকার। নির্বাচনী বন্ড প্রকল্পে রাজনৈতিক দলগুলির তহবিলে অর্থদাতাদের নাম গোপন রাখার যে ব্যবস্থা করেছিল মোদী সরকার, তাকেই বাক স্বাধীনতার অধিকার লঙ্ঘনকারী বলে অভিহিত করেছিল শীর্ষ আদালত। শুক্রবার তথ্য প্রযুক্তি বিধির সংশোধনী নিয়ে মামলাতেও সেই বাক স্বাধীনতার অধিকার লঙ্ঘনের দায়ে আদালতের রায় কাঠগড়ায় দাঁড় করালো মোদী সরকারকে। এদিন এই রায় দিয়েছেন বম্বে হাইকোর্টের বিচারপতি এ এস চান্দুরকর, যিনি এই মামলায় ছিলেন আদালতের পরিভাষায় ‘টাইব্রেকার’ বিচারপতি। 
বম্বে হাইকোর্টে তথ্য প্রযুক্তি বিধির ২০২৩ সালের সংশোধনীর বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেছিলেন স্ট্যান্ড-আপ কমেডিয়ান কুনাল কামরা ও অন্যান্যরা। নিজের ইউটিউব চ্যানেলে ব্যঙ্গাত্মক ভঙ্গিতে নরেন্দ্র মোদী এবং মোদী সরকারকে কটাক্ষ করার জন্য কুনাল কামরা যেমন বিপুল জনপ্রিয়, তেমন বিজেপি-আরএসএস’র চক্ষুশূল। মোদী সরকার, বিজেপি এবং আরএসএস’র বিরুদ্ধে প্রচারে সোস্যাল মিডিয়া তাঁর সঙ্গে আরও অনেকের কাছেই বড় হাতিয়ার, বিশেষত মূল স্রোতের প্রচার মাধ্যমের সিংহভাগ যখন ‘গোদী মিডিয়া’য় পরিণত হয়েছে ২০১৪’র পর থেকেই। তথ্য প্রযুক্তি বিধিকে হাতিয়ার করে সেই সব সমালোচনা, বিরোধিতা ও কটাক্ষর কণ্ঠরোধ করতে চেয়েছিল মোদী সরকার। তার বিরুদ্ধে মামলায় বম্বে হাইকোর্টের ডিভিসন বেঞ্চ বিভাজিত রায় দিয়েছিল। ডিভিসন বেঞ্চের দুই সদস্যের অন্যতম বিচারপতি জি এস প্যাটেল ওই সংশোধনীর বিরুদ্ধে রায় দিয়েছিলেন। কিন্তু আরেক সদস্য বিচারপতি নীলা গোখেল রায় দেন সংশোধনীর পক্ষে। তখন হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি ডি কে উপাধ্যায় ‘টাইব্রেকার’ বিচারপতি হিসাবে মামলাটির নিষ্পত্তির দায়িত্ব দেন বিচারপতি চান্দুরকরকে। 
শুধু সোস্যাল মিডিয়া ব্যবহারকারী নন, এই সংশোধনীর মধ্য দিয়ে মোদী সরকার সেগুলির কর্তৃপক্ষকেও কার্যত হুমকি দিয়েছিল। বলা হয়েছিল, সোস্যাল মিডিয়ার পোস্ট পরীক্ষা করার জন্য সরকার যে ফ্যাক্ট চেক ইউনিট গঠন করবে, সেই ইউনিট যদি কোনও পোস্টকে ভুয়ো বা মিথ্যা বা বিভ্রান্তিকর বলে চিহ্নিত করে, তাহলে তা জানিয়ে দেওয়া হবে সংশ্লিষ্ট সোস্যাল মিডিয়ার কর্তৃপক্ষকে। সেক্ষেত্রে ওই কর্তৃপক্ষকে হয় পোস্টটি মুছে দিতে হবে অথবা কর্তৃপক্ষ তার দায় অস্বীকার করে বিবৃতি (ডিসক্লেইমার) দেবে। কিন্তু কর্তৃপক্ষ যদি দ্বিতীয়টি বেছে নেয়, তাহলে সরকার তার বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নিতে পারবে। স্পষ্টতই এর মধ্য দিয়ে বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছিল যে, মোদী সরকারের অপছন্দের পোস্ট সরিয়েই দিতে হবে সোস্যাল মিডিয়া থেকে। মামলায় বিচারপতি চান্দুরকরের এজলাসে আ‍‌বেদনকারীদের পক্ষে সওয়ালে দুই আইনজীবী নওরোজ সীরবাই এবং অরবিন্দ দাতার বলেন, এই ইউনিট কোনও পোস্টকে ভুয়ো বা মিথ্যা বা বিভ্রান্তিকর বলে চিহ্নিত করলে কোনও আবেদন জানানোর সুযোগ সংশোধনীতে রাধা হয়নি। একমাত্র উপায় থাকবে আদালতে রিট আবেদন পেশ করা। এমনকী ভুয়ো বা মিথ্যা বা বিভ্রান্তিকর তথ্যের কোনও সুনির্দিষ্ট সংজ্ঞাও দেওয়া হয়নি সংশোধনীতে। এর অর্থ, সরকার যে আলোচনাকে চেপে দিতে চায়, তার উপরে রাষ্ট্রীয় সেন্সরশিপ চাপিয়ে দেওয়ার লক্ষ্যেই ফ্যাক্ট চেক ইউনিট গঠনের কথা বলা হয়েছে। সরকার-বিরোধী যে কোনও পোস্টকেই ভুয়ো বা মিথ্যা বা বিভ্রান্তিকর বলে দাগিয়ে দেওয়ার অবাধ ক্ষমতা হাতে নিয়েছে সরকার নিজেই।
পালটা সওয়ালে কেন্দ্রের তথ্য ও প্রযুক্তি মন্ত্রকের তরফে সলিসিটর জেনারেল তুষার মেহতা দাবি করেন, সঠিক তথ্য জানা জনগণের অধিকারের মধ্যে পড়ে। সরকারের কাজকর্ম সম্পর্কে সোস্যাল মিডিয়ায় সঠিক তথ্যকে সুনিশ্চিত করতেই ফ্যাক্ট চেক ইউনিট গঠন করার কথা বলা হয়েছে, যাতে ভুয়ো তথ্য থেকে জনগণের সম্ভাব্য ক্ষতিকে নিয়ন্ত্রণ করা যায়। কিন্তু বিচারপতি চান্দুরকর এই বক্তব্য গ্রহণ করেননি। তিনি রায়ে বলেছেন, সংশোধনীতে ‘ভুয়ো, মিথ্যা ও বিভ্রান্তিকর’ তথ্যের কোনও নির্দিষ্ট সংজ্ঞা দেওয়া হয়নি। ফলে এই সংক্রান্ত ধারাটি অস্পষ্ট ও ভুল। এই সংশোধনীতে সংবিধানের ২১ নম্বর ধারাকেও লঙ্ঘন করা হয়েছে, যা নাগরিকদের জীবন ও ব্যক্তিগত স্বাধীনতার অধিকারকে সুনিশিচ্ত করেছে।

 

 

 

Comments :0

Login to leave a comment