জ্ঞানের আলোয় আলোকিত হোক প্রাণ- সেই আলোই গত পাঁচ বছর ধরে জ্বালিয়ে আসছেন অযোধ্যা পাহাড়ের প্রত্যন্ত এক গ্রামের আদিবাসী গৃহবধূ মালতি মুর্মু। বিয়ের পর গ্রামে এসে দেখেছিলেন শিক্ষার হার খুবই খারাপ। উচ্চমাধ্যমিক পাস সেই তরুণী এখন গ্রামে নিজের উদ্যোগেই খুলেছেন স্কুল। সম্পূর্ণ বিনা পয়সায় গ্রামের শিশুদের সেখানে লেখাপড়া শেখান। ১০০ শতাংশ সাঁওতাল সম্প্রদায়ের মানুষ বসবাস করলেও গ্রামে যে প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে সেটি বাংলা মাধ্যমের। তাই শিশুদের তিনি শেখান মাতৃভাষা- অলচিকি ভাষা। পাশাপাশি বাংলা ইংরেজি ও পড়ান। কোন সরকারি সাহায্য ছাড়াই নিজেদের উদ্যোগে চলছে পুরুলিয়ার অযোধ্যা পাহাড়ের জিলিনসেরেং গ্রামে মালতির পাঠশালা। গ্রামবাসীরাও মালতি মুর্মুর এই সাধু উদ্যোগের পাশে দাঁড়িয়েছেন।
অযোধ্যা পাহাড়ের একেবারে প্রত্যন্ত পাহাড়ি গ্রাম জিলিংসেরেং। সেখানেই মাটির একটি ঘরের থেকে শিক্ষার আলো জ্বালাচ্ছেন এক আদিবাসী গৃহবধূ। এই কাজের উৎসাহ নিজেই নিজের মধ্যে খুঁজে পেয়েছিলেন। পাশে পেয়েছেন স্বামীকে। পাশে পেয়েছেন গ্রামবাসীদের। মনের জোরে এলাকার শিশুদের দিচ্ছেন প্রাথমিক শিক্ষার পাঠ। বর্তমানে এলাকার মানুষের কাছে শিক্ষার অন্যতম ভরসা হচ্ছেন মালতী মুর্মু। তিনি জানিয়েছেন ২০১৯ সালে গ্রামে বিয়ে হয়ে আসার পর দেখেছিলেন অধিকাংশ শিশুই বিদ্যালয়ে যায় না। স্বামীকে নিয়ে ঝুপড়ি ঘরে শুরু করেছিলেন স্কুল। গ্রামবাসীরা ও সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল। তারাই উদ্যোগ নিয়ে সে ঘরে মাটির দেয়াল তুলে দিয়েছেন। এখন সেখানে ৪৫ জন শিশু সকালবেলা আসে পড়াশোনা করতে। চতুর্থ শ্রেণি অব্দি পড়াশোনা করানো হয়। চার বছরের ছেলে এবং দেড় মাসের আরেকটি ছেলে রয়েছে তার। সংসারের কাজ সামলে, বাচ্চা সামলে শিক্ষাদানে তার কোন ঘাটতি নাই। সেটাই হচ্ছে তার বেঁচে থাকার অক্সিজেন। সংসারের কাজ সামলেও শুধুমাত্র গ্রামের শিশুদের শিক্ষার আলো দানের উদ্দেশ্যেই লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন মালতি মুর্মু। তার একটাই কথা গ্রামের শিশুরা যেন কেউ নিরক্ষর না হয়। সকালে তার কাছে ক্লাস করেই শিশুরা চলে যায় বিদ্যালয়ে।
সাঁওতালি মাধ্যমে আদিবাসী পড়ুয়াদের শিক্ষাদান করে চলেছেন উচ্চ মাধ্যমিক পাস এই গৃহবধূ। এই কাজে পাশে পেয়েছেন স্বামী বাঁকা মুর্মু কে। বাঁকা মুর্মু জানিয়েছেন পঞ্চম শ্রেণীর পর সেখানে অধিকাংশই স্কুল ছেড়ে দেয়। নিকটবর্তী স্কুল বলতে ১০/১২ কিলোমিটার দূর। জঙ্গলের পথ পেরিয়ে অনেকেই আর স্কুলে যায় না। পড়াশোনার দিক থেকে তাদের গ্রাম এখনো অনেকটা পিছিয়ে রয়েছে। নিজের মাতৃভাষাও কেউ শেখেনা। তাই নিজেদের উদ্যোগে পকেটের পয়সা খরচ করে ঝাড়গ্রাম থেকে অলচিকি ভাষার বই কিনে শিশুদের দিয়ে তার মাতৃভাষার সাথে পরিচয় করান মালতি মুর্মু। পাশাপাশি বাংলা ইংরেজি এবং অন্যান্য বিষয়েও পড়ান তার স্ত্রী। এই কাজে সম্পূর্ণ সহমত রয়েছে তার। স্পষ্ট কথা তার- কিছুতো ভালো কাজ করি। গ্রামে প্রাথমিক বিদ্যালয় থাকলেও শিক্ষাকে আরও এগিয়ে নিয়ে যেতে মালতি মুর্মুর এই উদ্যোগকে সাধুবাদ জানিয়েছেন গ্রামের সবাই। স্থানীয় বাসিন্দা সুনীতা মান্ডি জানিয়েছেন ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা নিয়মিত শিক্ষা পাচ্ছে। আমরাও চাই এই পাঠদান নিয়মিত চলুক। ভালো কাজ করছে। তিনি জানিয়েছেন লকডাউনের সময় যখন সমস্ত কিছু বন্ধ হয়ে গিয়েছিল তখন এই শিশুগুলোকে পড়াশুনো ভুলতে দেয়নি। নিয়মিত তাদেরকে পড়াশোনা করিয়েছে সে। গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক অনাদি টুডু জানিয়েছেন যে গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয় অলচিকি পড়ানো হয় না। গ্রামের ওই মহিলা নিজের উদ্যোগে যেভাবে শিশুদের পাশে দাঁড়িয়ে তাদের নিয়মিত পড়াশোনা শেখাচ্ছে তা সত্যি সাধুবাদ যোগ্য।
Malati Murmu
ব্যক্তিগত উদ্যোগে আদিবাসী পড়ুয়াদের শিক্ষাদান গৃহবধূ মালতি মুর্মু’র

×
Comments :0