Post editorial

হোয়াট ইজ টু বি ডান ইন এডুকেশন

উত্তর সম্পাদকীয়​

দেবাঞ্জন দে

"জ্ঞান যেথা মুক্ত, যেথা গৃহের প্রাচীর
আপন প্রাঙ্গণতলে দিবসশর্বরী
বসুধারে রাখে নাই খণ্ড ক্ষুদ্র করি,
যেথা বাক্য হৃদয়ের উৎসমুখ হতে
উচ্ছ্বসিয়া উঠে, যেথা নির্বারিত স্রোতে
দেশে দেশে দিশে দিশে কর্মধারা ধায়
অজস্র সহস্রবিধ চরিতার্থতায়--
যেথা তুচ্ছ আচারের মরুবালুরাশি
বিচারের স্রোতঃপথ ফেলে নাই গ্রাসি..."
অতএব বসুধাকে খণ্ড ক্ষুদ্র করে, গৃহের প্রাচীরের আবদ্ধতায় মানবচেতনাকে ক্ষুদ্রতর, সংকুচিত করে দেওয়া জন্য প্রথম পূর্বশর্ত জ্ঞানকে বন্দিশালায় পাঠানো। এতে হৃদয়ের উৎসমুখের ওপরও নিয়ন্ত্রণ কায়েম করা যায়, কর্পোরেট মুনাফার চরিতার্থতায় পরিচালিত করা যায় কর্মধারা। সাথে বিচারবুদ্ধি প্রতিস্থাপিত করা যায় মিথ্যা আচার, যুক্তিহীন আচরণ দিয়ে। সবমিলিয়ে চিত্তকে ভয়পূর্ণ আর শিরকে অস্থির রাখতে জ্ঞানের ওপর সর্বোচ্চ নিয়ন্ত্রণ প্রয়োজন পুঁজিবাদের। 
সেই প্রয়োজনীয়তা থেকেই শাসক তার শিক্ষানীতি প্রস্তুত করে। শাসকের শিক্ষানীতি চিরকালই শাসকশ্রেণির পরিকল্পিত এজেন্ডার প্রতিফলনেই প্রস্তুত হয়। লক্ষ্য থাকে শাসকের পছন্দমতো ভবিষ্যৎ মানবসম্পদ গড়ে তোলার। নয়া জাতীয় শিক্ষানীতিও ঠিক সেরকমই আরএসএস-বিজেপি'র কর্পোরেট-কমিউনাল অক্ষের দ্বারা পরিচালিত সরকারের শিক্ষার প্রতি মনোভাব ও নির্দিষ্ট ধাঁচের নিয়ন্ত্রিত মানবসম্পদ নির্মাণ করার লক্ষ্যেই তৈরি করা ব্লুপ্রিন্ট। একদিকে বিশাল অংশের গরিব মধ্যবিত্ত মানুষকে পড়াশোনার মূলস্রোতের বাইরে রাখা আবার অন্যদিকে যে অংশের মানুষ এই অর্থনৈতিক বৈষম্য পার করেও পড়াশোনার স্রোতে এগোতে পারছে তাদেরও একটা নির্দিষ্ট কর্পোরেটবান্ধব ধাঁচে গড়ে তোলা একদম প্রাথমিক স্তর থেকে- এটাই বর্তমান প্রচলিত সরকারি শিক্ষানীতির মূল দুটো অভিমুখ।
প্রথমটা চরিতার্থ করার প্রধান উপায় শিক্ষার ওপর থেকে সরকারি নিয়ন্ত্রণ ও দায়বদ্ধতা ক্রমশ কমিয়ে আনা। গত কয়েকবছরে সরকারি বাজেটে পাবলিক এডুকেশনের জন্য ব্যয়বরাদ্দের ছবিটা দেখলেই এটা স্পষ্ট হয়ে যায়। প্রতিবছর নিয়ম করে সরকারি পড়াশোনার খাতে খরচ কমানো হয়েছে। বিগত কেন্দ্রীয় বাজেটেই উচ্চশিক্ষায় এক ধাক্কায় কমানো