Women Vote TMC

অনুদান’প্রাপ্ত মহিলারা দলে দলে তৃণমূলকে ভোট দেননি

রাজ্য লোকসভা ২০২৪

মহিলাদের ‘অনুদান’জিতিয়ে দিল তৃণমূলকে? বিভিন্ন মহল এই কথা প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা চালাচ্ছে। কিন্তু নির্বাচনী ফলাফলের তথ্য তা বলছে না। 
তৃণমূলের জয়ে রাজ্য সরকারের বিভিন্ন সামাজিক সুরক্ষা প্রকল্পের প্রভাব কিছুটা থাকতে পারে। কিন্তু সেটিই প্রধান উপাদান নয়। শুধু তাই নয়, ‘লক্ষ্মীর ভাণ্ডার’-এর মতো মহিলাদের জন্য নির্ধারিত প্রকল্পগুলির সুবিধা যারা পান, তার থেকে কম ভোটই তৃণমূল পেয়েছে। সামাজিক সুরক্ষা প্রকল্পগুলিকেই প্রধানত ‘উন্নয়ন’বলে এবারের নির্বাচনেও প্রচার করেছেন মমতা ব্যানার্জি সহ তৃণমূল নেতারা। কিন্তু সেই ‘উন্নয়ন’ তাদের বিরাট সুবিধা দেয়নি। 
‘জেন্ডার ন্যারেটিভ’অথবা লিঙ্গভিত্তিক ভাষ্যকে ‘অনুদানপ্রাপ্ত মহিলাদের’নামে অগ্রাহ্য করার চেষ্টা হচ্ছে।
রাজ্যে মহিলা ভোটার ছিলেন ৩ কোটি ৮৩ লক্ষ। নির্বাচন কমিশনের তথ্য বলছে, রাজ্যে গড়ে মহিলা ভোটদাতাদের ৮০ শতাংশ ভোট দিয়েছেন। অর্থাৎ প্রায় ৩ কোটি ৬ লক্ষের বেশি মহিলা ভোট দিয়েছেন। লোকসভা নির্বাচনে রাজ্যের ৪২টি আসনে তৃণমূল সব মিলিয়ে ভোট পেয়েছে ২ কোটি ৭৫ লক্ষ ৬৪ হাজারের কিছু বেশি। মোট ভোটদাতাদের ৪৫.৭৬ শতাংশ তৃণমূলকে ভোট দিয়েছেন। আলোচনার জন্য ধরে নেওয়া যেতে পারে, তৃণমূলের এই ভোটের ৫০ শতাংশ যদি মহিলা হন, তাহলে প্রায় ১ কোটি ৩৮ লক্ষ মহিলা ভোট দিয়েছেন তৃণমূলকে, যা মোট মহিলা ভোটদাতার অর্ধেকেরও বেশ কম।  
রাজ্যের অর্থ দপ্তরের তথ্য অনুসারে ‘লক্ষ্মীর ভাণ্ডার’প্রকল্পে ভাতা পান রাজ্যের ১ কোটি ৯৮ লক্ষ মহিলা। রূপশ্রী, কন্যাশ্রীর দ্বিতীয় ভাগ এবং বিধবা ভাতা প্রাপকদের ধরলে সামাজিক সুরক্ষা প্রকল্পের আওতায় থাকা মহিলার সংখ্যা প্রায় ২ কোটি ২৪ লক্ষ। তাঁরা সবাই তৃণমূলকে ভোট দিয়েছে ধরলে মুশকিল, কারণ তাহলে কী ৫০ লক্ষেরও কম পুরুষ তৃণমূলকে ভোট দিয়েছেন? রাজ্যের পুরুষদের ভোটের বিশেষ কিছুই কি তৃণমূল পায়নি? তা হতে পারে না।
অধ্যাপিকা ঈশিতা মুখার্জির বক্তব্য, ‘‘ নির্বাচন কমিশনের তথ্য বলছে, পশ্চিমবঙ্গে মহিলা ভোটদাতাদের ভোট দেওয়ার হার দেশে সবচেয়ে বেশি। তার মানে এই নয় যে সরকারের অনুদান পেয়ে তাঁরা নির্দিষ্ট একটি দলকে ভোট দিতে বুথে এসেছিলেন। এমন বেশ কয়েকটি কেন্দ্র আছে যেখানে নির্বাচনের কমিশনের তথ্য বলছে, পুরুষদের তুলনায় মহিলাদের ভোটদানের হার বেশি। তার বেশ কয়েকটিতে রাজ্যের শাসক দল হেরেছে। কী করে সম্ভব, যদি সামাজিক সুরক্ষা প্রকল্পের আওতায় থাকা মহিলারা শুধু রাজ্যের শাসক দলকেই ভোট দিয়ে থাকে? আসলে এবার মহিলাদের বেশি দেখা গেছে। কারণ, গ্রামাঞ্চলে বিশেষত অনেক জায়গাতেই পুরুষরা ভিনরাজ্যে ছিলেন কাজের জন্য। আর মহিলাদেরও অনেকেই নিজেদের বিবেচনা মতো, বিভিন্ন ইস্যুকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করে ভোট দিয়েছেন।”
