সুস্নাত দাশ
ভারতে সাম্প্রদায়িকতার উদ্ভবে ঔপনিবেশিক শাসকদের ভূমিকা সম্পর্কে সুভাষচন্দ্র বসুর মূল্যায়ন প্রণিধানযোগ্য। বসুর মতে যদিও মুসলিমরা বাইরে থেকে ভারতে প্রবেশ করে সাম্রাজ্য বিস্তার করেছিল এবং ভারতীয় সংস্কৃতি গ্রহণ করেনি; তা সত্ত্বেও তাঁরা ভারতের সঙ্গে একাত্ম হয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু ইংরেজ শাসনে ভারতীয়রা প্রথম অনুভব করেন তারা বিদেশি শাসনের অধীনে রয়েছে।
চিত্তরঞ্জন দাশের কলকাতা মিউনিসিপ্যাল কর্পোরেশনের নির্বাচনে (১৯২৪) জয়লাভ করে মেয়র নির্বাচিত হন। স্বভাবতই কলকাতা কর্পোরেশনের কর্মী নিয়োগে বেঙ্গল প্যাক্টের বাস্তব প্রয়োগের বাধ্যবাধকতা এবং চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হলেন দাশ। সেখানে উল্লেখ করা ছিল, চাকরির ক্ষেত্রে মুসলমানদের ৫৫ শতাংশ নিয়োগ করা হবে। উল্লেখ্য, কর্পোরেশনে কর্মী নিয়োগের অধিকর্তা (দায়বদ্ধতা এবং তদারকি) ছিলেন কর্পোরেশনের চিফ এক্সিকিউটিভ অফিসার পদে নিয়োজিত হয়েছিলেন দাশের সেনাপতি সুভাষচন্দ্র বসু। চিত্তরঞ্জন দাশ (মেয়র) এবং সুভাষচন্দ্র বসুর (চিফ এক্সিকিউটিভ অফিসার) কার্যকালে কলকাতা কর্পোরেশনে মোট ৩৩টি শূন্যপদে (পদগুলি সাধারণ ছিল) কর্মী নিয়োগ করা হয়। যার মধ্যে ২৫টি পদে মুসলিমরা নিয়োজিত হয়েছিলেন। বস্তুত মুসলিমরা নিয়োজিত হলেন ৭৫ শতাংশ যা প্রতিশ্রুত ৫৫ শতাংশ থেকে ২০ শতাংশ বেশি। ফলে দাশ এবং বসুর প্রতি শিক্ষিত মুসলিমদের আস্থা বৃদ্ধি পায়। নিয়োগ পরবর্তীকালে কর্পোরেশন সভায় আক্রমণের জবাবে সুভাষচন্দ্র দৃঢ়তার সঙ্গে বলেন, তাঁর উপর অর্পিত দায়িত্ব সম্পর্কে তিনি সচেতন এবং ব্যক্তিগতভাবে প্রার্থীদের যথার্থভাবে যাচাই করেই নিয়োগ করেছেন। উল্লেখ্য, বেঙ্গল প্যাক্টের রূপায়ণের আগে থেকেই মুসলিম সমাজে সুভাষচন্দ্রের প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। ইংল্যান্ডের যুবরাজের ভারত সফর বয়কট (১৯২১) সফল করতে এন্টালির ঘোড়ার গাড়ির মুসলিম সর্দারদের সাহায্য তিনি নেন। তাঁরা বসুকে যথেষ্ট শ্রদ্ধা করতেন।
রাজনীতির সাম্প্রদায়িকীকরণ ও সুভাষচন্দ্রের দৃষ্টিভঙ্গি
সুভাষচন্দ্র বসু ১৯২৪ সালের ২৫ অক্টোবর গ্রেপ্তার হন। ৬ জুন, ১৯২৫ চিত্তরঞ্জন দাশের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গেই বাংলার স্বরাজ্য দলে তথা রাজনীতিতে বিশৃঙ্খলার আবির্ভাব ঘটে। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিও আলগা হতে থাকে। এ প্রসঙ্গে সুভাষচন্দ্র বসু লিখেছেন, “বাঙলায় ১৯২৬ সালের ইতিহাস প্রধানত হিন্দু-মুসলমান বিরোধের ইতিহাস।” হিন্দু-মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের সাম্প্রদায়িক মনোভাব ১৯২৬ সালে এতটাই বৃদ্ধি পেয়েছিল যা পূর্বে কখনও দেখা যায়নি। বস্তুত দাশের মৃত্যুর পর স্বরাজ্য দলের প্রতি মুসলমানদের আস্থা হ্রাস পায়। তবে চিত্তরঞ্জন দাশের জীবিতকালেই মুসলিমদের একটা অংশ সাম্প্রদায়িক রাজনীতিতে যোগদান করেন। ১৯২৪ সালে ভারতে খিলাফত আন্দোলন প্রাসঙ্গিকতা হারালে খিলাফতিদের একটা অংশ জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে যুক্ত হন। অপর অংশ কিন্তু সাম্প্রদায়িক রাজনীতিতে যোগদান করেন। বস্তুত খিলাফত আন্দোলনকারীদের সরকার-বিরোধী মনোভাব পরিবর্তিত হয়ে হিন্দু-বিরোধিতায় রূপান্তরিত হয়। শুধু তাই নয়, প্রতিনিধিত্বমূলক শাসনব্যবস্থাকে অত্যাচারী হিন্দু শাসন বলে বিবেচনা করতে থাকে। এমনকি, হিন্দুদের সঙ্গে সম্মিলন নয়, আলাদা থাকার প্রবণতাও লক্ষ্য করা যায়। অন্যদিকে মুসলিমদের আস্থা অর্জনের প্রচেষ্টা হিন্দু নেতাদের মধ্যেও দেখা যায়নি। এরূপ পরিস্থিতিতে বাংলার বিভিন্ন স্থানে (১৯২৬) সালে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা শুরু হয়। কলকাতা ২ এপ্রিল দাঙ্গা কবলিত হলো। আর্য সমাজ কর্তৃক আয়োজিত শোভাযাত্রা মসজিদের সামনে দিয়ে যাওয়াকে কেন্দ্র করে দাঙ্গার সূত্রপাত। ১৭ মে খিদিরপুরে দাঙ্গা বাধে।
আলোচ্য সময়কালে সুভাষচন্দ্র বসু সুদূর মান্দালয় জেলে বন্দি ছিলেন। তবে বাংলার পরিস্থিতি সম্পর্কে সম্যক অবহিত ছিলেন। বাংলায় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় মর্মাহত বসু মর্মবেদনা প্রকাশ করে সন্তোষকুমার বসুকে চিঠি লিখলেন (১ এপ্রিল, ১৯২৬)। বস্তুত চিত্তরঞ্জন দাশের মৃত্যুর ১ বছরের মধ্যেই সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় তাঁর হতাশাও গোপন করেননি। প্রয়োজনীয়তা বোধ করেন দাঙ্গার পুঙ্খানুপুঙ্খ কারণ অনুসন্ধানের। একমাত্র সাংস্কৃতিক ঐক্যর মাধ্যমেই গঠনমূলক ঐক্য সম্ভব বলে সুভাষচন্দ্র মনে করেছিলেন। তবে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা কোনও তাৎক্ষণিক ঘটনা বা দুর্ঘটনার পরিণতি বলে তিনি মানতে নারাজ। একই সঙ্গে বাংলার জনগণকে সজাগ হবার আবেদন জানান। বস্তুত আলী ভ্রাতৃদ্বয় এবং স্বামী সহজানন্দর মতো নেতাদের সাম্প্রদায়িক উত্তেজক বক্তব্যগুলি ঠান্ডা মাথায় বিচার-বিশ্লেষণ করে একটা বোঝাপড়ার জন্য জনগণকে তৎপর হবার আহ্বান জানান। তবে হিন্দুদের মধ্যে সাম্প্রদায়িক মনোভাব সৃষ্টিতে মুসলিমদের প্রতিক্রিয়াশীল (সাম্প্রদায়িক) রাজনীতি দায়ী বলে সুভাষচন্দ্র বসু মনে করেন। সুরঞ্জন দাশের গবেষণায় তা সমর্থিত হয়েছে। সুরঞ্জন দাশ তাঁর গবেষণায় দেখিয়েছেন যে মোল্লারা