গণতন্ত্রের পরিসর যত সঙ্কুচিত হয় এবং গণতন্ত্রের ভিত্তি যত দুর্বল হয় ততই মজবুত হয় অতি দক্ষিণ পন্থার জমি। অন্যভাবে বললে গণতন্ত্রের জমিতে অতি দক্ষিণ পন্থীরা যদি শাসনদণ্ড হাতে পায় তাহলে তারা ঠান্ডা মাথায় পরিকল্পনা গণতন্ত্রকে সমূলে উৎপাটনের অভিযানে নামে। ভারতের বুকে অতি দক্ষিণপন্থী ও উগ্র জাতীয়তাবাদী সাম্প্রদায়িক আরএসএস-বিজেপি ক্ষমতা দখলের পর গত এক দশক সেই অভিমুখেই দ্রুত এগিয়ে চলেছে। অতি দক্ষিণপন্থার বিকাশের প্রধান বাধা গণতন্ত্র। গণতন্ত্রকে বিসর্জন দিতে পারলে অতি দক্ষিণ পন্থার রমরমা। আর অতি দক্ষিণ পন্থার আধারেই বিকশিত হয় স্বৈরাচারী শক্তি এবং ফ্যাসিবাদী শক্তি। ভারতের বুকে হিন্দুত্ববাদী সাম্প্রদায়িকতাকে অবলম্বন অতি দক্ষিণ পন্থীরা স্বৈরাচার, একনায়কতন্ত্র ও ফ্যাসিবাদের রাস্তা করছে।
দেশের সংবিধান যেহেতু ধমরনিরপেক্ষ ও গণতান্ত্রিক তাই সরাসরি স্বৈরতন্ত্র বা একদলীয় আধিপত্য অথবা একনায়কতন্ত্র কায়েম করা যাচ্ছে না। তবে পদে পদে গণতান্ত্রিক রীতিনীতিকে লঙ্ঘন করে, সমস্ত গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানকে দুর্বল করে, সর্বত্র একাধিপত্য কায়েমের মধ্য দিয়ে গণতন্ত্রকে নির্মূল করার দিকে এগচ্ছে। গণতন্ত্র অর্থবহ থাকতে পারে তখন যখন সরকার সংবিধানকে অক্ষরে অক্ষরে মান্যতা দেয়, অনুসরণ করে। বাস্তবে পদে পদে সংবিধানের ধারা উপধারাগুলিকে পদদলিত করা হচ্ছে। সর্বোপরি সংবিধানের গণতান্ত্রিক উপাদানগুলির মর্মবস্তুকে নিধন করা হচ্ছে। গণতন্ত্রে নির্বাচিত সংসদ সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। গণতন্ত্রের পরিপূর্ণতা অনুভব করা যায় সংসদের কর্মপ্রণালীর মধ্য দিয়ে। সেই গণতান্ত্রিক সংসদ এখন শাসক দলের আধিপত্যবাদীদের মৃগয়া ক্ষেত্রে। বিরোধীরা সেখানে অবাঞ্ছিত, কণ্ঠরুদ্ধ। গণতন্ত্রের প্রাণ ভোমরা বিরুদ্ধ স্বর। সেটা এখন ভারতের সংসদে চাপা দিয়ে রাখা হয়েছে। ভারত রূপান্তরিত হয়েছে নির্বাচিত স্বৈরতন্ত্রে।
গণতন্ত্রের আর একটি গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ স্বাধীন, স্বতন্ত্র ও নিরপেক্ষ বিচারব্যবস্থা। তাকেও গ্রাস করতে চাইছে বর্তমান স্বৈরাচারী শাসক। যে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার ভিত্তি তৈরি হয় মানুষের স্বাধীন মতামতের মাধ্যমে নির্বাচনের মধ্য দিয়ে। নির্বাচন কমিশনকে সরকারের অলিখিত আজ্ঞাবাহী করে নির্বাচন প্রক্রিয়াকেই গণতন্ত্রের পক্ষে বিপজ্জনক করে তোলা হচ্ছে।
হিন্দুত্ববাদী শাসকদের মানসিকতার কুৎসিত প্রকাশ ঘটেছে বিজেপি’র দুই সাংসদের কথা। একজন চারবারের সাংসদ ও দলের প্রভাবশালী নেতা। ওয়াকফ সংশোধনী আইন এবং বিধানসভায় পাশ হওয়া বিল রাজ্যপাল-রাষ্ট্রপতিরা অনির্দিষ্টকাল আটকে রাখা নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের অবস্থানে প্রবল ক্ষিপ্ত হয়ে তারা প্রধান বিচারপতি ও আইন ব্যবস্থাকেই সরাসরি আক্রমণ করেছেন। আদালত কেন সরকারের প্রতিটি পদক্ষেপকে বৈধতা দিচ্ছে না, এটাই তাদের রাগ। অর্থাৎ বিচার ব্যবস্থার নিরপেক্ষতা এবং সংবিধান ও আইন মেনে চলা তারা মানতে রাজি নয়। গণতন্ত্রকে বলি দিয়ে স্বৈরতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পদধ্বনি। একই পথে এক ধাপ এগিয়ে সুপ্রিম কোর্টকে আক্রমণ করেছেন উপরাষ্ট্রপতি। তার হিন্দুত্ববাদী পরিচয় অবশ্য কারো অজানা নয়। সর্বোচ্চ আদালত আইনসভার ওপর খবরদারি করছে, রাষ্ট্রপতিকে নির্দেশ দিচ্ছে বলে তার ক্ষোভ প্রকাশ করছেন। ভাবখানা এমন সংখ্যার জোরে তারা অসাংবিধানিক বিল পাশ করাবেন, রাষ্ট্রপতি-রাজ্যপালরা রাজাধিরাজের মতো খুশিমতো চলবেন তাতে চোখ বুজে সায় দিতে হবে সুপ্রিম কোর্টকে। উগ্র হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিস্তদের জেনে রাখা ভালো সর্বোচ্চ আদালত শাসকের রক্ষাকর্তা নয়, সংবিধানের রক্ষা কর্তা।
Comments :0