Bogtui

কাস্তে হাতুড়ি আঁকা টুপি পড়ে নিলেন কালাম শেখ

জেলা রাজ্য

মাথার ছাউনি যেটুকু ছিল, আজ তাও নেই। দেওয়ালে কালো ক্ষত জ্বলজ্বল করছে এখনও। হাড়হিম করা নৃশংসতার আঘাতে পুরো বাড়ি ধ্বংসের প্রতীক হয়ে আছে বগটুই গ্রামে। সেই বাড়ির সামনে দিয়ে লাল ঝান্ডা নিয়ে পদযাত্রা এগতেই ঠিক তার পাশের বাড়ি থেকে বেরিয়ে এলেন পুরুষ-মহিলারা। পদযাত্রীদের উদ্দেশ্যে হাত তুললেন। এক গাল হাসি নিয়েই পদযাত্রীরাও শুভেচ্ছা বিনিময় করলেন।
বাড়িটি বাণিরুল শেখের। এই বাড়িতেই ঘটে যাওয়া ২১ মার্চের পাশবিক হত্যাকাণ্ড স্তম্ভিত করেছিল রাজ্যবাসীকে। বাণিরুল শেখ হারিয়ে ছিলেন তাঁর মা, মেয়ে, জামাই সহ দশ স্বজনকে। শাসক সন্ত্রাসের ভরকেন্দ্র সেই বগটুইয়েই এদিন লাল ঝান্ডার পদযাত্রা হয়েছে অলিতে গলিতে। গত দশ-বারো বছরে যা প্রায় সেই ভাদু শেখদের দৌরাত্ম্যে ‘নিষিদ্ধ’ ছিল। 
পরিস্থিতি পাল্টেছে। প্রমাণ দিয়েছে বৃহস্পতিবারের সকাল। লাল ঝান্ডা হাতে অনেক পায়ের ভিড় ঘুরেছে বগটুইয়ের অলিগলি। যার সামনে থাকা কাঁসর ঢোলের বোলে মুখরিত হয়েছে গোটা বগটুই। 

 


শুধু বগটুই নয়, সেখান থেকে কুমাড্ডা, চন্দনকুন্ঠা, দেখুড়িয়া পর্যন্ত পদযাত্রা এগিয়েছে লড়াকু মেজাজে। পদযাত্রার আওয়াজ শুনে বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসেছিলেন দম্পতি মারফত শেখ-গুলশেনারা বিবি। স্বামী টোটো চালান। স্ত্রী ছোট্ট পান বিড়ির গুমটি করে রোজগারে সহায়তা করেন। পদযাত্রা সামনেই বললেন,‘‘এই মিছিল আরও আগে হলে এদিন দেখতে হত না। দালান ঘরে থেকে দিনরাত খুন জখম দেখার চেয়ে ঝুপড়িতে শান্তিতে থাকা অনেক ভাল।’’ গুলশেনারার মুখের কথা কেড়ে নিয়ে গ্রামেরই কসির শেখ জানালেন,‘‘মিছিল করার তো কত চেষ্টা করেছি। কিন্তু করতে দেয়নি। এই দেখুন এখনও মেরে হাতের হাড় ভেঙে দেওয়ার যন্ত্রণা নিয়েই ঘুরছি।’’ 
কসির শেখ বুক ফুলিয়েই হেঁটেছেন পদযাত্রায়। পুরোটা। প্রায় চোদ্দ কিলোমিটার। সঙ্গ দিয়েছেন বগটুইয়েরই মসিম শেখ। সকাল থেকে গাঁয়ে শহরে টিন ভাঙা লোহা ভাঙা জোগার করে আড়তে বিক্রি করে দু’টো রোজগার করেন এই হতদরিদ্র শ্রমিক। পদযাত্রা হবে শুনে কাজকাম ভুলে জুটে গিয়েছিলেন মিছিলে। পদযাত্রা এগিয়েছে পাড়ায় পাড়ায় মোড়ে মোড়ে ছেলেপুলে কোলে নিয়ে মহিলা পুরুষ এগিয়ে এসেছেন তা দেখতে। ষাটোর্ধ বৃদ্ধ কালাম শেখ লাঠি ধরেই চলাচল করেন। কানে বাজনার শব্দ যেতেই লাঠি নিয়ে কাঁপতে কাঁপতে এসেছিলেন মিছিল দেখতে। শুধু দেখেননি, পদযাত্রীদের একজনের মাথায় থাকা কাস্তে হাতুড়ি প্রতীক দেওয়া লাল টুপি খুলে নিজের মাথায় পড়ে নিয়েছেন। শরীর নড়বড়ে হলে কী হবে জেদ কিন্তু সমান এখনও তার। বলেছেন, ‘‘অনেক সহ্য করলাম। আর অত্যাচার সইছে না। এর শেষ হওয়া দরকার।’’


বেলা বেড়েছে। মাথার রোদও চড়া হয়েছে। কিন্তু ফিকে হয়নি মিছিলের মেজাজ। বগটুই মোড়ে যেখানে তৃণমূলের প্রাক্তন উপপ্রধান (কয়লা, বালি,পাথর মাফিয়া যার উপযুক্ত তকমা) ভাদু শেখ খুন হয়েছিল ঠিক সেখান থেকে শুরু হয়ে পদযাত্রা ঘুরেছে এই খুনের বদলায় পাশবিক আক্রমণ আছড়ে পড়েছিল যেসব বাড়িতে তার পাশ দিয়েও। পদযাত্রা দেখতে উৎসুক মানুষের ভিড়ে থামতে হয়েছে। আগাম পরিকল্পনা ছাড়াও মোড়ের মাথায় করতে হয়েছে পথসভাও। সেখানেই সিপিআই(এম) নেতা সঞ্জীব বর্মণ বলেছেন,‘‘গাঁয়ে গাঁয়ে তৃণমূলের চোরদের তাড়িয়ে মানুষের হক প্রতিষ্ঠার জন্য গ্রাম জাগাতেই আমাদের এই পদযাত্রা চলছে চারিদিকে। এই গ্রামেও তৃণমূলের সেই চোরদের বখরার ভাগ নিয়ে বিবাদেই তো এত অশান্তি।’’ 
মিছিলের শুরুতেই দেখা পাওয়া গেছে বগটুইয়ের বি-টেক পাশ করা যুবকের। যাঁর আক্ষেপ,‘‘গাঁয়ের ছেলে বড় হলে তাদের কাছে শিক্ষার আলো নয়, পৌঁছে দেওয়া হয় বোমা-বন্দুক। তাই তো গায়ে পা পড়ে সিবিআই’র। রাখতে হয় পুলিশের স্থায়ী ক্যাম্প। লজ্জার।’’  

 

Comments :0

Login to leave a comment