পহেলগামে সন্ত্রাসবাদী হামলার পরে পাকিস্তানের সঙ্গে ভারতের যে সংঘাতের ঘটনা ঘটেছে সেই পরিপ্রেক্ষিতে আন্তর্জাতিক স্তরে সর্বদলীয় প্রতিনিধিদল পাঠানোর যে সিদ্ধান্ত ভারত সরকার নিয়েছে তার যৌক্তিকতা নিয়ে কোনও মহলেই কোনও সন্দেহ থাকার কথা নয়। বস্তুত, যুদ্ধজিগিরের পরিবর্তে যে কূটনৈতিক উদ্যোগের প্রয়োজনীয়তার কথা বামপন্থীরা সহ দেশের বিচক্ষণ বিশেষজ্ঞরা আগে থেকেই বলছিলেন এই পদক্ষেপ তারই অনুসারী। অর্ধশতাধিক প্রতিনিধিকে নিয়ে ৩২টি দেশে এবং আন্তর্জাতিক ফোরামে ভারতের বক্তব্য তুলে ধরার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। কিন্তু একই সঙ্গে বামপন্থীরা এবং বিরোধী দলগুলি বর্তমান পরিস্থিতিতে বারবার প্রধানমন্ত্রীর উপস্থিতিতে যে সর্বদলীয় বৈঠক ডাকার এবং সংসদের বিশেষ অধিবেশন ডাকার দাবি জানিয়ে আসছিল তা এখনও অবধি উপেক্ষিতই থেকে গেছে। সরকার একতরফাভাবে নিজের মতো করে সাংসদ বেছে নিয়ে প্রতিনিধিদল বানিয়েছে। ফলে সাধু উদ্যোগেও মোদী সরকারের মনোভাব এবং জাতীয় ঐক্য গড়ে তোলায় সদিচ্ছার অভাব ফুটে উঠেছে।
পহেলগামের ঘটনা শুধু সন্ত্রাসবাদের বর্বরতা ও বিপদকেই দেখিয়ে দেয়নি, ভারত সরকারের নিরাপত্তা ও ইনটেলিজেন্স ব্যবস্থায় গাফিলতিকেও দেখিয়ে দিয়েছে। এরপরে সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য ভিত্তিক পরিমিত সেনা অভিযানের সময় দেশবাসীর সমর্থন থাকলেও বিশ্বের দরবারে ভারতের একাকীত্ব মোদী সরকারের বিদেশনীতির ব্যর্থতাকেও দেখিয়ে দিচ্ছে। সাম্রাজ্যবাদের হোতা আমেরিকার রাষ্ট্রপতি ট্রাম্প যেভাবে সংঘর্ষবিরতিতে দাদাগিরি দেখিয়েছেন সেটাও মোদীর দুর্বলতাকে প্রকট করে দিয়েছে। মোদী বারবার ট্রাম্পকে বন্ধু হিসাবে চিহ্নিত করলেও দেখা গেলো, সেই ট্রাম্পের মদতেই পাকিস্তান আইএমএফ থেকে বিপুল অনুদানের ছাড় পেয়ে গেলো, মোদী তুরস্কের বিরুদ্ধে হুঙ্কার ছাড়লেও আমেরিকা সেই তুরস্ককেই বিপুল অস্ত্র বিক্রির সিদ্ধান্ত ঘোষণা করল। অর্থাৎ মোদী যাকে বন্ধু হিসাবে দেখেছেন সেই আমেরিকা নিজের স্বার্থপূরণ ছাড়া ভারতের পাশে আদৌ নেই, অন্যদিকে ভারতের দীর্ঘদিনের বন্ধুরাও ভারতের পাশ থেকে দূরে সরে গেছে। গত এক দশকে মোদীর নেতৃত্বে ভারত সরকার জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনের সম্মেলন এবং কর্মসূচির থেকে নিজেকে সম্পূর্ণ রূপে সরিয়ে নিয়ে আমেরিকার শিবিরের কাছে আত্মসমর্পণ করায় আন্তর্জাতিক দুনিয়ায় ভারতের বিশ্বাসযোগ্যতায় আঘাত লেগেছে। যে সমস্ত তৃতীয় বিশ্বের দেশ জোট নিরপেক্ষ নীতি অবলম্বন করেছিল তারা ভারতের থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে অন্য বৈদেশিক শক্তিদের আরও কাছাকাছি ঘেঁষতে একপ্রকার বাধ্য হয়েছে। সারা দুনিয়াতে সব দেশ নিজেদের অর্থনৈতিক বৃদ্ধি ও জাতীয় সুরক্ষার জন্য আঞ্চলিক সহযোগিতার ওপরে জোর দিচ্ছে, অথচ ভারত সার্ক’কে নিষ্ক্রিয় করে রেখে প্রতিবেশী দেশগুলির থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলেছে। ফলে কাশ্মীর সহ ভারত পাকিস্তানের দ্বিপাক্ষিক বিষয়েও এখন আমেরিকা নাক গলানোর সুযোগ পেয়ে যাচ্ছে। জাতীয় সুরক্ষার জন্য সামরিক শক্তির মতোই জরুরি প্রতিবেশী দেশগুলির সঙ্গে সুসম্পর্ক রাখা, আন্তর্জাতিক সম্পর্কের প্রাথমিক পাঠ জানা ছাত্র-ছাত্রীরাও এটা জানেন। কিন্তু মোদী সরকার সেটাকেই অবহেলা করেছে।
সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলায় যুদ্ধ কোনও সমাধান নয়, তার জন্য বহুমুখী উদ্যোগ লাগে, কূটনৈতিক সক্রিয়তা দেখাতে হয়, বিদেশের মাটিতে সন্ত্রাসবাদীদের শিকড় আলগা করে দিতে কূটনৈতিক চাপ সৃষ্টি করতে হয়। বিলম্বে হলেও সেই বাধ্যবাধকতার বোধোদয় থেকে থেকে যদি মোদী সরকার বিদেশে সর্বদলীয় প্রতিনিধিদল পাঠানোর উদ্যোগ নিয়ে থাকে তাহলে সেটা অবশ্যই আশাব্যঞ্জক। এই কারণেই সিপিআই(এম) এই প্রতিনিধিদলে অংশ নিয়ে আন্তর্জাতিক স্তরে জাতীয় স্বার্থে কথা বলার ঘোষণা করেছে। জটিল ও কঠিন পরিস্থিতিতে দেশের প্রতি সিপিআই(এম)’র এই কর্তব্যপালন বামপন্থীদের আদর্শনিষ্ঠ দেশপ্রেমিক রাজনীতির নিদর্শন। আন্তর্জাতিক আঙিনায় বামপন্থীরা কর্তব্যে অবিচল থাকলেও, দেশের ভিতরে যুদ্ধোন্মাদনা ও সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে রাস্তায় নেমে সোচ্চার হওয়ার জন্য এই বামপন্থীদেরই উগ্র জাতীয়তাবাদীরা সবচেয়ে বেশি নিশানা করেছে, গুরুতর হেনস্তা করে চলেছে। সর্বদলীয় প্রতিনিধিদলে শামিল হয়ে সিপিআই(এম) এই উগ্র জাতীয়তাবাদী মিথ্যা প্রচারকারীদের গালেও থাপ্পড় কশালো। জটিল সময়ে জাতি ধর্ম ভাষা নির্বিশেষে জাতীয় ঐক্যের প্রয়োজনীয়তাও আরেকবার জোরালোভাবে তুলে ধরলো।
Editorial
জাতীয় ঐক্য নিয়েও মোদীর অসাধু রাজনীতি

×
Comments :0