প্রায় ৭০ বছর আগে রাষ্ট্রসঙ্ঘের সর্বসম্মত গৃহীত প্রস্তাবে বলা হয়েছিল মহিলাদের অধিকার মৌলিক মানবিক অধিকার। সমস্ত দেশ এই সনদে স্বাক্ষর করে। তারপর থেকে অসংখ্য চুক্তি কনভেনশন প্রস্তাব বিভিন্ন পর্যায়ে গৃহীত হয়েছে, বিভিন্ন দেশের সংবিধানও তা স্বীকৃত হয়েছে। মহিলাদের এই অধিকার বলতে হিংসা, দাসত্ব ও বৈষম্য থেকে বেঁচে থাকার অধিকার, শিক্ষা স্বাস্থ্য সম্পত্তি কর্মসংস্থান এবং সমান মজুরির অধিকার। কিন্তু পৃথিবীর প্রায় সর্বত্রই এই অধিকার থেকে মহিলারা বঞ্চিত। লিঙ্গ বৈষম্যের কারণে প্রায় চার দশক আগে মহিলাদের ওপর সমস্ত রকমের বৈষম্যর অবসান ঘটানোর জন্য রাষ্ট্রসঙ্ঘের কনভেনশন থেকে সমস্ত রাষ্ট্রকে ডাক দেওয়া হয়। প্রায় সমস্ত দেশের আইন ও সংবিধানে এই বৈষম্যের অবসান আর মহিলাদের অধিকার সুরক্ষিত করার ব্যবস্থা স্বীকৃত হয়। কিন্তু কাজে তার রূপায়ণ খুবই কম এবং এমনকি উন্নত দেশেও। আজও ভারতবর্ষের রাষ্ট্র ব্যবস্থায় এমনকি বিচার ব্যবস্থায়ও মহিলাদের প্রতি লিঙ্গবৈষম্যের ধারণা প্রায় পুরোপুরি রয়েছে।
গৃহস্থালির কাজে লিঙ্গ বিভাজন
বিচার ব্যবস্থার সাম্প্রতিক কয়েকটি রায় উল্লেখযোগ্য। গৃহস্থালি হিংসা নিয়ে অক্টোবর মাসে বোম্বাই হাইকোর্টে একটি মামলায় বিতর্কের মীমাংসার বদলে বিতর্ককে নতুন করে উসকে দেওয়া হয়েছে। অভিযোগ নাকচ করে আদালত। গৃহস্থালির কাজকর্ম নিয়ে মেয়েদের বাধ্যবাধকতায় ভারতীয় বিচারব্যবস্থা সংবিধানে নয়, এখনও প্রাচীন শাস্ত্রের বিধানে যেন আচ্ছন্ন। এই রায়ে আদালত বলেছে যে মহিলা যদি গৃহস্থালির কাজকর্ম করতে না চায় তাহলে হয় বিয়ের আগেই তার সেটা বলে দেওয়া উচিত যাতে ভাবী স্বামী এই বিয়ের ব্যাপারে পুনরায় ভাবতে পারে অথবা গৃহস্থালির কাজ করতে না চাওয়াটা যদি বিয়ের পর হয় তবে এসব সমস্যা আগে মিটিয়ে নেওয়া উচিত। যুগ যুগ ধরে বিনা পারিশ্রমিকে গৃহস্থালির কাজ বা অর্থের হিসাবে মূল্যহীন কাজ মহিলারা করে আসছেন প্রতিদিন। এখন গৃহস্থালি কাজে মেয়েদের ৮৫% সময় দিতে হয় রান্না, পরিষ্কার করা, শিশু ও পরিবারের যত্ন ইত্যাদিতে। জেগে থাকা অবস্থায় সময়ের বাহান্ন শতাংশ বিবাহিত মহিলারা গৃহস্থালির কাজে সময় দেন, বিবাহিত পুরুষরা দেন বড়জোর ৬ শতাংশ সময়। ফলে মাইনে বা মজুরির বিনিময়ে বাইরে কাজ করার কোনও ফুরসতই মেয়েদের থাকে না। মেয়েদের যারা