বনবাণী ভট্টাচার্য
সময়টা ১৯১৯ সাল। ব্রিটিশ রাজ জারি করেছে ভারতীয়দের প্রতিবাদী স্বর স্তব্ধ করার কুখ্যাত ‘রাওলাট আইন’। এই দমনমূলক আইনের প্রতিবাদে গর্জে উঠল পাঞ্জাব। ১৩ এপ্রিল, জালিয়ানওয়ালা বাগে একটি শান্তিপূর্ণ নিরস্ত্র সমাবেশকে ব্রিটিশ সৈন্য জেনারেল ডায়ারের নেতৃত্বে হিংস্র আক্রমণ করে নিরীহ রক্তে অমৃতসরের মাটি ভিজিয়ে দিলো। রবীন্দ্রনাথ, রাজনৈতিক নেতাদের দ্বারে দ্বারে ঘুরেও এই নৃশংস হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে কোনও প্রতিবাদী পদক্ষেপ গ্রহণ করাতে না পেরে ইংরেজের দেওয়া নাইট উপাধি ত্যাগ করে প্রতিবাদ জানালেন— এ ঘটনা প্রায় সকলেরই জানা। অবশ্য এই ঘটনা পল্লবিত হয়ে একটি ভ্রান্ত ধারণারও জন্ম দেয় যে, কবির সুবিখ্যাত গান— ‘এ মণিহার আমায় নাহি সাজে,’ এই উপলক্ষে রচিত। কবি তো ইংরেজের ঐ নাইট উপাধিকে ‘মণিহার’ বলে মনেই করেননি কখনও।
কিন্তু ঐ একই ঘটনার প্রেক্ষিতে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রাম ও তার বীরত্বপূর্ণ ঐতিহ্যের ইতিহাসে একটি অসাধারণ মাণিক্যের সন্ধান সকলেই হয়তো পাননি। জেনারেল ডায়ারকে এক মুসলিম স্বাধীনতাকামী দেশপ্রেমিক চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে বলেছিলেন, ‘জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডে একজনও পিঠে গুলিবিদ্ধ মুসলিম যদি খুঁজে পান, আমি আজাদীর লড়াই থেকে দূরে সরে যাবো।’ ৭৬টি লাশ পোস্টমর্টেমে কাটা-ছেঁড়া করেও কারোর পিঠে গুলি পাওয়া যায়নি— সবাই রুখে দাঁড়িয়ে বুক পেতে দিয়ে শহীদ হয়েছেন। এই চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছিলেন ৩০ বছরের যুবক আবদুল গফ্ফর খান, যিনি ব্রিটিশ অখণ্ড ভারতের পেশোয়ারে জন্মে ভারতের স্বাধীনতার জন্যে, শিক্ষার প্রসার ও হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের জন্যে সারা জীবন লড়াই করেছেন। ভারতে স্বাধীনতার জন্যে ৩৫ বছর জেলের বন্দি জীবন কাটিয়েছেন। কিন্তু, কুচক্রী ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ ও স্বার্থান্বেষী হিন্দু-মুসলমানের কয়েকজনের চক্রান্তে এই স্বাধীনতা সংগ্রামী দেশপ্রেমিক ভারতীয়, দেশভাগে একরাত্রে হয়ে গেলেন পাকিস্তানী বিদেশি। দেশভাগ হয়েছে— বর্ডার হয়েছে, এপার-ওপার হয়েছে, তবু বৃষ্টি যেমন সীমানা মানে না, আবেগও তেমনি কাঁটাতারের বেড়া ডিঙিয়ে ছুটে যায়, থেমে থাকে না। ভারত বিভাগের পরে যিনি জন্মভূমি খাইবারে চলে যান। তিনিই সম্ভবত একমাত্র বিদেশি যাকে ভারতরত্নে ভূষিত করে এই উপমহাদেশ।
