Insaf Yatra

সংস্কৃতর ‘জনস্রোত’ থেকে আরবি ‘ইনসাফ’ চাইবে ব্রিগেড

রাজ্য

 ‘ইনসাফ’ বলল কেন? ‘ইনসাফ’ তো হিন্দুরা বলে না। এ তো মুসলমানদের শব্দ। তাই ‘ইনসাফ যাত্রা’ হিন্দুদের হতে পারে না। সেই পদযাত্রা শেষে ব্রিগেডে সমাবেশেও হিন্দুদের যাওয়া উচিত নয়।
‘ইনসাফ’ এবং ‘ব্রিগেড সমাবেশ’ নিয়ে গ্রামে, মফস্বলে আরএসএস এমন প্রচার করছে। তৃণমূলও হাওয়া দিচ্ছে।
চা পান করতে করতে এই প্রচার শুনছিলাম। দোকানের টেবিলে রাখা ছিল চায়ের গ্লাস। বসেছিলাম বেঞ্চিতে। ঠিক হলো কি? ‘চা’য়ের উৎস চীনাদের ভাষা। আর চীন হলো এখন আমাদের দেশের ঘোর শত্রু, সঙ্ঘই সে কথা জানাচ্ছে। তাই শব্দের ধর্ম নিয়ে আলোচনা শোনার সময় চা খাওয়া কি উচিত? কিন্তু আমি দেখলাম বিজেপি’র কর্মীটিও সেই চা-ই খাচ্ছেন।
ফলে কিছুটা স্বস্তি পাওয়া গেল। কিন্তু ঝামেলা কি একটা? 
টেবিলে গ্লাস— দু’টিই ইংরেজি শব্দ। চেয়ারও। সেই ইংরেজদের থেকে বয়ে আসা শব্দে চিহ্নিত সামগ্রী সামনে রেখে ডিওয়াইএফআই’র আরবি শব্দ ব্যবহার নিয়ে আলোচনা সঙ্ঘ মেনে নেবে? এই নিয়ে দ্বিধার মধ্যে যখন দুলছি, মনে হলো—সঙ্ঘ, বিজেপি এবং তৃণমূল কারও আপত্তি থাকার কথা নয়। ইংরেজরা একসময় টানা প্রায় দু’শো বছর দেশকে লুটেছে। ছিবড়ে করে দিয়েছে। সাম্রাজ্যবাদীদের সে ছিল গুরু, যাকে বলে ওস্তাদ। সেই ওস্তাদদের মুচলেকা লিখে, পা টিপেই তো বিনায়ক সাভারকার হয়েছেন ‘বীর’। তিনিই তো ‘হিন্দুত্ব’-র হেডমাস্টার। আর তাঁর ভক্তরা হলেন মমতা ব্যানার্জির কথায় ‘সাচ্চা দেশপ্রেমিক’। 
ফলে সঙ্ঘ কিংবা তৃণমূল— কারও অসুবিধা হওয়ার কথা নয় টেবিল, চেয়ার, গ্লাস নিয়ে। কিন্তু বাধা আছে আরও, অন্যত্র।
এই সব নিয়ে আলোচনা দীর্ঘ সময়ের বিষয়। তার জন্য বইয়ের দরকার হবে। বই নামাতে হবে আলমারি থেকে। রাখতে হবে টেবিলে। বসতে হবে চেয়ারে। তা করা কি ঠিক হবে? ‘বই’ নিজেই আরবি শব্দ। তাকে নিয়ে লড়লে কি হিন্দুয়ানার গায়ে আরও ফোসকা পড়বে না? সমস্যা শুধু ‘বই’ নিয়েও নয়। আরও আছে। ‘আলমারি’ পর্তুগিজ শব্দ। বামফ্রন্ট সরকার আলমারি ব্যবহার করত। ২০১১-র মে মাসের পরে সব আলমারি নিয়ে সেই সরকারের মন্ত্রীরা চলে এসেছিলেন। তাই মমতা ব্যানার্জি ‘৩৪ বছরের দুর্নীতি’ খুঁজে পাননি বলে জানিয়েছেন! ওনার দলের কেউ তাই আলমারিতে টাকা রাখেন না। হয় তোয়ালেতে মুড়ে রাখেন, নয়তো বাথরুমে কিংবা শিখণ্ডী সংস্থায় টাকা রাখা অভ্যাস তৃণমূলের নেতাদের। ফলে যে ‘আলমারি’ বিদেশি, যে জিনিস নিয়ে সঙ্ঘের দুর্গার প্রবল আক্ষেপ, তা থেকে বই নামিয়ে লড়াই করা সঠিক কাজ হবে? দ্বন্দ্ব তৈরি হলো মনে। 