বাইরে কাজ করে তাদের ঘরেও অমানুষিক পরিশ্রম করতে হয়। আজন্ম এই বোঝা বয়ে বেড়ানোর পরেও বিচার ব্যবস্থার কাছ থেকে তাদের শুনতে হয় যে গৃহস্থালির কাজ করা মেয়েদেরই দায়িত্ব। এমন কথা পর্যন্ত আদালত বলেছে যে গৃহস্থালির দায়িত্ব না নিলে সে মেয়েকে বিয়ে করবে কিনা পুরুষকে ভাবার সুযোগ দিতে হবে। সেই সঙ্গে সমান দায়িত্ব নেওয়া, কাজের বোঝার ভার লাঘব করা এবং গৃহস্থালির কর্তব্য পালনে সহায়তা করা কি পুরুষদের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে না ? আদালত এসব বিষয় বিচার বিবেচনা করতে নারাজ। এক মহিলা এই মামলায় এফআইআর-এ অভিযোগ করেছিলেন যে তাঁর স্বামী ও শ্বশুরবাড়ির লোকজনেরা বিয়ের একমাসের মধ্যে অত্যাচার, অপমান, হুমকি, কাজের অসহনশীল বোঝা চাপিয়ে যাওয়া ও হামলা ইত্যাদি দাসী বা গৃহপরিচারিকার মতো আচরণ করতে থাকে। এফআইআর বাতিল করে বোম্বাই হাইকোর্টের আওরঙ্গবাদ বেঞ্চ রায় দেয় যে বিবাহিত মহিলাকে গৃহস্থালির কাজ করতে বললে তার সঙ্গে গৃহপরিচারিকার মতো আচরণের তুলনা করা যায় না। এই ঘটনা এবং কোর্টের মন্তব্য স্পষ্ট তুলে ধরছে কিভাবে ভারতে বিনা পারিশ্রমিকের গৃহস্থালির কাজ লিঙ্গ ভিত্তিতে বিভাজিত হয়। এটা একমাত্র মেয়েদের কাজ বলেই আদালত রায় দেয় এবং আইন আদালতের বিধি ব্যবস্থার ভিত্তিতে যে বিয়ে হয় সেখানেও আদালত সেই বিয়েতে এই বিভাজনকে আরও শেকড় গেড়ে বসিয়ে দেয়। এর আগে গত সেপ্টেম্বরে মুম্বাই সেশন কোর্টে এক মামলায় বিচারপতি মহিলাদের বিরুদ্ধে নিষ্ঠুরতা নিয়ে বিতর্কিত রায় দেন। স্বামী এবং শ্বশুরবাড়ির লোকজনদের অত্যাচারে অতিষ্ট হয়ে এক তরুণী বধূর আত্মহত্যা নিয়ে তরুণীর পরিবারের লোকরা অভিযোগ করে ২০১৫ সালে। এ মামলার রায়ে বিচারপতি বলেন যে, গৃহস্থালির কাজ করা মেয়েদের মূল কর্তব্যের মধ্যে পড়ে। শ্বশুরবাড়ির লোকজন দৈনিক মহিলার উপর যে ধকল নামিয়ে আনে তা স্বাভাবিক ঘটনাই। এটা নিষ্ঠুরতা নয় মানসিক নির্যাতনও নয়। আত্মহত্যায় প্ররোচনার ঘটনা এটি নয়। মেয়েদের উপর গৃহস্থালি হিংসার ঘটনার মামলা দেশের সব আদালতেই অসংখ্য স্তূপীকৃত হয়ে আছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে মেয়েরা অভিযোগ করতে এগিয়ে আসে না, পুলিশ ওইসব অভিযোগের ক্ষেত্রে বিরূপ ভূমিকা নিয়ে চলে। লিঙ্গ ও জাতপাত ভিত্তিক কাজের বিভাজন যেমন শাস্ত্রে রয়েছে, সবকিছুর ঊর্ধ্বে আজও যা পূর্ণ মাত্রায় চলছে।