ভারত এরকমই। আর এই উদারতাই ভারতের ধর্ম, যে উদারতার মধ্যে দিব্যি ঘরকন্না করে এসেছে এতকাল হিন্দু-বৌদ্ধ-শিখ-জৈন-পারসিক, মুসলমান ও খ্রিস্টানের ধর্ম। কিন্তু ভারতীয় জীবনে এই নিরুদ্বেগ জীবন-ধর্ম আজ আক্রান্ত— আক্রান্ত মানুষের স্বাধীন ধর্মাচারণের অধিকার। এ কথা ঠিক ৭৮ বছর আগে ১৫ আগস্টের সকালের সূর্যের সেই প্রথম আলোকস্নানের যে উন্মাদনা তার ছিটেফোঁটাও আজ অবশিষ্ট নেই। তবু অভ্যেসবশত এখনও মানুষ, ছেলে-মেয়েদের জাতীয়-পতাকা তোলার অনুষ্ঠানে স্কুল-কলেজে, পাড়ার ক্লাবে পাঠিয়ে দেয়। নিজেরাও একটা আশা পোষণ করে মনে মনে, লালকেল্লা থেকে সত্যিই যদি আচ্ছে দিনের ইশারা কিছু পাওয়া যায়। মানুষ বারবার ঠকে যায়, তবু স্বাধীনতা দিবসের টানটা অস্বীকার করতে পারে না।
তবে এবারের মতো মানুষ কখনও এমন আঘাত পায়নি। লালকেল্লায়, ত্যাগ-শৌর্য-শান্তি সমৃদ্ধির জাতীয় পতাকা উত্তোলন করলেন কে? কে দীর্ঘ সময় জুড়ে জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দিলেন, নানা ভাষা-নানা মত-নানা পরিধানের যে বৈচিত্রেভরা ভারত, তারই প্রধানমন্ত্রী, নাকি নাগপুর পুষ্ট স্বয়ংসেবক ও সঙ্ঘের প্রচারক? সুদীর্ঘ ভাষণের মূল নির্যাস তো ২০২৫ সালে শতবর্ষ যে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের, তার গৌরব গাথা সাড়ম্বরে জাতি, থুড়ি ভোটারের সামনে তুলে ধরা।
মানুষ বোঝে, কালকেই যে লোকসভার ভোট নয়, তবু সাবধানের মার নেই। বিশ্বগুরু বনতে যাওয়া তো দূর অস্ত, আচ্ছে দিনের গল্পটা সব মিলিয়ে এমন ঘেঁটে আছে যে, ২৬ সালে পশ্চিমবঙ্গ দখল অভিযান কতটা সফল হবে সেটাই কপালে ভাঁজ ফেলছে। তাই, আরএসএস’কে নানাভাবে সাজিয়ে-গুছিয়ে তোলার চেষ্টা।
এটা না করে, নরেন্দ্র দামোদর দাস মোদী যদি কর্মহীন-শিক্ষাহীন বুভুক্ষু ভারতকে ঐ ‘আচ্ছে দিন’, ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’, জনধন-উজলার মতো আরও অসাড় কোনও প্রকল্পের আষাঢ়ে গল্প শোনাতেন স্বপ্ন দেখাতেন, তাহলেও দেশবাসী এই ভেবে সান্ত্বনা পেত যে, বরাবরের মতো ধোঁকা হলেও, একটা উন্নত ভারতের স্বপ্নই তো দেখিয়েছেন দেশের প্রধানমন্ত্রী।