গ্রামে গ্রামে হিন্দু-বিরোধী প্রচার করে মুসলিম জনসমষ্টিকে সংগঠিত করতে সচেষ্ট ছিলেন। প্রতিক্রিয়ায় হিন্দু সংগঠনগুলি (সভা) দ্রুত সাম্প্রদায়িক (Revivalist) হতে থাকে। তবে এই অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতিতে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রাখার প্রচেষ্টাও যথেষ্ট লক্ষ্য করা যায়। বহু হিন্দু এবং মুসলিম ব্যক্তিত্ব ধর্মীয় চেতনার উর্ধ্বে থেকে দাঙ্গা আক্রান্তদের আশ্রয় দিয়েছিলেন। এ প্রসঙ্গে নলিনী শেঠ এবং মৌলভী ওয়াহেদ হোসেনের নাম স্মরণীয়। এছাড়া রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পরিবারও বহু মুসলিমকে উদ্ধার করেছিল। ফলস্বরূপ, অবাঙালি হিন্দুরা তাঁর পরিবারে লুটতরাজ চালায়। দাঙ্গায় কবি কাজী নজরুল ইসলাম অত্যন্ত বিচলিত হন। প্রভাব পড়ল তাঁর লেখনীতে। ১৯২৬ সালে কৃষ্ণনগরে অনুষ্ঠিত বিপিসিসি’র প্রাদেশিক সম্মেলন ছিল গুরুত্বপূর্ণ। সম্মেলনের উদ্বোধনী সঙ্গীতের জন্য কাজী নজরুল ইসলাম রচনা করেন ‘কাণ্ডারী হুশিয়ার’। অন্যদিকে কমিউনিস্ট পার্টির তরফ হতেও ইশ্তেহার বিলি করে আহ্বান জানানো হল সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রাখার।
এরূপ পরিস্থিতিতে সুভাষচন্দ্র বসু বিনা শর্তে (২ মে, ১৯২৭) মুক্তি লাভ করেন। ইতিমধ্যে হিন্দু-মুসলমান সম্পর্ক নিয়ে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন ঘটে গিয়েছে। হিন্দু- মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ই কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে চলতে, বন্ধুত্বপূর্ণ ও আন্তরিক সম্পর্ক পুনঃপ্রতিষ্ঠার আহ্বান সুভাষচন্দ্র জানান (২২ নভেম্বর, ১৯২৭)। অন্যদিকে হিন্দু মহাসভার সভাপতি বালাকৃষ্ণ শিবরাও মুঞ্জের বক্তব্যের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ তিনি জানান। যদিও পাশাপাশি হিন্দু মহাসভার সমাজ উন্নয়ন এবং ধর্মসংস্কারমূলক কাজের প্রশংসা করেন। রাজনৈতিক কার্যাবলীতে হিন্দু মহাসভার হস্তক্ষেপের সুভাষচন্দ্র বিরোধী ছিলেন। প্রকৃতপক্ষে, হিন্দু- মুসলমান সমস্যা ধর্মীয় আবেদনে নয়, রাজনৈতিকভাবে সমাধানে সুভাষচন্দ্র বসু আগ্রহী ছিলেন। উল্লেখ্য, ১৯২৭ সালের নভেম্বরে সুভাষচন্দ্র বসু বিপিসিসি’র সভাপতির দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। সুভাষচন্দ্র বসু ১৯৩০ সালে কলকাতা কর্পোরেশনের মেয়র নির্বাচিত হন। মেয়র সুভাষচন্দ্র বসু মুসলিমদের আস্থা অর্জনে সচেষ্ট ছিলেন। তিনি সমালোচকদের স্মরণ করিয়ে দিলেন ১৯২৪ সালে মুসলিম স্বার্থ রক্ষায় (চিফ এক্সিকিউটিভ অফিসার হিসাবে) তাঁর ভূমিকা। ইতিপূর্বেই রংপুর রাজনৈতিক সম্মেলনে সাহিত্যে উভয় সম্প্রদায়ের ঐক্যের কথা উল্লেখ করে, বাংলা সাহিত্যে মুসলমানদের অবদানও স্বীকার করেন। এতে হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের বার্তাই তিনি দিলেন। তবে সাম্প্রদায়িক রাজনীতির প্রতি কংগ্রেসের উদাসীন মনোভাবকে পরবর্তীকালে বসু কটাক্ষ করেন।