হয়েছে ৯৬০০ কোটি টাকা! কোভিড পরবর্তী অর্থনৈতিক বৈষম্যের মধ্যে ব্যাপক মূল্যবৃদ্ধির বাজারে সেই নিরিখেই স্কুলশিক্ষায় বরাদ্দ কমেছে প্রায় ০৫ শতাংশ। ইউজিসি'র বরাদ্দ কমানো হয়েছে প্রায় ৬০ শতাংশ। কারিগরি শিক্ষায় কমানো হয়েছে প্রায় ৬০০০ কোটি টাকা। একই ছবি রাজ্য বাজেটেও। স্কুলশিক্ষায় ৭০০ কোটি টাকা বরাদ্দ কমেছে। রাজ্যের কারিগরি শিক্ষায় কমানো হয়েছে ১৯ কোটি টাকা। লক্ষ্য একটাই পড়াশোনার ক্ষেত্রকে ঢালাও বেসরকারি পুঁজির জিম্মায় পাঠিয়ে দেওয়া। পড়াশোনার কেন্দ্র অর্থাৎ ক্যাম্পাসের নিয়ন্ত্রণ সরকারি থেকে বেসরকারি করে দেওয়ার পরিকল্পনা। স্বাভাবিকভাবেই শিক্ষার জন্য সরকারি ভরতুকি যতো কমবে ততোই বাড়বে পড়াশোনার খরচ। ক্রমশ কমতে থাকা ক্রয়ক্ষমতার বাজারে শিক্ষা আর মৌলিক চাহিদার বস্তু হয়ে টিকে থাকবে না জনমানসে— এটাই সরকারের মূল চাহিদা। এরই গালভরা নাম কখনো মোদী-শাহের এনইপি, আবার কখনো মমতা-ব্রাত্যর পিপিপি। এই মডেল কায়েম করতে পারলে ক্যাম্পাস যা কিনা দেশের সর্বোচ্চ সংখ্যক জনতার মতামত গঠনের অন্যতম প্রধান কেন্দ্র তার ওপর সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক দখলদারি নিশ্চিত করে নিষ্ক্রিয় করে রাখা যাবে দেশের, রাজ্যের তরুণ প্রজন্মের মন, মগজ, চিন্তনপ্রক্রিয়াকে। একটা অংশ তলিয়ে যাবে না জানার অন্ধকারে, আরেকটা অংশ ঠিক ততোটাই জানবে যতোটা চাইবে সরকার! জানার সিলেবাস নিয়ন্ত্রিত হবে ডিরেক্ট নাগপুরের আরএসএস'এর হেডকোয়ার্টার থেকে। কর্পোরেট মুখ ও সাম্প্রদায়িক মগজসম্পন্ন একটা প্রজন্ম এগিয়ে যাবে ধান্দার ধনতন্ত্রের ভবিষ্যৎ মুনাফার পাহাড় ও ফ্যাসিস্ত হিন্দু রাষ্ট্রের প্রোপাগান্ডার উপত্যকা গড়ে দেওয়ার লক্ষ্যে। 
এই মডেলের ওপর দাঁড়িয়েই আমাদের রাজ্যে বন্ধ হয়েছে ৮০০০ প্রাথমিক স্কুল। কেন্দ্রের রিপোর্ট বলছে প্রায় ৩৫০০ স্কুলে পড়ুয়ার সংখ্যা শূন্য! প্রায় ৬৫০০ স্কুল চলছে মাত্র একজন শিক্ষক দিয়ে। এসব দেখে রাজ্য সরকারের মতামত তারা আরও ৩০০০ স্কুল বন্ধ করে মার্জারের দিকে এগোবে! মানে মৃতপ্রায় মানুষকে ওষুধ দেওয়ার বদলে বিষ দিয়ে তার মৃত্যু নিশ্চিত করা।  