রবীন্দ্রনাথের
রামমোহন
সাধারণত আমরা প্রতিদিন গুটিকতক ছোটো ছোটো কাজ লইয়াই থাকি; মাকড়সার মতো নিজের ভিতর হইতে টানিয়া টানিয়া আমাদের চারি দিকে স্বার্থের জাল নির্মাণ করি ও স্ফীত হইয়া তাহারই মাঝখানটিতে ঝুলিতে থাকি; সমস্ত জীবন দৈনন্দিন খুঁটিনাটির মধ্যে সমাহিত হইয়া অন্ধকার ও সংকীর্ণতার গর্ভে স্বচ্ছন্দসুখ অনুভব করি। আমাদের প্রতিদিন পূর্বদিনের পুনরাবৃত্তি মাত্র, আমাদের ক্ষুদ্র জীবন একটি ধারাবাহী উন্নতির কাহিনী নহে। সেই প্রতিদিবসের উদরপূর্তি, প্রতিরাত্রের নিদ্রা–বৎসরের মধ্যে এই ঘটনা ও ইহারই আনুষঙ্গিক অনুষ্ঠানগুলিরই তিনশো পঁয়ষট্টি বার করিয়া পুনরাবর্তন–এই তো আমাদের জীবন, ইহাতে আমাদের নিজের প্রতি শ্রদ্ধা হয় না–অহংকার ও আত্মাভিমানের অভাব নাই বটে, কিন্তু আপনাদের প্রতি যথার্থ শ্রদ্ধা নাই। একপ্রকার নিকৃষ্টজাতীয় জীবাণু অছে, সে কেবল গতিবিশেষ অবলম্বন করিয়া ঘুরিতেই জানে; সে সমস্ত জীবন একই ঘুরন ঘুরিতেছে। তাহার সহিত আমাদের বেশি প্রভেদ দেখিতে পাই না। আমাদের আহ্নিক গতি আছে, বার্ষিক গতি নাই–আমরা নিজের চারি দিকে ঘুরিতেছি, নিজের নাভিকুণ্ডল প্রদক্ষিণ করিতেছি, কিন্তু অনন্তজীবনের কক্ষপথে এক পা অগ্রসর হইতেছি না। এই পরম কৌতুকাবহ আত্মপ্রদক্ষিণ-দৃশ্য চতুর্দিকে দেখা যাইতেছে–সকলে মাটির উপরে বিন্দুমাত্র চিহ্ন রচনা করিয়া লাটিমের ন্যায় সূচ্যগ্র-পরিমাণ-ভূমির মধ্যেই জীবনের সুদীর্ঘ ভ্রমণ নিঃশেষ করিয়া দিতেছে। প্রতিদিন চারি দিকে ইহাই দেখিয়া মনুষ্যত্বের উপরে আমাদের বিশ্বাস হ্রাস হইয়া যায়, সুতরাং মনুষ্যত্বের গুরুতর কর্তব্য সাধন করিবার বল চলিয়া যায়। এইজন্য মহাত্মাদের প্রতি মাঝে মাঝে দৃষ্টিপাত করা আমাদের নিতান্ত আবশ্যক। মহাত্মাদের জীবন আলোচনা করিলে মনুষ্যত্ব যে কী তাহা বুঝিতে পারি, ‘আমরা মানুষ’ বলিলে যে কতখানি বলা হয় তাহা উপলব্ধি করিতে পারি, জানিতে পারি যে আমরা কেবল অস্থিচর্মনির্মিত একটা আহার করিবার যন্ত্র মাত্র নই, আমাদের সুমহৎ কুলমর্যাদার খবর পাইয়া থাকি। আমরা যে আমাদের চেয়ে ঢের বড়ো, অর্থাৎ মনুষ্য, সাধারণ মানুষদের চেয়ে যে অনেক পরিমাণে শ্রেষ্ঠ, ইহাই মনের মধ্যে অনুভব করিলে তবে আমাদের মাথা তুলিতে ইচ্ছা করে, মৃত্তিকার আকর্ষণ হ্রাস হইয়া যায়।
মহাপুরুষেরা সমস্ত মানবজাতির গৌরবের ও আদর্শের স্থল বটেন, কিন্তু তাঁহারা জাতিবিশেষের বিশেষ গৌরবের স্থল তাহার আর সন্দেহ নাই।.....................
............আমরা বাক্পটু লোক, আমাদিগকে তুমি কাজ করিতে শিখাও। আমরা আত্মম্ভরী, আমাদিগকে আত্মবিসর্জন দিতে শিখাও। আমরা লঘুপ্রকৃতি, বিপ্লবের স্রোতে চরিত্রগৌরবের প্রভাবে আমাদিগকে অটল থাকিতে শিখাও।...........
...........রামমোহন রায়ের যশের প্রলোভন কিছুমাত্র ছিল না। তিনি যতগুলি কাজ করিয়াছিলেন কোনো কাজেই তাঁহার সমসাময়িক স্বদেশীয়দিগের নিকট হইতে যশের প্রত্যাশা করেন নাই। নিন্দাগ্লানি শ্রাবণের বারিধারার ন্যায় তাঁহার মাথার উপরে অবিশ্রাম বর্ষিত হইয়াছে–তবুও তাঁহাকে তাঁহার কার্য হইতে বিরত করিতে পারে নাই। নিজের মহত্ত্বে তাঁহার কী অটল আশ্রয় ছিল, নিজের মহত্ত্বের মধ্যেই তাঁহার হৃদয়ের কী সম্পূর্ণ পরিতৃপ্তি ছিল, স্বদেশের প্রতি তাঁহার কী স্বার্থশূন্য সুগভীর প্রেম ছিল! তাঁহার স্বদেশীয় লোকেরা তাঁহার সহিত যোগ দেয় নাই,.........
............রামমোহন রায় যখন ভারতবর্ষে জন্মগ্রহণ করেন তখন এখানে চতুর্দিকে কালরাত্রির অন্ধকার বিরাজ করিতেছিল। আকাশে মৃত্যু বিচরণ করিতেছিল। মিথ্যা ও মৃত্যুর বিরুদ্ধে তাঁহাকে সংগ্রাম করিতে হইয়াছিল।..........
........... তিনি যে সত্যের পতাকা ধরিয়া ভারতভূমিতে দাঁড়াইয়াছিলেন সেই পুরাতন সত্যের জয়। তখন সেই রামমোহন রায়ের জয়ে, ঋষিদের জয়ে, সত্যের জয়ে, ব্রহ্মের জয়ে আমাদের ভারতবর্ষেরই জয়।.........
Comments :0