বঙ্গদেশে কংগ্রেস সভাপতি সুভাষচন্দ্র
১৯৩৫ সালে ফজলুল হক কলকাতা কর্পোরেশনের মেয়র নির্বাচিত হলে বসু ভিয়েনা থেকে শুভেচ্ছা বার্তা পাঠিয়েছিলেন। তবে নির্বাচনোত্তর পর্বে, এমনকি প্রয়োজনে জোট করে, সরকার গঠনে বসু আগ্রহী ছিলেন। বস্তুত জোট মন্ত্রীসভা গঠনে মুসলিম লিগের সঙ্গে আলোচনায় হিন্দু-মুসলমান সমস্যা সমাধানের সম্ভাবনা ছিল। বস্তুত সুভাষচন্দ্র বসুর বিশ্বাস ছিল অভিন্ন আর্থ-সামাজিক কর্মসূচির ভিত্তিতে বঙ্গদেশ ঐক্যবদ্ধ হবে। এমনকি, হিন্দু-মুসলমান জনসাধারণকেও একসঙ্গে মেলাবে। বাঙালিদের কারও কারও মধ্যে সাম্প্রদায়িকতার গভীরতা স্বীকার করে নিয়েও কংগ্রেস সাম্প্রদায়িকতা রোধ করবে— এ নিশ্চয়তা সুভাষচন্দ্র দিয়েছিলেন। তিনি আহ্বান জানালেন মুসলিম এবং তফসিলি জাতিভুক্ত ব্যক্তিদের কংগ্রেসে যোগদান করার। এসময়ে সুভাষচন্দ্র বসু একই সঙ্গে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস এবং বঙ্গীয় প্রাদেশিক কংগ্রেস কমিটির সভাপতি ছিলেন (১৯৩৮)। বিপিসিসি’র সভাপতিরূপে ৮ থেকে ২০ জুন পূর্ববঙ্গ সফর করেন। সফর শেষে তাঁর প্রত্যয় জন্মায়, বাংলার মুসলিমরা শীঘ্রই কংগ্রেসে যোগদান করবেন। যদিও কয়েকটি স্থানে তাঁকে কালো পতাকা দেখানো হয়েছিল, তথাপি হিন্দু-মুসলমান সমস্যাকে সুভাষচন্দ্র ধর্মের ভিত্তিতে নয়, অর্থনৈতিক প্রেক্ষিতে ব্যাখ্যা করেছেন। তিনি মনে করতেন, “একজন মুসলমান কৃষক এবং একজন মুসলমান জমিদারের মধ্যে যতটা মিল তার চেয়ে ঢের বেশি মিল একজন মুসলমান কৃষক এবং একজন হিন্দু কৃষকের মধ্যে।” ধর্ম নয়, অর্থনৈতিক অবস্থাই বসুর ব্যাখ্যায় প্রাধান্য পেয়েছে।
উল্লেখ্য, ইংরেজদের বাংলা সরকার ১৯২৪ সাল থেকেই কংগ্রেসকে হিন্দু প্রতিষ্ঠান বলে অভিযোগ করেছেন। অভিযোগগুলির যথাযথ জবাব সুভাষচন্দ্র দিয়েছিলেন ১৯৩৮ সালে। আর দায় চাপালেন সাম্প্রদায়িক মুসলমানদের উপর। কুমিল্লা জনসভায় সুভাষচন্দ্র বলেন, “প্রত্যেকেরই কংগ্রেসের নেতৃত্ব গ্রহণের অধিকার আছে। হিন্দুরা যদি আজ কংগ্রেসে সংখ্যাধিক হইয়া থাকেন তাহার জন্য দায়ী সেই সব মুসলমান যাঁহারা মুসলমান জনসাধারণের কংগ্রেসে যোগদানের পথে বাধার সৃষ্টি করেন। মুসলমানরা অগ্রসর হইয়া আসুন এবং স্বাধীনতার আন্দোলন পরিচালনা করুন। আমি বঙ্গীয় প্রাদেশিক কংগ্রেস কমিটির সভাপতির পদ ত্যাগ করিতে এবং তাহাদের হাতে সে দায়িত্ব তুলিয়া দিতে প্রস্তুত আছি।” ময়মনসিং টাউন হলে ১৭ জুন, ১৯৩৮ তারিখের বক্তৃতাটিও অনুরূপ। সাম্প্রদায়িকতার মোকাবিলায় এমন উদার এবং সাহসী বক্তৃতা আর কে দিতে পেরেছেন? উল্লেখ্য, ১৯২৮ সালেই সুভাষচন্দ্র ভারত ইতিহাসের অপ-ব্যাখ্যার জন্য বিদেশি ঐতিহাসিকদের দায়ী করেন।
