Editorial

এই লড়াই সংবিধান রক্ষার লড়াই

সম্পাদকীয় বিভাগ

ভারতবর্ষে ২০ কোটিরও বেশি মুসলমান ধর্মাবলম্বী মানুষ আছেন।  ভারত বিশ্বে সবচেয়ে বেশি ওয়াকফ সম্পত্তির অধিকারী– ৮ লক্ষ ৭২ হাজারের বেশি সম্পত্তি, যা প্রায় ৪ লক্ষ ৫ হাজার হেক্টর (১০ লক্ষ একর) জুড়ে বিস্তৃত, যার আনুমানিক মূল্য প্রায় ১৪.২২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। এই সম্পত্তি দেখভাল রক্ষণাবেক্ষণের জন্য প্রতিটি রাজ্য এবং কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে ওয়াকফ বোর্ড রয়েছে। দেশজুড়ে ক্যাথলিক চার্চের প্রায় ১৭.২৯ কোটি একর ৭ কোটি হেক্টর জমি রয়েছে। একইভাবে ভারতে হিন্দু ধর্মীয় ট্রাস্টগুলির সম্মিলিতভাবে প্রায় ২০ লক্ষ একর জমি রয়েছে। এছাড়াও বহু দেবত্তর সম্পত্তি ছোট মাঝারি মন্দির বা অন্যান্য হিন্দু ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলির মালিকানায় রয়েছে। প্রত্যেক ধর্মের নিজস্ব রীতি রয়েছে এইসব প্রতিষ্ঠানগুলি পরিচালনার জন্য। কিছু ক্ষেত্রে দুর্নীতিও নিশ্চয়ই আছে। সাধারণভাবে সরকার এদের কার্যকলাপে বিশেষ হস্তক্ষেপ করে না, বিশেষ ধরনের অভিযোগ না থাকলে। সম্প্রতি ওয়াকফ আইনের গুরুত্বপূর্ণ কিছু পরিবর্তন এনে কেন্দ্রীয় সরকার নতুন ওয়াকফ সংশোধনী আইন, ২০২৫-এর পাশ করেছে। আইনটির নাম পরিবর্তন করে ‘ইউনিফাইড ওয়াকফ ম্যানেজমেন্ট, এম্পাওয়ারমেন্ট, এফিসিয়েন্সি অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট অ্যাক্ট’ রাখা হলেও, সংশোধনী আইনটি আসলে ‘ওয়াকফ’-এর সংজ্ঞাটাকেই প্রায় পালটে দিয়েছে এবং ওয়াকফ সম্পত্তির সমগ্র ব্যবস্থাপনায় ব্যাপক পরিবর্তন আনা হয়েছে। ওয়াকফ সম্পত্তির অন্তর্ভুক্ত সম্পত্তির অর্থ, মুসলিম ব্যক্তিগত আইনে স্থাবর সম্পত্তি ধর্মীয় কারণে দাতব্য দান, যার মধ্যে মসজিদ, মাদ্রাসা, এতিমখানা, কবরস্থান, দরগা, ঈদগা ইত্যাদি রয়েছে। আগের আইনে যে কোনও ব্যক্তিকে যে কোনও অস্থাবর বা স্থাবর সম্পত্তি ওয়াকফ হিসাবে উৎসর্গ করার অনুমতি দেওয়া হয়েছিল। নতুন আইন অনুযায়ী, ওয়াকফ দান কেবল সেই ব্যক্তিই করতে পারবেন, যিনি প্রমাণ করতে পারবেন যে কমপক্ষে পাঁচ বছর ধরে ইসলাম ধর্ম পালন করছেন। কীভাবে একজন ব্যক্তি প্রমাণ করবেন যে তিনি কমপক্ষে পাঁচ বছর ধরে ইসলাম ধর্ম পালন করছেন? কে এই ধরনের শংসাপত্র দেবে বা যাচাই করবে? অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের দান করার আইনে এমন কিছু আইন তো নেই। অর্থাৎ একটি ধর্মকেই নিশানা করা হচ্ছে, এটা স্পষ্ট। ওয়াকফগুলির ব্যবস্থাপনায় গুরুতর সরকারি হস্তক্ষেপ করার সুযোগ করে দেওয়া হয়েছে। ভারতীয় সংবিধানের ১৪ নম্বর অনুচ্ছেদ আইনের চোখে সমতার অধিকার দেয়; এটা তার বিরোধী। অনুচ্ছেদ ১৫ অনুযায়ী ধর্মের ভিত্তিতে বৈষম্যকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। সংবিধানের ২৫ অনুচ্ছেদ যে কোনও ধর্মকে অবাধে প্রচার, অনুশীলন ও প্রচারের অধিকার দেয় এবং ২৬ অনুচ্ছেদ, প্রতিটি ধর্মীয় সম্প্রদায়কে ধর্মের বিষয়ে তার নিজস্ব বিষয়গুলি পরিচালনার অধিকার দিয়েছে। সংশোধিত ওয়াকফ আইন সংবিধান স্বীকৃত এই সবকটি অনুচ্ছেদকেই অস্বীকার করেছে। তাই এই নিয়ে ৯০টিরও বেশি মামলা সুপ্রিম কোর্টে দায়ের হয়েছে, যার শুনানি চলছে। উল্লেখ্য, এই ধরনের নতুন শর্তাবলী শুধুমাত্র ওয়াকফের ক্ষেত্রেই আরোপ করা হয়েছে, অন্য ধর্মীয় সম্প্রদায়ের দানগুলির ক্ষেত্রে নয়। এর থেকেই স্পষ্ট হয়, একটি নির্দিষ্ট ধর্মকে নিশানা করেই আরএসএস-সংঘ পরিবারের নির্দেশেই মোদী সরকার এই আইন এনেছে। 
হিন্দুত্ববাদের বিরুদ্ধে লড়াই শুধু মুসলমানদেরই একটি ধর্মীয় লড়াই নয়। হিন্দুত্ববাদীদের আক্রমণ শুধু মুসলমানদের বিরুদ্ধে নয়। হিন্দুত্ববাদ দেশের সব ভাষা, ধর্ম, সংস্কৃতি, পোশাক, খাদ্যাভ্যাসের বৈচিত্রকে ধ্বংস করে হিন্দিভাষী, নিরামিষাশী, উত্তর ভারতীয় ব্রাহ্মণ্যবাদী ও পুরুষতান্ত্রিক সমাজ সমগ্র দেশবাসীর ওপর চাপিয়ে দিতে চাইছে। এর মাধ্যমে দেশের যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাকে তুলে দিতে চাইছে, যাতে রাজ্যগুলির কোনও অধিকার না থাকে। ধর্মব্যবসায়ীদের সামনে রেখে আরএসএস-মোদী ঘনিষ্ঠ অতি ধনীদের হাতে সব সম্পদ তুলে দেওয়ার লক্ষ্যেই এদের ধর্মের নামে বিদ্বেষ-বিভাজনের রাজনীতি। এটা রাজনৈতিক লড়াই। সমস্ত মানুষ, দলিত, আদিবাসী, খ্রিস্টান, ধর্মনিরপেক্ষ ধার্মিক হিন্দু আজ আক্রান্ত। রাজনৈতিক লড়াই রাজনৈতিকভাবেই লড়তে হবে। এটা শুধু একটা ধর্ম রক্ষার লড়াই নয়, এটা ভারতের  বৈচিত্র, গণতন্ত্র, সংবিধান রক্ষার লড়াই।

 

 

Comments :0

Login to leave a comment