পুরুষতান্ত্রিক, উচ্চবর্ণতান্ত্রিক মনুস্মৃতির বিধিতেই এসব বিভাজন কঠোরভাবে নির্ধারণ করা হয়েছে। এই বিভাজন-বৈষম্যের বিরুদ্ধে গর্জে উঠেছিলেন বি আর আম্বেদকর। এজন্য সামাজিক বৈষম্য বিলোপ করতে মনুস্মৃতি পোড়ানোর কর্মসূচিতেও তিনি অংশ নিয়েছিলেন। এত প্রতিবাদ-আন্দোলন সত্ত্বেও এই বৈষম্যের ধারার পরিবর্তন ঘটেনি। অনেক ক্ষেত্রে তার তীব্রতা বৃদ্ধি পেয়েছে। গত আগস্ট মাসে দিল্লি হাইকোর্টের এক বিচারপতি প্রকাশ্যে এমন পর্যন্ত ভয়ঙ্কর মন্তব্য করেন যে মহিলাদের সমতা দিয়েছে মনুস্মৃতিই।
মথুরা মামলার ৫০ বছর
মহিলাদের উপর ধর্ষণ নিয়ে সুপ্রিমকোর্ট যে বিচার করেছিল তাও অবিচারের ইতিহাসে নিদর্শন হয়ে রয়েছে মথুরা মহারাষ্ট্রের এক তরুণী আদিবাসী। পনেরো বছরের মতো বয়স তখন। ১৯৭২ সালের ২৬ মার্চ দেশাইগঞ্জ এলাকার থানায় পুলিশ ডেকে পাঠায় এবং দু’জন পুলিশ তারপর ধর্ষণ করে। এটা নিয়ে দেশজুড়ে হইচই হয়। মথুরা ছিল অনাথ, ভাইয়ের কাছে থাকতো। পরিচারিকার কাজ করতো। সেই সময় বিয়ে করার জন্য সুযোগ পেয়ে ঘনিষ্ঠতাও হয় একজনের সঙ্গে। গ্রামের কিছু লোক মথুরার ভাইকে প্রচণ্ড চাপ দিয়ে শাসিয়ে মথুরার বিরুদ্ধে থানায় অভিযোগ করেছে যে মথুরা একজনকে নিয়ে পালিয়ে গেছে। থানা এরপর মথুরা ও কয়জন সাক্ষীকে থানায় ডেকে পাঠায়। সাক্ষীদের চলে যেতে বলে থানার দুই কনস্টেবল মথুরাকে সন্ধের পর থেকে যেতে বলে। এখানে ধর্ষণের ঘটনা ঘটে। সকলের সন্দেহ হয়। মথুরাকে ডেকে সাড়া না পেয়ে তারা থানা জ্বালিয়ে দেওয়ার হুমকি দেয়। ভীত হয়ে পুলিশ মথুরার বিবৃতি নিতে বাধ্য হয়। এক মহিলা আইনজীবী মথুরার কেস হাতে নিয়ে মামলা চালান। সাত বছর পরে ১৯৭৯ সালে প্রথমে সেশন কোর্টে রায় হয় যে অভিযুক্তরা দোষী নয়। এরপর হাইকোর্টে মামলা গেলে হাইকোর্ট সেশন কোর্টের রায় বাতিল করে অপরাধী কনস্টেবলের একজনকে পাঁচ বছর, একজনকে এক বছরের কারাদণ্ড দেয়। হাইকোর্টের রায়টি ছিল গুরুত্বপূর্ণ; তাতে বলা হয়েছিল অন্যের হুমকি ভয়ের সঙ্গে তাদের লালসার কাছে অসহায় আত্মসমর্পণকে কখনোই আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে মেলানো যায় না কিংবা এটা দিয়েও তার উত্তর হয় না যে এ ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে ইচ্ছার