সুভাষচন্দ্রর সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দৃষ্টান্ত
তবে রাজনৈতিক জীবনের অন্তিমপর্বে সুভাষচন্দ্র বসু সাম্প্রদায়িক সমস্যা সমাধানে গভীরভাবে নিমগ্ন হন। ১৯৩৮ সালে লিগ সভাপতি জিন্নার সঙ্গে হিন্দু-মুসলমান সমস্যা সমাধানে পত্রালাপ করেন। তবে মুসলিম লিগ ‘ভারতের মুসলমানদের প্রামাণিক এবং প্রতিনিধিস্থানীয় সংগঠন' এবং কংগ্রেস কর্তৃক নিয়োজিত কমিটিতে কোনও মুসলমান অন্তর্ভুক্ত হবে না– এরূপ দাবির তীব্র প্রতিবাদ (যদিও ওয়ার্কিং কমিটির নামে) জানান। অন্যদিকে ইউরোপে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ আরম্ভ হয় ৩ সেপ্টেম্বর, ১৯৩৯। ইতিমধ্যে সুভাষচন্দ্রকে কংগ্রেস হতে বহিস্কৃত হয়েছেন ১১ আগস্ট, ১৯৩৯। তাসত্ত্বেও বিশ্বযুদ্ধের সুযোগ কাজে লাগাতে সুভাষচন্দ্র বসু কংগ্রেসকে (সরাসরি গান্ধীজীকে) অনুরোধ করেন। কিন্তু কংগ্রেসের দিক হতে কোনও ইতিবাচক সাড়া পেলেন না। অবশেষে মুসলিম লিগ সভাপতি জিন্না এবং হিন্দু মহাসভার সভাপতি সাভারকারের সঙ্গেও দীর্ঘ আলোচনা করেন। এমনকি, স্বাধীন ভারতবর্ষে জিন্নাই প্রধানমন্ত্রী হবেন— এরূপ প্রস্তাব পর্যন্ত দিয়েছিলেন বলে জানা যায়। প্রস্তাবটি ২ বছর পূর্বে কুমিল্লায় প্রদত্ত বসুর বক্তৃতার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ।
কলকাতা কর্পোরেশন নির্বাচন পরিচালনার জন্য মহানগরীর জনগণের বৃহত্তর স্বার্থে বসু হিন্দু মহাসভা এবং মুসলিম লিগ উভয় সংগঠনের সহযোগিতা চান। এমনকি, নির্বাচনোত্তর পর্বেও হিন্দু মহাসভার সঙ্গে জোটবদ্ধ হতে উদ্যোগী হন। কিন্তু প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়। অবশেষে মুসলিম লিগের সঙ্গে জোটবদ্ধ হলেন। তবে তাঁর এই পদক্ষেপে হিন্দু নেতাদের সঙ্গে সঙ্গে সুভাষ-সমর্থক মুসলিমরাও অসন্তুষ্ট হন। বস্তুত সুভাষচন্দ্র সাম্প্রদায়িক দলগুলিকে স্বাধীনতা সংগ্রামের মূলস্রোতে (কংগ্রেসের পতাকাতলে) শামিল করতে সচেষ্ট ছিলেন। কর্পোরেশনে ইউরোপীয়দের প্রাধান্য পুনঃপ্রতিষ্ঠা প্রতিরোধে ইহা অপেক্ষা উত্তম পন্থা আর কি ছিল, এটা অনেকে মনে করলেও, সুভাষচন্দ্রর এটা ছিল একধরনের দুর্বলতা বা সীমাবদ্ধতা।