স্কুল পরিচালনার জন্য কম্পোজিট গ্রাউন্ডের টাকা বন্ধ হয়ে গেছে সরকারি তহবিল থেকে। স্কুলের চক ডাস্টার, বেঞ্চ-টেবিল, মিড ডে মিলের বাসন থেকে সিভিক শিক্ষকের মাইনে সবটা তুলতে হচ্ছে ছাত্রদের ওপর মাইনের বোঝা বাড়িয়েই। সরকারি নোটিস ২৪০টাকার ফি'র বদলে স্রেফ স্কুল টিকিয়ে রাখতে একেকটা স্কুল একেকরকমের মাইনে নিচ্ছে। কোথাও কোথাও নির্ধারিত ফি'র প্রায় দশগুণ বেশি! যেখানে সরকারি ভরতুকি বাড়িয়ে স্কুলছুট ছেলেমেয়েদের স্কুলমুখী করাটাই সময়ের ডাক সেখানে ভরতুকি বন্ধ করে স্কুলছুট বাড়ানোর কাজে সাহায্য করছে সরকার। 
এই মুহূর্তে রাজ্যের স্কুল ক্যাম্পাসে ক্যাম্পাস প্রতি সামগ্রিক গড় ছাত্র সংখ্যা  ১৯২, গড় শিক্ষক সংখ্যা ৬! ছাত্র শিক্ষক অনুপাত এক্ষেত্রে ৩২:১। তবে এটা খাতায় কলমে তথ্য হিসাবেই রয়ে গেছে। যে ৬৫০০ স্কুল চলছে একজন শিক্ষক দিয়ে সেখানেও গড় ছাত্র সংখ্যা একইরকম। অর্থাৎ অনুপাত ১৯২:১! আজকের সময়ের নিরিখে এই অনুপাত অন্ততপক্ষে ২০:১ অনুপাতে না আনতে পারলে কোনোভাবেই স্কুলশিক্ষার কাঠামোকে রক্ষা করা সম্ভব নয়। অথচ ছাত্র শিক্ষক অনুপাতে ভারসাম্য না এনেই লাফালাফি চলছে গালভরা সেমিস্টার সিস্টেম নিয়ে। দুনিয়ার নানা দেশে সেমিস্টার প্রক্রিয়া সাফল্য পেয়েছে ছাত্র-শিক্ষক অনুপাতের ইতিবাচক পরিসংখ্যানের ওপর দাঁড়িয়ে। কিন্তু যে রাজ্যের হাজার হাজার স্কুল হানাবাড়িতে পরিণত, যেখানে প্রায় সাড়ে ছ'হাজার স্কুলে শিক্ষকের সংখ্যা মাত্র এক, যেখানে স্কুলে স্কুলে অঙ্ক করান যিনি, তিনিই আবার ইতিহাসও পড়ান, আবার তিনিই বাংলা সাহিত্যের পাঠ দেন, আবার তিনিই মিড ডে মিলের খাবার বিলি করেন, আবার তিনিই কোথাও কোথাও রান্নাটাও করেন, যেখানে টিচার্স ট্রেনিংয়ে জুতো সেলাই থেকে চণ্ডীপাঠটাই মূল পাঠক্রম পড়ানোর পদ্ধতিগত শিক্ষা বাদ দিয়ে, যেখানে ভবিষ্যতের টিচারদের জীবনের মূল সময়টাই কেটে যায় পরীক্ষার মেরিট লিস্ট বা ওয়েটিং লিস্টে নাম আর চাকরির চিঠির জন্য আন্দোলনে ঘাম ঝরিয়ে, সেখানে সেমিস্টার পদ্ধতি কোনও স্তরেই কোনোদিনই সাফল্য আনতে পারে না সেটা মানুষমাত্রই বোঝে। বোঝে না শুধু মানুষকে মানুষ না মনে করা সরকার।