বিরুদ্ধে। এই ধর্ষণের কাজ হয়নি কেবলমাত্র এই তথ্যের ওপর দাঁড়িয়ে এই গুরুতর অপরাধের কোনও উত্তর হয় না। অপরাধীরা সুপ্রিম কোর্টে যায় এবং সুপ্রিমকোর্ট ১৯৭৯ সালের সেপ্টেম্বর মাসে হাইকোর্টের রায়কে উলটে দিয়ে অপরাধীদের নির্দোষ ঘোষণা করে। শীর্ষ আদালত যুক্তি দেয় মহিলাই খারাপ; তার শরীরে কোনও আঘাতের চিহ্ন ছিল না, ধর্ষণে তার অসম্মতিও ছিল না। এই ভয়াবহ রায়ের বিরুদ্ধে দেশজুড়ে আইনজীবী এবং আইন বিশেষজ্ঞদের প্রতিবাদ উচ্চারিত হয়। অনেকে প্রতিবাদ জানিয়ে সুপ্রিম কোর্টে পাঠান তাদের লিখিত চ্যালেঞ্জ। তখন দেশজুড়ে ধর্ষণ সংক্রান্ত আইনের সংশোধন হয় এবং আইনে বলা হয় যে হেপাজতে আটক থাকা অবস্থায় ধর্ষণ হলে অপরাধীদেরই দায় নিজেদের নির্দোষ প্রমাণ করা ও অভিযোগ মিথ্যা প্রমাণ করা, ধর্ষিতার নয়। পরে আরও আইনের সংশোধন হয়েছে। কিন্তু এ অবিচার বন্ধ হয়নি, বরং আর্থিক-সামাজিক সঙ্কটের সঙ্গে সঙ্গে বেড়েছে পাশবিকতাও। আদালত এগিয়ে আসে না, রাষ্ট্রীয় শক্তি নির্লিপ্ত বা সেই একপেশেই। মথুরা মামলার ৫০ বছর উপলক্ষে কিছু পত্রিকার প্রতিনিধি বা সাংবাদিক খোঁজখবর নিয়ে মথুরার সঙ্গে গ্রামে গিয়ে দেখা করেন। প্রচণ্ড দারিদ্রের মধ্যে থাকেন আদিবাসী মথুরা। স্বামী কয়েক বছর আগে মারা গেছে, দুই বড় ছেলে দিন মজুরিতে কাজ করে। গোটা বিধিনিয়ম ব্যবস্থার প্রতি মথুরার ঘৃণা। পুলিশ এবং বিচার ব্যবস্থার বিরুদ্ধে মথুরার ক্ষোভ গোটা মহিলা জাতিরই ক্ষোভ, বলতে গেলে গোটা সমাজের ক্ষোভ।
পুঁজিবাদী দেশে বৈষম্য তীব্র
যেকোনও পুঁজিবাদী দেশ এমনকি তাদের মধ্যে যারা সবচেয়ে উন্নত, সভ্য ও গণতান্ত্রিক বলে নিজেদের সবসময় বড়াই করে সেখানেও মহিলাদের প্রতি বৈষম্য তীব্র। এই সভ্য উন্নত দেশগুলি তো দুনিয়ার বহু দেশকে তাদের শোষণ ও লুটের জন্য শত শত বছর উপনিবেশ বানিয়েছিল। সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসকরা এখনো দেশে দেশে এই বর্বরতা বাড়িয়ে চলেছে। একটি ঘটনা লেনিন উল্লেখ করেছিলেন ১৯১৩ সালের ১৪ এপ্রিল প্রাভদা পত্রিকায় যা প্রকাশিত হয়। ব্রিটিশ ভারতের একটি প্রদেশের ঘটনা। লন্ডনের এক ব্রিটিশ লেখকের এ সম্পর্কিত তথ্য প্রকাশিত হয় জার্মানির একটি শ্রমিক পত্রিকায়। প্রকাশিত ঘটনা অনুসারে এক ব্রিটিশ সাংবাদিক আর্নল্ড রেঙ্গুনে তাঁর প্রকাশিত সংবাদপত্রে প্রকাশ করেন এক নিবন্ধ— যার