Editorial

যন্ত্রণাহীন বীরগাথা

সম্পাদকীয় বিভাগ

‘বাইশ তারিখের বদলা বাইশ মিনিটে।’ 
পহেলগামে সন্ত্রাসবাদী হামলার ত্রিশ দিনের মাথায় এমনই ভাষণ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। ভারত-পাকিস্তান সীমান্তে রাজস্থানের বিকানেরে তাঁর ভাষণে বিজয়ের উল্লাস এখানেই থামেনি। মোদী বলেছেন, ‘নতুন ভারত এখন। এই ভারত সন্ত্রাসবাদে একেবারে কেন্দ্রে গিয়ে আঘাত করে।’ বলেছেন, ‘রক্ত নয়, আমার শরীরে সিঁদুর বইছে।’
২২ এপ্রিল জম্মু ও কাশ্মীরের বিখ্যাত পর্যটনস্থল পহেলগামের বৈসরন ভ্যালিতে হত্যা করা হয়েছে ২৫ পর্যটককে। সন্ত্রাসবাদীদের বাধা দিতে গিয়ে নিহত হয়েছেন স্থানীয় টাট্টুচালকও। সন্ত্রাসের ভয়ঙ্কর বিবরণ দিতে গিয়ে নিহতদের পরিজনেরা বলেছেন কাশ্মীরের স্থানীয় মানুষের সহায়তা, তাঁদের বাধা দেওয়ার কথাও। অথচ তারপরও দেশজুড়ে তীব্র সাম্প্রদায়িক বিভাজন ছড়িয়েছে মোদীর অনুগামীরা। বিদ্বেষভাষণে বিদ্ধ দেশের সেনা আধিকারিক, বিদেশ সচিব। অথচ, মোদী শাসনের চিহ্ন অটুট রেখে কারও বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি নতুন ভারতে! কেবল বিভাজন-বিদ্বেষের দিক নয়। মোদীর ভাষণে কোথাও সামান্য খেদও নেই যে এই ত্রিশ দিনেও সরাসরি গুলি চালনায় দায়ী সেই সন্ত্রাসবাদীরা ধরা পড়েনি। জম্মু ও কাশ্মীর সারা বিশ্বের মানচিত্রে, সুরক্ষা বাহিনী মোতায়েনের বিচারে এগিয়ে থাকা অঞ্চলগুলির অন্যতম। সর্বদলীয় বৈঠকে অমিত শাহ স্বীকার করেছেন সুরক্ষার ত্রুটি ছিল। নরেন্দ্র মোদী বিকানেরের ভাষণে তারও উল্লেখ করেননি। পহেলগাম থেকে ৬ কিলোমিটার দূরে বৈসরন ভ্যালিতে পায়ে হাঁটা বা টাট্টুর পিঠে চড়ে পৌঁছাতে হয় পর্যটকদের। যে পার্কে নির্মম ভয়াবহ হত্যাকাণ্ড চলেছে সেটি অত্যন্ত জনপ্রিয়। ঘটনার সময়েও বহু পর্যটক ছিলেন। কেবল ওই দিনই নয়, পর্যটকদের ভিড় এমন লেগেই থাকে। অথচ সেখানে কোনও সুরক্ষাবাহিনী মোতায়েন ছিল না কেন?পহেলগামের ঘটনার ঠিক আগে হামলার আশঙ্কাতেই মোদীর সফরও পিছিয়ে গিয়েছিল। তারপরও এমন গাফিলতি। কেন প্রায় ঘণ্টাখানেক অপারেশনের মধ্যেও কোনও বাহিনী বাধা দিতে পারেনি, এ প্রশ্ন তুলেছেন নিহতদের পরিজনরাও। মোদী কেবল এই ভাষণেই সেসব প্রশ্ন এড়িয়েছেন তা নয়। বারবারই তাঁকে এড়িয়ে যেতে দেখা যাচ্ছে। কেন্দ্রের ডাকে দু’টি সর্বদলীয় বৈঠকের কোনোটিতে তিনি নিজে অংশ নেননি। বিরোধীরা সংসদের বিশেষ অধিবেশনের দাবি জানাচ্ছেন পহেলগাম হত্যাকাণ্ড এবং ‘অপারেশন সিন্দুর’ নিয়ে। সরকার কিছুতেই সংসদের মুখোমুখি হতে রাজি নয়। কেন? 
সেনা অভিযান ‘অপারেশন সিন্দুর’-র সাফল্য সেনাকে ছাড়তে রাজি নন মোদী। কেবল তিনিই নন, তাঁর দলের মন্ত্রী-নেতাদের বক্তব্যেও সেই সুর। বলা হচ্ছে, মোদীর নতুন ভারত পাকিস্তানের ঘরে ঢুকে মার! নিশ্চিত যে সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলার বদলে বিজেপি এবং আরএসএস বেশি আগ্রহী ঘটনাক্রমকে হাতিয়ার করে রাজনৈতিক ফয়দা তুলতে। মোদীর ভাবমূর্তির জন্য বীরত্বের প্রচার চলবে, পরপর ভোটে প্রচারের বিষয়বস্তুও করা হবে। তা আরও দরকার হয়ে পড়েছে আমেরিকা রাষ্ট্রপতি আগ বাড়িয়ে সংঘর্ষ বিরতির ঘোষণা করে দেওয়ায়। ইনিয়ে-বিনিয়ে ট্রাম্পের দাবি অস্বীকার করার চেষ্টা হলেও কূটনৈতিক স্তরে সরকারিভাবে কোনও প্রতিবাদপত্র নেই। 
মোদীকে যদিও আগেও দেখা গিয়েছে ব্যর্থতাকে আড়াল করে বীরত্বের প্রচার চালাতে। ২০১৯’র লোকসভা ভোটের আগে জম্মু ও কাশ্মীরের পুলওয়ামায় বিস্ফোরণে নিহত হয়েছিলেন আধা সামরিক বাহিনীর ৪০ জওয়ান। আজ পর্যন্ত কে দায়ী তা জানিয়ে কোনও তদন্ত রিপোর্ট জনতার সামনে পেশ করেননি মোদী। পুলওয়ামার বদলা নিতে বালাকোটে হামলা এবং সন্ত্রাসবাদের ঘাঁটি নিশ্চিহ্ন করার প্রচারকে হাতিয়ার করে লড়েছিলেন সেবারের লোকসভা ভোট। পুলওয়ামায় মোদী এবং জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভালের ভূমিকায় প্রশ্ন তুলেছিলেন সত্যপাল মালিক। জম্মু ও কাশ্মীরের এই প্রাক্তন রাজ্যপালও তদন্তের দাবি তুলেছিলেন প্রকারান্তরে। পহেলগামে হামলার ত্রিশ দিনের মাথায় ফের সংবাদে সেই সত্যপাল, সিবিআই দুর্নীতির চার্জশিটে দায়ী করেছে তাঁকে!

Comments :0

Login to leave a comment