সীমাহীন ড্রপ আউটের ওপরে দাঁড়িয়ে গোটা রাজ্যের শিক্ষার ধাঁচাটা। সেই ড্রপ আউটের কোনও স্পষ্ট পরিসংখ্যান নেই রাজ্যের সরকারের কাছেও। অথচ সরকারি বাজেট অনুযায়ী ২০১৮ সালে মিড ডে মিল প্রাপকের সংখ্যা ছিল ১.১৮ কোটি। ছ'বছর বাদে ২০২৪ সালেও সংখ্যাটা হুবহু এক! হিসাব করলেই বোঝা যায় এই সরকারি তথ্যই দেখিয়ে দিচ্ছে গত বছর ছয়েকে ড্রপ আউটরের সংখ্যা কম করে হলেও ছ'কোটি! স্বভাবতই সরকারের নেই ড্রপ আউটদের ক্লাসে ফেরানোর কোনও নির্দিষ্ট পরিকল্পনা। আছে শুধু সরকারি ক্লাসরুম বেচে দিয়ে, বেসরকারি ক্লাসরুম আর সরস্বতী/একল বিদ্যামন্দিরের ক্লাসরুমের নির্দিষ্ট বাজার গড়ে দেওয়া। ড্রপ আউট সমস্যা গত এক দশকে পরিণত হয়েছে সামাজিক সঙ্কটে। নির্দিষ্ট পরিকল্পনা ব্যতীত এই সঙ্কট থেকে বেরোনোর উপায় নেই। সরকারি পড়াশোনার পরিকাঠামোগত হাল ফেরাতে না পারলে মানুষের আগ্রহ স্বাভাবিকভাবেই কমে যাবে সামগ্রিক শিক্ষাব্যবস্থাটার প্রতি। জনমুখী ও জনবিরোধী শিক্ষাব্যবস্থার পার্থক্য এখানেই। রাজ্যের সরকার ঠিক এই মনোভাবেরই সুযোগ নিচ্ছে। এমনভাবে শিক্ষার আঙিনাকে দুর্নীতি ও বেসরকারি মোড়কে মুড়ে রাখা হচ্ছে যাতে সাধারণ জনতার তার সাধ্যের বাইরে থাকা শিক্ষা নিয়ে একটা সার্বিক অনাগ্রহ, হতাশা, অপরিণামদর্শীতা তৈরি হয়। পড়াশোনাটা আর গুরুত্বপূর্ণ নয়- এই চিন্তাপ্রক্রিয়াটা ম্যানুফ্যাকচার হয়ে যায় সামাজিক প্রতর্কের মধ্যে। 
উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রেও নতুন করে পূর্ণাঙ্গ কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের কোনও সন্ধান নেই গত এক দশকে। গালভরা প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়নের জায়গায় খোঁজ নিলেই পাওয়া যায় জেলায় জেলায় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ধ্বংসস্তূপের খোঁজ। সমস্ত স্বনামধন্য কলেজের অনার্সের সিট ফাঁকা পড়ে থাকছে বছরের পর বছর। বন্ধ হয়ে যাচ্ছে একের পর এক ঐতিহ্যশালী ডিপার্টমেন্ট। ছাত্রের অভাবে, শিক্ষকের অভাবে- প্রথমটার কারণ ড্রপ আউট, পরেরটা দুর্নীতি। সরকারি ভরতুকিযুক্ত কোর্সের জায়গা নিচ্ছে সেল্ফ ফিনান্সর্ড কোর্স কারিকুলাম। যেখানে ছাত্রের টাকাতেই ডিপার্টমেন্ট চলছে, মাইনে হচ্ছে গেস্ট ফ্যাকাল্টিদের। যদি মাছের তেলেই মাছ ভাজতে হয় তাহলে আর ভোট দিয়ে মাছচাষের জন্য সরকার নামক বৃহৎ জলাশয়টাকে নির্বাচিত করার মানেটা কি! 