সুভাষচন্দ্র বসু ৩ মে, ১৯৩৯ সালে ফরোয়ার্ড ব্লক গঠন করেন। কংগ্রেস থেকে বহিস্কৃত হয়েছিলেন ১১ আগস্ট, ১৯৩৯। ঠিক একবছর পরে (১১ আগস্ট, ১৯৪০) ফরওয়ার্ড ব্লক পত্রিকায় কংগ্রেসকে সংগ্রাম আরম্ভ করতে অনুরোধ করা হলো। আশা প্রকাশ করা হয় শক্তিশালী কর্মসূচির দ্বারাই কংগ্রেসে ঐক্য সাধিত হবে; সম্ভব হবে দৃঢ় এবং স্থায়ী ভিত্তিতে হিন্দু-মুসলমান সমস্যার সমাধান হবার। যদিও ইতিপূর্বেই সুভাষচন্দ্র হিন্দু-মুসলমান ঐক্য প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে ৩ জুলাই, ১৯৪০ তারিখে ‘সিরাজদৌল্লা দিবস' পালনের ডাক দিয়েছিলেন। শেষপর্যন্ত ২ জুলাই, ১৯৪০ সুভাষচন্দ্রকে গ্রেপ্তার করা হলো। একাধিকবার সুভাষচন্দ্র নিজস্ব অভিমত পোষণ করে বলেছিলেন, ধর্ম যার যার নিজস্ব পালনীয় বিষয়, রাজনৈতিক বা সামাজিক পরিসরে তাকে টেনে আনা অনুচিত। বাংলার নির্বাচনী ক্ষেত্রে নির্বাচকমণ্ডলীকে তিনি সতর্ক করে গেরুয়া বেশধারী হিন্দুমহাসভার কর্মীদের সর্ম্পকে বলেছিলেন, তাদের হিন্দুত্ববাদী প্রচারে কেউ যেন কর্ণপাত না করেন। গোপনে দেশ ছেড়ে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে অন্তিম সমরে যাওয়ার আগে সুভাষচন্দ্র আরএসএস নেতা সাভারকারের সমর্থন লাভের প্রচেষ্টা চালিয়েছিলেন এটা ঠিক! কিন্তু তার উপযুক্ত মর্যাদা সাভারকার দেননি। সুভাষচন্দ্রর সঙ্গে সাভারকার বিশ্বাসঘাতকতা করেছিলেন; সাভারকার-শ্যামাপ্রসাদ সকলেই দ্বিতীয়-বিশ্বযুদ্ধে ব্রিটিশদের সঙ্গে হাত মিলিয়েছিলেন।
নেতাজি সুভাষ এবং আইএনএ’র ধর্ম নিরপেক্ষতা
বস্তুত চিত্তরঞ্জন দাশ পরবর্তীকালে মুসলিম সমর্থন বা আস্থা সুভাষচন্দ্র অপেক্ষা বেশি অন্য কোনও নেতা, বিশেষ করে বাংলায়, পাননি। আর আইএনএ পর্বে বসুর প্রতি মুসলিমদের সুগভীর আস্থার বিবরণ পাওয়া যায় আইএনএ-র তিন মুসলিম অফিসার শাহনওয়ান খান, আবিদ হাসান এবং এমজেড কিয়ানির স্মৃতিচারণে। অন্যদিকে বিপানচন্দ্র অভিযোগ করেছেন, অন্যান্য নেতাদের মতো সুভাষচন্দ্র বসুও কংগ্রেসের কর্মকাণ্ডে হিন্দু প্রতীক ব্যবহার করতেন। শাহনওয়াজ খান এবং আবিদ হাসানের বিবরণে কিন্তু অভিযোগটি সমর্থিত নয়। আবিদ হাসান লিখেছেন, “নেতাজী ধর্মকে সম্পূর্ণরূপে জাতীয়তাবাদ হতে পৃথক রেখেছিলেন। যদিও তিনি নিজে প্রচণ্ড ধর্মপ্রাণ ছিলেন, কিন্তু জনসমক্ষে কোনও প্রকার ধর্মীয় প্রার্থনা অনুমোদন করতেন না” শাহনওয়াজ খান লিখেছেন, “ধর্ম সম্বন্ধীয় বা প্রাদেশিক ভেদাভেদ তাঁর কাছে কিছুমাত্র ছিল না। এসব তিনি আমলই দিতেন না। হিন্দু, মুসলিম শিখ সবাইকে তিনি সমান চোখে দেখতেন এবং এইভাবই সমগ্র আজাদ হিন্দ ফৌজকে অনুপ্রাণিত করেছিল। আজাদ হিন্দ দলে ধর্মগত বা সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষের নামগন্ধ ছিল না, অথচ প্রত্যেক লোকেরই নিজ নিজ ধর্মমত অনুসারে উপাসনা