অষ্টাদশ লোকসভা নির্বাচনে রায় দেবার ক্ষেত্রে বিরোধীদের উত্থাপিত দেশের গণতন্ত্র ও সংবিধান রক্ষার প্রশ্নটি যে অতিরিক্ত তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে উঠেছে তা ভোটের ফলাফলেই স্পষ্ট। নির্বাচন পরবর্তী প্রায় প্রতিটি পদক্ষেপে বিরোধীরা বিশেষ করে রাহুল গান্ধী সরাসরি সংবিধান হাতে নিয়ে মোদীকে তাঁর দশ বছরের কৃতকর্মের গণতন্ত্র বিরোধী তথা সংবিধানবিরোধী অধ্যায়গুলি বারংবার স্মরণ করিয়ে দেবার ফলে মহা ফাঁপরে পড়ে যান প্রধানমন্ত্রী। ভোট পর্বে বিরোধীদের লাগাতার প্রচারে এই ধারণা অনেকটাই প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায় যে মোদী ফের ক্ষমতায় এলে দেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার সামনে সমূহ বিপদ। প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণের বদলে ক্রমাগত কেন্দ্রীভূত হবে। যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোকে দুর্বল থেকে দুর্বলতর করে রাজ্যগুলির ক্ষমতা ও অধিকার কেড়ে নিয়ে পুরোপুরি কেন্দ্র নির্ভর করে পৌরসভা জাতীয় সংস্থায় পরিণত করা হবে। রাজ্য সরকারগুলি হয়ে উঠবে ঢাল-তরোয়ালহীন নিধিরাম সর্দার। কেন্দ্রীয় সরকারের অধীনস্ত স্থানীয় সরকাররূপে কেন্দ্রের নির্দেশ অনুসারে কেন্দ্রীয় প্রকল্প রূপায়ণ করবে। একের পর এক প্রচলিত আইন সংশোধন করে নাগরিক অধিকার সঙ্কুচিত করে রাষ্ট্রের অধিকার সীমাহীন করা হবে। পর্যাপ্ত মানবিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, ধর্মীয় অধিকার সম্পন্ন নাগরিকদের অতি শক্তিশালী রাষ্ট্রের অনুগত প্রজায় পরিণত করা হবে। নাগরিক অধিকার সহ যাবতীয় মানবাধিকার বঞ্চিত নাগরিকরা হয়ে উঠবেন প্রজা। রাষ্ট্রের অতি ক্ষমতাবান শাসকের মর্জিতেই নির্মিত হবে প্রজার ভাগ্য।
প্রচারে এই ধারণাও বড় অংশের মানুষের মর্মমূলে পৌঁছেছিল যে তৃতীয় বার শাসনের চাবুক হাতে পেলে আরএসএস’র হিন্দুরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মৌলিক অ্যাজেন্ডাগুলি কার্যকর করা শুরু করবে। আর অন্যতম একটি অভিন্ন দেওয়ানি আইন। ধর্মীয় স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করে দেশে হিন্দুত্বকেই একমাত্র ধর্মবিশ্বাস বলে বৈধতা দেবে। ব্রাহ্মণ্যবাদ তথা মনুবাদী সমাজ বিন্যাসকে বৈধতা দিয়ে দলিত, জনজাতি, ওবিসি’র সাংবিধানিক অধিকার কেড়ে নেবে। অর্থাৎ সংবিধানে সংরক্ষণের অংশটি বাতিল করে দেবে। সামগ্রিকভাবে মানুষ এটা আন্দাজ করতে পারছিলেন যে বিজেপি ফের ক্ষমতায় আসা মানে সংবিধানটাই বাতিল হয়ে হিন্দুরাষ্ট্রের মনুবাদী একদলীয় স্বৈরাচারী সংবিধান চালু হবে।
এই বাস্তবতাই প্রবল প্রতাপশালী দাম্ভিক মোদীর জয়ের ব্যবধান খোদ বারাণসীতে সাড়ে চার লক্ষ থেকে দেড় লক্ষে নামিয়েছে। হিন্দুত্বের তুফান তোলা রাম মন্দিরের কেন্দ্রেই বিজেপি’র পরাজয় অনিবার্য হয়েছে। ৪০০ আসনের লক্ষ্যমাত্রা পূরণের বদলে মোদীর দল একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা থেকে বহু পেছনে চলে গেছে। শেষ পর্যন্ত কোনোক্রমে অন্য দলকে সঙ্গে নিয়ে মোদী প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন। অর্থাৎ একটি অস্থিতিশীল দুর্বল সরকারের তিনি নেতা। নেতা নিজেও আবার নানা কারণে ক্ষয়িষ্ণু, বিশ্বাসযোগ্যতায় টাল খাওয়া। ফলে বিরোধীদের ক্রমাগত আক্রমণে তিনি এতটাই কোণঠাসা যে নিজেকে গণতন্ত্রের পূজারি বা সংবিধানের রক্ষক হিসাবে জাহির করার কোনও সুযোগ নেই। তাঁর দশ বছরের রেকর্ড পদে পদে দেখিয়ে দেয় সংবিধানে তাঁর বিন্দুমাত্র আস্থা ও বিশ্বাস নেই। গণতন্ত্র থেকে একনায়কত্ব ও স্বৈরাচারই তাঁর বেশি পছন্দ। তাই উপায় না দেখে আক্রমণই আত্মরক্ষার সেরা উপায় হিসাবে তারস্বরে চিৎকার জুড়েছেন ৫০ বছর আগেকার জরুরি অবস্থা নিয়ে। বার বার কংগ্রেসকে আক্রমণ করে বলছেন ৫০ বছর আগে তারা গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে, সংবিধানের বিরুদ্ধে, স্বৈরাচারী হামলা চালিয়েছিল। এমন হল্লাবাজির তোড়ে আড়াল করতে চাইছেন তাঁর দশ বছরের কুকীর্তিগুলিকে। নিজের গণতন্ত্রবিরোধী কুৎসিত স্বৈরাচারী চেহারাটাকে ঢাকতে চাইছেন। পদে পদে নিজের ব্যর্থতা ও অপদার্থতাকে আড়াল করতে নেহরুকে গাল পাড়েন। নিজের অতীত জীবন ও শিক্ষাগত যোগ্যতা যার আপাদমস্তক অস্বচ্ছতায় ঢাকা, বানানো গল্প দিয়ে যার জীবনপঞ্জি তৈরি, সাময়িক মোহগ্রস্ততা কাটলে মানুষের কাছে তিনি গুরুত্বহীন হয়ে পড়বেন তাতে সন্দেহ কি।
Comments :0