১৯২৫ সালে যে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ গড়ে উঠেছিল ভারতীয়ত্বের নয়, হিন্দুত্ব ও বিভাজনের বিষকুম্ভ হয়ে, তারই স্তুতিগান গাইলেন দেশের প্রধানমন্ত্রী একটি দেশের স্বাধীনতা উদ্যাপনের গৌরবের, শহীদদের স্মরণ ও সংকল্প গ্রহণের মতো তাৎপর্যপূর্ণ দিনে। দেশবাসীকে শুনতে হলো ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে ঐ বিভেদের শক্তি আরএসএস ও হিন্দুমহাসভার অকুণ্ঠ অবদানের গল্প। এদের নেতা হিন্দুমহাসভার সভাপতি শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জি, যিনি আবার ব্রিটিশ আমলে ফজলুল হক মন্ত্রীসভার অর্থ মন্ত্রী ছিলেন, ১৯৪২ সালে ৭ ও ৮ অগাস্ট থেকে ভারত ছাড়ো আন্দোলন দমন করার জন্য, তৎকালীন রাজ্যপালকে চিঠি লিখেছিলেন। এর মর্মবস্তু ছিল, যুদ্ধের সময়ে রাজশক্তি ব্রিটিশের গায়ে কোনও আঁচড় লাগতে দেওয়া ঠিক নয়, তাই এই আন্দোলন দমন করতেই হবে। সেই ভারত ছাড়ো আন্দোলনে ৭১ বছরের মাতঙ্গিনী হাজরা, শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জি মন্ত্রীসভার নির্দেশে ব্রিটিশ পুলিশের গুলিতে প্রাণ দেন। শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জির ‘শত্রু’ কিন্তু সেদিন ছিল ঐ মাতঙ্গিনী হাজরারা, যারা দেশকে শৃঙ্খল মুক্ত করতে ইংরেজের গুলির সামনে বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন। আর পরম দেশভক্ত সেদিনের মহামান্য মন্ত্রী ড. শ্যামাপ্রসাদ ‘‘কর্তৃপক্ষের প্রকাশ্য অবাধ্যতার বিরুদ্ধে পুলিশের উপযুক্ত বৈধ পদক্ষেপ’’ বলে সার্টিফিকেট দিয়েছিলেন মাতঙ্গিনী হাজরার লাশ মনে রেখে।
কলকাতা উত্তাল আজাদ হিন্দ ফৌজের বিচার ঘিরে। রাস্তায় বিদ্রোহের ঢেউ। ছাত্র রশিদ আলির রক্তে ভিজল কলকাতার রাজপথ। ড. শ্যামাপ্রসাদের ডায়েরি থেকে জানা যায় যে, কলকাতায় গন্ডগোল হচ্ছে, গুলি চলছে শুনে, তিনি ও ডাঃ পাল যান ওয়াই মোল্লার দোকানের কাছে— লাটসাহেবও সেখানে উপস্থিত। তিনি ‘‘আমাদের অনুরোধ করলেন ছেলেদের বলতে তারা যেন রাস্তা থেকে উঠে বাড়ি যায়। ... যা হোক ছেলেরা নড়তে অস্বীকার করল।’’ ব্রিটিশ-অনুগত ড. শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জির স্বাধীনতা-আন্দোলনের অবদানের কিছু নমুনা এমনই। এই যারা, ভারতের রক্তক্ষয়ী স্বাধীনতার যুদ্ধে একবিন্দু রক্ত খরচ করেনি তাদেরই আদি জনক ইংরেজের পায়ে দাসখত দিয়ে তো হলেন বীর সাভারকার। অত্যন্ত সচেতন ও পরিকল্পিতভাবে ইংরেজদের পক্ষে দাঁড়ানো, আর এক আরএসএস নেতা, হিন্দুত্বের প্রবক্তা গোলওয়ালকারের নির্লজ্জ উচ্চারণ ছিল— ‘‘হিন্দুরা তোমরা ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে লড়াই করে শক্তি ক্ষয় করো না। তোমাদের শক্তি বাঁচিয়ে রাখো আমাদের অভ্যন্তরীণ শত্রু মুসলিম, খ্রিস্টান এবং কমিউনিস্টদের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য।’’ মুচলেকা দিয়ে জেল-মুক্তি কেনা সাভারকর, স্বাধীনতা সংগ্রামের শত্রু, ইংরেজের পদলেহনে দালালদের স্বাধীনতার যোদ্ধা বানালেন স্বয়ংসেবক। ক্ষুদিরাম-প্রীতিলতা-মাতঙ্গিনীদের রক্তে কেনা স্বাধীনতার ইতিহাসে ঐসব দেশ বিরোধী শক্তিকে দেশপ্রেমিকের তকমা দিয়ে, তিনি ইতিহাস বিকৃত করেছেন, স্বাধীনতা সংগ্রামীদের অপমান করেছেন, মহান স্বাধীনতার ইতিহাসের গৌরবকে করেছেন ভূলুণ্ঠিত। একই সাথে ধর্মনিরপেক্ষ-গণতান্ত্রিক সংবিধান অস্বীকার করে, ঐক্যবদ্ধ বহুত্ববাদী প্রজাতান্ত্রিক ভারতকে ভেঙেচুরে উগ্র হিন্দুরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা কল্পে ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতার আগুন জ্বালাতে উন্মত্ত হয়ে উঠেছে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্ঘ পরিবার ও তার রাজনৈতিক দল বিজেপি।
স্বাধীনতার বয়স তখন পুরো এক বছরও হয়নি। ১৯৪৮ সালের ৩০ জানুয়ারি, গান্ধীজী বিকেলে একটি প্রার্থনা সভায় যাচ্ছিলেন। তখনই তাঁকে নাথুরাম গড্সে নামে এক আততায়ী গুলি করে হত্যা করে। ধর্মপ্রাণ, পরম হিন্দু গান্ধীজী নিহত হলেন, হিন্দু নয় এক হিন্দুত্ববাদীর হাতে।
দ্বিজাতি তত্ত্বের বিষে ভারত ভাগ হয়েছে— মুসলিম বিদ্বেষ আজও তাজা। এতই তাজা যে মুসলিম পরিবার বাড়ি ভাড়া পায় না, দু’মুঠো ভাতের জন্যে বাড়ি বাড়ি উদয়াস্ত পরিচারিকার কাজ করে চলেছে যে ‘ময়না’, খোঁজ করলে দেখা যাবে তার নাম আসলে হয়তো ‘নাজমা’। নাম না ভাঁড়ালে হিন্দু পরিবারে তার কাজ জোটে না। শান্তিনিকেতনগামী ট্রেনে কোনও এক অন্ধ ওসমানকে হরিদাস নাম নিয়ে এখনও ‘‘তোমার খোলা হাওয়া লাগিয়ে পালে’’ রবীন্দ্র সঙ্গীত গেয়ে ভিক্ষে চাইতে হয়।
হিন্দু-মুসলমানের অনৈক্যের ফাটল চওড়া করার কাজে আরএসএস এবং বিজেপি নিরলস। হিন্দু রাষ্ট্র নির্মাণ এখন আর বিজেপি’র গোপন অ্যা জেন্ডা নয়। হিন্দুত্বর সাথে হিন্দুধর্মের কোনও সম্পর্ক নেই। এটা কোনও হিন্দু-বিরোধীর নিন্দাবাচক, সমালোচনা নয় যে ‘হিন্দুত্ব’ একেবারেই এক রাজনৈতিক প্রোজেক্ট বা প্রকল্প। একথা স্বয়ং সাভারকারের। তার জন্যে ক’বছর আগেই এনআরসি, সিএএ, এক প্রস্থ রিহার্সাল দিয়ে আবার, প্রায় নাৎসি কায়দায় ডিটেনশন ক্যাম্পও চালিয়েছে। উদ্দেশ্য, ভারতের কবির উদার আহ্বান এসো হে আর্য, এসো অনার্য, হিন্দু-মুসলমান, অস্বীকার করে ভারতকে ইসলাম-মুক্ত করা ওদের স্বপ্ন।