ফলাফল স্বরূপ যাহোক করে উচ্চ মাধ্যমিক স্তর পার করলেও একটা ব্যাপক অংশের ছেলেমেয়ে উচ্চশিক্ষার দিকে আর এগোচ্ছেই না। চটজলদি রোজগারের জন্য পাড়ি দিচ্ছে ভিনরাজ্যের কাজের সন্ধানে। কাজের সম্ভাবনা কমে যাওয়া বা প্রায় শূন্য হয়ে যাওয়া আমাদের রাজ্যে যে ভবিষ্যতের নিরাপত্তাহীনতা গড়েছে তরুণ প্রজন্মের মনে তাতে উচ্চশিক্ষার প্রতি স্বাভাবিক অনাগ্রহ তৈরি হয়ে গেছে সমাজের সমস্ত স্তরে। একটা বড়ো অংশ অন্য রাজ্যে বা দেশে চলে যাচ্ছে পরিযায়ী শ্রমিক হয়ে, আরেকটা ছোট অংশ অন্য রাজ্যে বা দেশে পরিযায়ী শ্রমিক হওয়ার ট্রেনিং নিতে চলে যাচ্ছে পরিযায়ী ছাত্র হয়ে। দেশের বেশিরভাগ কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের একটা বড়ো অংশের ছাত্র-ছাত্রীর পার্মানেন্ট রেসিডেন্স তাই বাংলার ঠিকানাই। অথচ বাংলার ক্লাসরুমে তারা আগ্রহী হতে পারেনি! 
ক্যাম্পাসের পরিকাঠামোগত উন্নতিতে সরকারি টাকা খরচের বদলে সেই টাকা আত্মসাৎ করছে ক্যাম্পাসের ভেতর সরকারি মদতেই গড়ে রাখা থ্রেট ও দুর্নীতি সিন্ডিকেট। শাসকদলের মাতব্বররা সেসব সিন্ডিকেটের মূল মাথা, মুখ ক্যাম্পাসের ভেতর কাঁচা টাকার লোভ দেখিয়ে অপরাধ চক্রে নাম লেখানো গরিব বাড়ির ছেলেমেয়েরা। চাহিদার ইঁদুরদৌড়ে অর্থনীতির চাকার তলায় পিষতে পিষতে যারা সাইকেল থেকে মোটরবাইকে উত্তীর্ণ হওয়ার সহজতম উপায় হিসাবে জানে কলেজে গিয়ে অ্যাডমিশন সিন্ডিকেটের অংশ হয়ে যাওয়া! এই সিন্ডিকেটের দ্বারাই সরকারি অনুদানের বড়ো অংশের ঘুরপথে শাসকদলের অ্যাকাউন্টে চালানের মসৃণ সিস্টেম পরিচালিত হয় সরাসরি নবান্ন-কালীঘাট সূত্রে। এই সিন্ডিকেট কায়েম রাখতেই স্কুল পরিচালন সমিতির নির্বাচন বন্ধ। কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র সংসদ নির্বাচন বন্ধ।

গবেষণার জায়গাতেও বন্ধ সরকারি অনুদান। কেন্দ্রের সরকার টাকা দেবে কেবলমাত্র আরএসএস'এর প্রকল্পকে পুষ্ট করে এমন গবেষণা খাতে। সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক প্রগতির পক্ষে সহায়ক এমন কোনও গবেষণার জন্য অনুদান নেই! রাজ্যের সরকার টাকা দিতে নারাজই শুধু নয়, যা টাকা দেয় তাতে ফিল্ডওয়ার্কের যাতায়াত খরচটুকুও ওঠে না গবেষকদের। জায়গা করে নিচ্ছে বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো- টাকার বিনিময়ে আউটসোর্স হচ্ছে মেধা, রিসার্চ ফাইন্ডিংস্। লক্ষ লক্ষ টাকার প্রোজেক্টে আমাদের দেশের নানা দিকনির্দেশক গবেষণা আসলে চালাচ্ছে জার্মানি, অস্ট্রেলিয়া, স্পেন, ব্রিটেন ও মার্কিন মুলুকের একাধিক বিশ্ববিদ্যালয়। রিসার্চ লোকেশন আমাদের, রিসার্চার আমাদের, রিসার্চ স্যাম্পেল আমাদের, তবে মালিকানা বিদেশের। কারণ স্বদেশের জন্য স্বদেশের সরকার টাকা খরচ করতে রাজি নয়!