রাজ্যে পুরুষদের থেকে মহিলারা শতাংশের বিচারে বেশি ভোট দিয়েছেন বেশ কিছু কেন্দ্রে। নির্বাচন কমিশনের তথ্য বলছে, সেগুলি হলো আলিপুরদুয়ার, কোচবিহার, বালুরঘাট, রায়গঞ্জ, জঙ্গীপুর, মালদহ দক্ষিণ, মালদহ উত্তর, মুর্শিদাবাদ, বহরমপুর, বীরভূম, বোলপুর, কৃষ্ণনগর এবং রানাঘাট। এর মধ্যে আলিপুরদুয়ার, বালুরঘাট, রায়গঞ্জ, মালদহ উত্তর, মালদহ দক্ষিণ, রানাঘাট কেন্দ্রে তৃণমূল পরাজিত হয়েছে। মুর্শিদাবাদ কেন্দ্রে সিপিআই(এম) প্রার্থী ৩৩ শতাংশের বেশি ভোট পেয়েছেন। যার মধ্যে মহিলাদের অনেক ভোটই আছে।
তাই সামাজিক সুরক্ষা প্রকল্পগুলিকে ‘অনুদান’বলে চিহ্নিত করা এবং তার জন্যই তৃণমূল জিতেছে, এটা বিবেচনা করলে ভুল হয়ে যাবে বলে অনেকেই মনে করছেন। কারণ, বামফ্রন্ট সরকারই রাজ্যে সামাজিক সুরক্ষা প্রকল্প চালু করেছিল। ছাত্রীদের ভাতা, বার্ধক্য ভাতা, বিধবা ভাতা, সাইকেল দেওয়ার মতো প্রকল্পগুলি বামফ্রন্ট সরকারের সময়কালেই শুরু হয়েছিল। সেই সময়ে তফসিলি জাতি, আদিবাসীদের জন্য অনেক সামাজিক সুরক্ষা প্রকল্প চালু ছিল, যা তৃণমূলের শাসনে বরং সঙ্কুচিত হয়েছে। তবু ২০১১ সালে রাজ্যে তৃণমূল, বিজেপি, মাওবাদী, আরএসএস, মৌলবাদীদের নৈরাজ্যের হাত ধরে তথাকথিত ‘পরিবর্তন’ হয়েছিল।
এবারও তৃণমূলের জয়ের পিছনে ‘অনুদান’র অবদানই প্রধান বিষয় নয়। এই ক্ষেত্রে বিভিন্ন কেন্দ্রের নির্বাচনী ফলাফল তার প্রমাণ হতে পারে। যেমন, রানিনগর বিধানসভা এলাকা। এটি মুর্শিদাবাদ লোকসভার মধ্যে পড়ে। সেখানে সিপিআই(এম) সবচেয়ে বেশি ভোট পেয়েছে-৯৬,৩১০। দ্বিতীয় স্থানে আছে তৃণমূল। তৃতীয় স্থানে বিজেপি। ২০২১-র বিধানসভা নির্বাচনে হরিহরপাড়ায় জয়ী হয়েছিল তৃণমূল। ‘লক্ষ্মীর ভাণ্ডার’ প্রকল্প তার পরে চালু হয়েছে। আর একটি উদাহরণ দেওয়া যায় যাদবপুরে। ওয়ার্ড ১০৯ নং। নির্বাচনের আগে ওই ওয়ার্ডের একটি এলাকায় সিপিআই(এম) প্রার্থী এবং কর্মীদের ঘিরে বিক্ষোভ দেখানো হয়। কিছু জায়গা ছিল তৃণমূলী হুমকির মুখে। নির্বাচনের দিনেও কয়েকটি বুথে তৃণমূল বিরোধী কোনও দলের এজেন্ট বসতে দেয়নি। তা সত্ত্বেও নিম্নবিত্ত, গরিবপ্রধান ওই এলাকায় তৃণমূল ৪৫ শতাংশ ভোট পেয়েছে। ওই ওয়ার্ডে তৃণমূল জিতেছে ৪৬৩১ ভোটে। আর যে চারটি বুথে তারা বিরোধীদের কোনও এজেন্ট বসতে দেয়নি, সেই বুথগুলিতে তৃণমূল এগিয়ে আছে ২৩৬৮ ভোটে। সরকারি প্রকল্পের আওতায় থাকা মহিলাদের প্রতি ভরসা থাকলে তৃণমূল বুথ দখল করত না। রাজ্যে ২৯টি আসনে জিতলেও তৃণমূলের জয়ের পিছনে ‘অনুদানপ্রাপ্ত মহিলাদের’প্রধান উপাদান ধরার বিরুদ্ধে এমন অনেক প্রমাণ ছড়িয়ে আছে বিভিন্ন কেন্দ্রে।
 

Comments :0

Login to leave a comment