এসআইআর’র নামে ভোটার তালিকার শুদ্ধিকরণ যাত্রা বিহারে, কারণ সেখানে সামনেই ভোট। বিহারে ৩০ দিনে ৭ কোটি ৮৯ লক্ষ নির্বাচকমণ্ডলীর মধ্যে ৬৫ লক্ষ নাম এসআইআর উধাও করে দেওয়ায় নির্বাচন কমিশনকে সুপ্রিম কোর্ট ৬৫ লক্ষ ভোটার বাতিল করার কৈফিয়ত চেয়েছে। মৃত চিহ্নিত দু’জন জ্যান্ত হয়ে সুপ্রিম কোর্টে লাইফ সার্টিফিকেট দাখিল করে এসেছে। এসআইআর বর্জন-বিভাজন নীতি পরিচালিত এক এথ্নিক ক্লিনসিং-এর পেপার প্ল্যান। বোমা-বন্দুকে ইজরায়েল যেটা করছে গাজায়। যেখানে যার অস্তিত্ব ক্ষমতার পক্ষে বিপজ্জনক, সেখানেই তাকে ঝেঁটিয়ে সাফ করতে হবে। এ প্রশ্নে অবশ্য মূল টার্গেট মুসলমান নাগরিক। তবে আসামে এনআরসি ১৩ লক্ষ হিন্দুর নাগরিকত্ব কেড়ে নিয়েছিল। সর্বজনীন ভোটাধিকার গণতন্ত্রের ভিত্তি, ১৯৫০ সালে ভারতের সংবিধান ভারতীয় নাগরিককে এই অধিকার প্রথম দিয়ে উন্নত দেশ সহ সারা বিশ্বে পার্টিসিপেটরি গণতন্ত্রের দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিল।
এখন অনুপ্রবেশকারীর বাই তুলেছে ভারত জুড়ে। ঠিকই সীমান্ত রাজ্য বাংলা-আসাম-ত্রিপুরা-পাঞ্জাব প্রভৃতিতে অনুপ্রবেশ রোখার জন্য বিএসএফ মোতায়েন থাকে— তবু সতর্কতার কোনও বিকল্প নেই। তাবলে, ভিন্ রাজ্যে বাঙালি ছেলে-মেয়েরা কাজ করতে, লেখাপড়া করতে গেলে প্রতি মুহূর্তে তাদের অন্যের সন্দেহের শিকার হতে হবে? আগে হচ্ছিল, যে কাউকে অনুপ্রবেশকারী বলে হয়রানি করা। এখন তো অন্য রাজ্যে কোনও গরিব মানুষ বাংলায় কথা বললেই নানান হেনস্তা থেকে শুরু করে ‘পুশব্যাক’ প্রভৃতি মাত্রায় পৌঁছে পিটিয়ে খুন বা গায়েব করাও চলতে পারে। কি অপরাধ রাজস্থানে মালদার পরিযায়ী শ্রমিক আমির শেখের? বার্থ সার্টিফিকেট, আধার কার্ড দেখাবার পরেও কেন তাকে দু’মাস জেলে আটকে রাখা হলো ? সে তার মাতৃভাষা বাংলায় কথা বলেছে বলে? দুই বাংলারই তো মাতৃভাষা বাংলা। ওপার বাংলার ধার ঘেঁষা এপার বাংলার মানুষের কথা প্রায় একরকমই। আবার এপার বাংলার মেদিনীপুরের ভাষার সাথে কলকাতার ভাষার তফাৎ নেই? কিন্তু এরা সবাই বাংলাভাষী। তবে মানুষ তো একাধিক ভাষাতেও কথা বলে। মোদীজী, অমিত শাহজী যদি ইংরেজি বলেন কখনও, তবে কি ওরা ভারতীয় নন ? আমেরিকায় বিদেশ মন্ত্রী ইংরেজিতে ভাষণ দিচ্ছেন— তবু তো ভারতীয়ই তিনি?