টাকা খরচ করতে হবে সরকারকেই। টাকা তুলতেও হবে সরকারকেই। শুধু টাকা তোলার মেশিনের চাপতে থাকা মানুষের চরিত্রটা বদলাতে হবে। বড়োলোকের ওপর ট্যাক্স বাড়িয়ে গরিবের পড়াশোনার ব্যবস্থা করাটাই উপায়। সেই ট্যাক্সের টাকা পড়াশোনার পরিকাঠামোগত বৃদ্ধিতে কাজে লাগাতে হবে। রাজ্যের ব্যাপক অংশের বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান যে বেলাগাম মুনাফা গড়ে নিচ্ছে তার নির্দিষ্ট অংশ সরকারের মাধ্যমে খরচ করতে হবে সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পরিকাঠামো পুনর্গঠন করার কাজে। এরই সাথে টাকা খরচের রাস্তাটাকে দুর্নীতিমুক্ত করতে হবে। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের গণতান্ত্রিক কাঠামোগুলো ফিরিয়ে তার মাধ্যমে কোন খাতে কতো টাকা বরাদ্দ হওয়া প্রয়োজন সেই মতামতগুলি তুলে আনতে হবে ভূমিস্তর থেকে। পরিচালন সমিতি, ছাত্র সংসদ, সেনেট-সিন্ডিকেটের গণতান্ত্রিক নির্বাচন অবিলম্বে পুনরুদ্ধার করতে হবে। শিক্ষা বিষয়ক চিন্তাবিদদের একত্রিত করে তাঁদের মতামত নেওয়া ও নীতি নির্ধারণের প্রক্রিয়ায় তাঁদের যুক্ত করতে হবে। প্রাথমিক থেকে উচ্চশিক্ষা পর্যন্ত ড্রপ আউট ঠেকাতে এবং ড্রপ আউট হওয়া বিশাল অংশের ছাত্র-ছাত্রীদের পড়াশোনার মূল স্রোতে ফেরাতে চাই সরকারি বাজেটে অ্যান্টি ড্রপ আউট স্পেশাল স্টিমুলাস প্যাকেজ। সেই টাকার বণ্টনের ক্ষেত্রেও শিক্ষানুরাগী নানা অংশের মানুষকে নিয়ে গঠন করতে হবে প্রাথমিক থেকে উচ্চশিক্ষা পর্যন্ত প্রতিটা স্তরে আলাদা আলাদা অ্যান্টি ড্রপ আউট সেল।

মোদ্দা কথা, সরকারি পড়াশোনা পুনরুদ্ধার করতে সরকারি খরচ বাড়াতে হবে সরকারি বাজেটে। পড়াশোনার ক্ষেত্র যতো বেশি কর্পোরেট মুনাফার সিঁড়িতে পরিণত হবে ততোই পাবলিক এডুকেশন পরিণত হবে ডাম্পিং গ্রাউন্ডে। ধাক্কা খাবে সর্বজনীন শিক্ষা। সংকুচিত হবে শিক্ষার সম্প্রসারণ। হারাবে শিক্ষার মৌলিক অধিকারের প্রতি মানুষের ভরসা। সামাজিক সঙ্কট থেকে মুক্ত হতে গেলে লাগবে সামাজিক বোধ, সামাজিক সক্রিয়তা, সামাজিক সচেতনতা। আন্দোলনের পথেই ফের পুনরুদ্ধার করতে হবে শিক্ষার গুরুত্ব, প্রাসঙ্গিকতাকে। চাপ তৈরি করতে হবে সরকারের ওপর। হাতিয়ার একমাত্র বিকল্প শিক্ষানীতি। সেই আন্দোলনেরই বহিঃপ্রকাশ আগামী ২৭ জানুয়ারি, ভারতের ছাত্র ফেডারেশনের ডাকে বিকাশ ভবন অভিযান। শামিল হোন, সমর্থন জানান, সংহতি জানান।

Comments :0

Login to leave a comment