করার অধিকার ছিল।” মুসলিমদের সহযোগিতায় সুভাষচন্দ্রও অভিভূত হয়েছেন। ঘোষণা করেন, “সারা পৃথিবী জানুক এবং আমাদের শত্রুরা জানুক যে পূর্ব এশিয়ায় ধর্ম-জাতি নির্বিশেষে সকল ভারতীয় ঐক্যবদ্ধ এবং তাঁহাদের সাধারণ মাতৃভূমির স্বাধীনতার জন্য সংকল্পবদ্ধ।” উল্লেখ্য, আইএনএ’র সৈন্যদের (হিন্দু ও মুসলমানদের) জন্য একত্রে থাকা এবং খাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। বস্তুত সুভাষচন্দ্র সাম্প্রদায়িকতাকে স্বাধীনতা প্রাপ্তির পথে অন্তরায় বিবেচনা করলেও সমস্যা মনে করেননি। স্মরণ করে দিয়েছেন সোভিয়েত রাশিয়ার কথা। সোভিয়েত রাশিয়া যদি একাধিক ধর্মাবলম্বীদের এক রাষ্ট্র এবং শাসনের অধীনে রাখতে সমর্থ হয় ভারতবর্ষে সম্ভব নয় কেন? মুক্ত কণ্ঠে তিনি ঘোষণা করেন, “স্বদেশপ্রেমিক মুসলমান ও স্বদেশপ্রেমিক হিন্দুর মধ্যে কোনও তফাৎ নেই”। বসুর ভাষণের যথার্থতার প্রমাণ পাওয়া গেল হাবিবের মধ্যে। নেতাজী আকর্ষণে (মাতৃভূমির মুক্তির আকাঙ্ক্ষাও অবশ্যই ছিল) নেতাজীর গলার মালা ক্রয়ে সর্বস্ব দান করেন। দানের মূল্য প্রায় ১ কোটি টাকা। এমনকি, স্ত্রী-পুত্র সহ নিজেও আইএনএ-তে যোগদান করেন।
সুভাষচন্দ্র বসু তাঁর অসমাপ্ত আত্মজীবনী ভারত পথিক-এ লিখেছেন যে ছোটবেলায় (কটক বসবাসকালে) ) মুসলিম প্রধান অঞ্চলে বাস, তাদের সঙ্গে গভীরভাবে মেলামেশা, বন্ধুত্ব স্থাপনের এবং সাংস্কৃতিক দিক থেকে মুসলমানদের কাছাকাছি আসার সৌভাগ্য সুভাষচন্দ্রের হয়েছিল। তাঁর ভাষায়, “বস্তুত: আমার মনে হয় না যে মসজিদে গিয়ে নামাজ পড়া ছাড়া আর কোনভাবে তাদের নিজেদের চাইতে পৃথক মনে করেছি।” শুধুমাত্র বাল্য বা কৈশোরেই নয়, রাজনৈতিক জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তার প্রমাণ তিনি দিয়েছেন। জার্মানি হতে জাপান সাবমেরিন যাত্রাকালে তাঁর সঙ্গী ছিলেন আবিদ হাসান। আইএনএ সিক্রেট সার্ভিসে বহু মুসলমানকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। তাঁদের ভারতবর্ষে পাঠানো হয়েছিল মুসলিমদের মধ্যে ব্রিটিশ-বিরোধী প্রচার চালানোর জন্য। জীবনের শেষ বিমান যাত্রায় একমাত্র সঙ্গী হিসাবে নির্বাচন করেন হাবিবুর রহমানকেই। যাত্রাপূর্বেই আজাদ হিন্দু সরকারের দায়িত্ব (তাঁর অনুপস্থিতিতে) অর্পণ করেন এমজেড কিয়ানিকে। আইএনএ’র চরম আর্থিক দুর্দিনেও মুসলিম পরিষদদের মন্দিরে প্রবেশের অনুমতি না মেলায় চেট্টিয়ার সম্প্রদায়ের আর্থিক দান গ্রহণে অসম্মত হন। ধর্ম নিরপেক্ষতার এমন উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত সুভাষচন্দ্র বসু ব্যতীত আর কোনও জাতীয় স্তরের স্বাধীনতা সংগ্রামের নেতা স্থাপন করেছেন কি?
Comments :0