বাংলা ভাষী শ্রমজীবীদের অনুপ্রবেশকারী বলে হেনস্তা করা একেবারেই উদ্দেশ্যমূলক। ভারতের সংবিধান ভাষা-ধর্ম-জাতি-বর্ণ নির্বিশেষে লেখাপড়া, কাজ করা, জমি কেনা ও বসত করার অধিকার দিয়েছে ভারতবাসীকে। তার পরেও ২০২২ সাল থেকে নির্যাতিত জামালপুরের দম্পতি রাতে ঘুমোতে পারে না— বেঙ্গালুরুর দুঃস্বপ্ন তাড়া করে। প্রশ্ন স্বাধীন দেশের নাগরিক হয়েও স্বাধীনভাবে বাঁচার জন্যে লড়াই করতে হচ্ছে কেন ? উইচ হান্টিঙের মতো বাংলাভাষী শ্রমিককে বাংলাদেশি প্রতিপন্ন করার পিছনে বাংলাভাষা-বিদ্বেষটাও তো বেশ উঁকি দেয়, তবে গরিব বা শ্রমজীবীরাই ওদের আক্রমণের লক্ষ্য।
এক দেশ এক ভোট বিল পেশ হয়েছে সংসদে— সংসদে ও রাস্তায় বিরোধিতা চলছে। যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো মুছে ফেলে ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণ আরএসএস’র পাখির চোখ। শুধু এটুকুই নয় — এক দেশ, এক দল (ডাবল ইঞ্জিন সরকার) এক নেতা, এক ধর্ম, এক ভাষার আবদার কি নেই নানা ভাষার দেশে? হিন্দির অধিপত্যের চেষ্টা নেই? তাই কি বাংলা ভাষা আজ অপরাধী ? অপরাধের ভাষা হয়ে গেল বাংলা, যে ভাষা একটা রাষ্ট্রগঠন করে ফেলতে পারে, যে ভাষা বিশ্বের ক্যালেন্ডারে মাতৃভাষা দিবস যোগ করতে পারে, যে ভাষায় বিশ্বকবি সাহিত্য নির্মাণ করেছেন, যে ভাষায় জাতীয় সঙ্গীত রচিত হয়েছে, সেই ভাষা হবে লাঞ্ছিত, ব্রাত্য এই ভারতে? রাজ্য সরকার লোক দেখানো একটা মিছিল করেই ক্ষান্ত— তার সাংসদদের হিম্মত নেই বামপন্থী সাংসদ বিকাশ ভট্টাচার্যের মতো শিরদাঁড়া সোজা করে এর প্রতিবাদ করার, আক্রমণ করার ষড়যন্ত্রকারী ঐ শাসকদের বিরুদ্ধে ঐ সংসদেই। বাঙালি অস্মিতা তো নিশ্চয়ই, তার সাথে আক্রান্ত দেশের বহুত্ববাদী ধর্মনিরপেক্ষতা, সম্প্রীতি। এই ঐতিহ্যকে রক্ষার জন্য আরএসএস’র দুর্গা কখনও ভরসার স্থল হতে পারে না। ক্ষমতার জন্যে আরএসএস’র মানস কন্যা দুর্গার অসুর হতে সময় লাগবে না। এরা সাম্প্রদায়িকতার প্রতিযোগিতার ট্র্যাকে এখনই রামনবমীর বিপরীতে হনুমানজী বা পুরীর জগন্নাথের বদলে দীঘার জগন্নাথ, হরিদ্বারের গঙ্গাআরতি বাবুঘাটে এনে ফেলেছে।
ভারতীয় সংস্কৃতির বহুস্বর স্তব্ধ করতে ওরা উন্মত্ত। ভারত কখনও কোনও বহিরাগতকে প্রশ্ন করেনি— ‘‘তুমি কোন কাননের ফুল, কোন গগণের তারা?’’ বিপ্রতীপে, সকলকে বেঁধে বেঁধে রাখতে যত্ন নিয়েছে— ভারতকে সবার পরশে গড়ে ওঠা তীর্থ নীড়ে পরিণত করতে চেয়েছে। তাই, "যুক্ত কর হে সবার সঙ্গে, মুক্ত কর হে বন্ধন"-এর বর্ণময় পতাকা বওয়ার দায়িত্ব আজ বামপন্থী শক্তির, তাকেই বাজপাখির মতো শক্তিধর করে তুলতে হবে এই জাতীয় বিপন্নতার দিনে।
Comments :0