শিরোনাম ছিল 'ব্রিটিশ বিচারের একটি প্রহসন'। এনড্রু নামে স্থানীয় এক বিচারপতির ভূমিকা এই নিবন্ধে ফাঁস করে দেওয়া হয়। এই নিবন্ধটি প্রকাশের জন্য সাংবাদিক আর্নল্ডকে ১২ মাসের কারাদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়। এই সাংবাদিকের পিতাও লন্ডনের প্রভাবশালী সাংবাদিক। লন্ডনে তাঁদের অনেক জানাশোনা। ব্রিটেনের শীর্ষ আদালতে আর্নল্ড আবেদন করেছেন এটা জানামাত্রই ভারতের ব্রিটিশ সরকার তড়িঘড়ি কারাদণ্ডের মেয়াদ চার মাস করেন এবং আর্নল্ড ছাড়া পায়। কী নিয়ে এই হই হই ? ম্যাকরমিক নামে এক ব্রিটিশ কর্নেলের উপপত্নীর আয়না নামে ১১ বছর বয়সের এক দাসী বা পরিচারিকা ছিল। সভ্য দেশের এই সম্মানিত প্রতিনিধি কর্নেল আয়নাকে প্রলুব্ধ করে নিজের ঘরে নিয়ে আসে এবং তাকে ধর্ষণ করে ও নিজের ঘরে তালাবন্ধ করে আটকে রাখে। এমন সময় ঘটনাটি ঘটেছিল যখন আয়নার বাবা মুমূর্ষু এবং তার জন্য মেয়েকে গ্রামের বাড়িতে ডেকে পাঠায়। এরপরেই গোটা ঘটনা আয়নার গ্রামে ছড়িয়ে পড়ে। ক্ষোভে ফেটে পড়ে গ্রামের লোক। পুলিশ বাধ্য হয়ে ধর্ষককে গ্রেপ্তারের আদেশ দেয় কিন্তু বিচারপতি সঙ্গে সঙ্গে কর্নেলের জামিন এবং পরে অভিযোগ থেকে বেকসুর খালাস করে দেন। এরকম পরিস্থিতির সময় রাজকীয় ভদ্রলোকরা সাধারণভাবে যা করে থাকে এই সম্মানিত কর্নেল সেভাবে ঘোষণা করেন যে ওই মেয়েটা পতিতাবৃত্তির সঙ্গে যুক্ত; এটা প্রমাণ করতে তিনি পাঁচজন সাক্ষী জোগাড় করে হাজির করেন। অন্যদিকে আয়নার মা আটজন সাক্ষী পাঠান। কিন্তু বিচারপতি তাদের জিজ্ঞাসাবাদই করেননি। যখন সাংবাদিক আর্নল্ডের বিচার হচ্ছে মানহানির জন্য, তখন আদালতে প্রেসিডেন্ট স্যার চার্লস ফক্সের কাছে সাংবাদিক তাঁর বক্তব্যের পক্ষে সাক্ষীদের ডাকার অনুমতি চান, কিন্তু বিচারপতি সে অনুমতি দেননি। লেনিন এই ঘটনা বিবৃত করে লিখেছেন, ‘‘সকলের কাছে এটা পরিষ্কার থাকা উচিত যে এই ধরনের হাজার হাজার লক্ষ লক্ষ ঘটনা ঘটছে। একমাত্র সম্পূর্ণ ব্যতিক্রমী পরিস্থিতিতে মানহানির জন্য অভিযুক্ত আর্নল্ড জেল থেকে ছাড়া পেয়ে এই মামলার বিষয়বস্তু বাইরে প্রকাশ করার সুযোগ পেয়েছেন।’’ লেনিন কৌতুক ভরে এ লেখার শিরোনাম দিয়েছিলেন ‘সভ্য ইউরোপিয়ানরা এবং অসভ্য এশিয়ানরা’। বৈষম্য ও অবিচারের অবসানের আন্দোলন কয়েক শতাব্দীর অভিজ্ঞতায় আজ এটা সুস্পষ্টভাবে প্রতিষ্ঠিত যে সঙ্কীর্ণ পরিসরে নারীমুক্তির সমস্যা সমাধানযোগ্য নয়। বৃহত্তর জনগণের মুক্তির সঙ্গে সমানাধিকার, বৈষম্যের অবসান ও নারীমুক্তির আন্দোলন অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। নারীদের পূর্ণমাত্রায় তাতে অংশগ্রহণ ছাড়া নিজেদের সংগ্রাম যেমন সফল হতে পারে না, মানবজাতির মুক্তির সংগ্রামও মহিলাদের বাদ দিয়ে আকাঙ্ক্ষিত সাফল্য লাভ করতে পারে না। একবিংশ শতাব্দীর দু’দশক পরে আজকে পুঁজিবাদ তার সঙ্কট মোকাবিলার কুলকিনারা খুঁজে পাচ্ছে না। গত দেড় দশক ধরে কমবেশি মোটামুটি একটানা চলছে আর্থিক মন্দা, বিকাশের শ্লথগতি। প্রত্যেক দেশে ধনী দরিদ্রদের মধ্যে আয় ও সম্পদের অসাম্য ও বৈষম্য দ্রুতহারে বৃদ্ধি পেয়ে চলেছে। এটা যেমন প্রত্যেক দেশেই ঘটছে, আবার এক দেশের সঙ্গে অন্য দেশের ক্ষেত্রেও ঘটছে। এই সঙ্কটের মধ্যেও প্রত্যেক দেশে এবং বিশ্বজোড়া মুষ্টিমেয় বৃহৎ ধনকুবের ও পুঁজিপতিদের সম্পদ অস্বাভাবিক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। অন্যদিকে শ্রমজীবী জনসাধারণের জীবন-জীবিকার মানের দ্রুত অবনতি ঘটছে। এ অবস্থার মধ্যে মহিলাদের অবস্থা সবচেয়ে নিদারুণ। মহিলারা অপেক্ষাকৃত বেশি দারিদ্র, অপুষ্টি, চিকিৎসাহীনতা, ক্ষুধা ও কর্মহীনতার শিকার। এযাবৎকাল যতটুকু সামাজিক নিরাপত্তা এবং সুরক্ষামূলক আইনগুলি ছিল, ব্যয় সঙ্কোচের নামে সেগুলি ক্রমশ অনেক সঙ্কুচিত করে বাতিল অবস্থার মধ্যে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। শ্রমজীবী জনগণের সকলেই এর ফলে গুরুতর আক্রান্ত। মেয়েদের ক্ষেত্রে এর ক্ষতিকর প্রভাব অপেক্ষাকৃত অনেক বেশি। শিক্ষা, চিকিৎসা, শিশু ও মাতৃ কল্যাণ, খাদ্য ইত্যাদি ক্ষেত্রগুলি বেপরোয়াভাবে বেসরকারিকরণ করার ফলে আক্রান্ত তার সকলেই। বেশিরভাগ বোঝা বইতে হচ্ছে মহিলাদের। উদারবাদ ও বিশ্বায়নের বাজারের জন্য সাম্রাজ্যবাদী কর্তারা তাদের সমস্ত মিডিয়া, আধুনিক প্রযুক্তি এবং প্রচার জগৎকে ব্যবহার করে মহিলাদের পণ্যায়ন বাড়িয়ে তুলেছে। বেড়ে চলেছে এই সামাজিক ক্ষেত্রে মহিলাদের উপরে হিংসাত্মক ঘটনার তীব্রতা। বিশ্বজুড়ে এর চাইতেও ভয়ঙ্কর ঘটনা হলো মহিলা ও শিশুদের পাচার। সস্তা শ্রম এবং যৌন শোষণের জন্য এই পাচারের সংগঠিত কারবারকে দুনিয়া জুড়ে একটা রমরমা বৃহৎ শিল্প-ব্যবসায় তারা পরিণত করেছে
Comments :0