ঝামেলা হলো পর্তুগিজদের অধিকাংশই খ্রিস্টান। ইংরেজরাও। সঙ্ঘ কি খ্রিস্টানদের শব্দ দিয়ে চিহ্নিত সামগ্রী থেকে আরবি ‘বই’ নামানো মেনে নেবে? তা নিয়ে যখন চিন্তায় কিঞ্চিৎ বেসামাল, তখনই মনে পড়ল খ্রিস্টান আদিবাসীদের যজ্ঞ করে হিন্দু করার রাস্তা জানা আছে সঙ্ঘের, যাকে বলে ‘ঘর ওয়াপসি।’ ফলে যে রাজ্যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গানের ভাষা বদলে দিতে পারেন আরএসএস’র দুর্গা, সেই রাজ্যে ‘বই’-ও বদলাতে পারে। শব্দেরও নিশ্চই হিন্দুকরণ অথবা ‘ঘর ওয়াপসি’ হতে পারে। 
কিন্তু কত শব্দ বদলাবে? কত শব্দ ‘ঘরে ফিরবে’? দেশের সব পরিবারের মাথায় পাকা ছাদের বন্দোবস্তর প্রতিশ্রুতি ছিল ‘বিশ্বগুরু’ প্রধানমন্ত্রীর। সেই ঘরের প্রকল্পের নাম নিয়ে প্রথমে দেদার টানাহ্যাঁচড়া করতে দেখা গেল মমতা ব্যানার্জি আর নরেন্দ্র মোদীকে। তারপর দেখা গেল, সেই ঘরের টাকাও চুরি করেছে মুখ্যমন্ত্রীর দল। আর সেই ‘চোর’দের বিরুদ্ধে গত দশ বছর কোনও ব্যবস্থা নেয়নি নরেন্দ্র মোদীর সরকার। কিন্তু তা তো হওয়ার কথা নয়। ‘চোর’ শব্দের উৎস তো খাঁটি সংস্কৃত। অভিধান ঘেঁটে আর কোনও উৎস পাওয়া গেল না। তাহলে বিলক্ষণ সেই হিন্দু শব্দের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা কাজ করতে এত টালবাহানা কেন আরএসএস পরিচালিত সরকারের? 
‘ইনসাফ’ ব্যবহার করে যদি ব্রিগেডে সভা ডাকা অন্যায় হয়, তাহলে ‘চোর’-দের ধরার জন্য টালবাহানা, মানুষকে বোকা বানানোও কি অপরাধ নয়? বিজেপি কী বলে? তবে তাদের এই ক্ষেত্রে একটি সমস্যা আছে। সেটা খুবই কঠিন। চোর ধরে তার বিচার করতে হবে। বিচার করতে হলে আদালতে তুলতে হবে। আর ‘আদালত’ এসেছে আরবি থেকে। সেখানে দীর্ঘ দিনের বন্ধু তৃণমূল নেত্রীর আত্মীয় ও বন্ধুদের নিয়ে যেতে পারে আরএসএস? সম্ভব নয়। 
তাই এত শব্দের জন্মবৃত্তান্তের খোঁজ আপাতত তোলা থাক। বাংলায় দেদার ফারসি, আরবি, পর্তুগিজ, ইংরেজি, জাপানি, ফরাসি, চীনা ভাষা থেকে আসা শব্দ ব্যবহার করা হয়। প্রচুর ব্যবহারও হয়। পরীক্ষাতে হয়। যারা তৃণমূলের দৌলতে পরীক্ষা না দিয়ে উত্তীর্ণ হয় এবং চাকরি পায়, তাদের কথা আলাদা। কিন্তু আমাদের সংস্কৃতি মূলত মিশ্র সংস্কৃতি। সেখানে ‘ইনসাফ’ থাকে। থাকে ‘চোর’ কিংবা ‘স্বাগতম’-এর মতো সংস্কৃত থেকে আসা শব্দও। সঙ্ঘ, বিজেপি, তৃণমূল আসলে ভাষাকে অজুহাত করে ‘জনগণের ব্রিগেড’ নিয়ে মানুষকে বিভ্রান্ত করতে নেমেছে। 
আর জনস্রোত? সংস্কৃত থেকে এসেছে। কিন্তু এখন জনস্রোতের অন্যতম উৎস হলো লুট-দুর্নীতি আর সাম্প্রদায়িকতার প্রতি ঘৃণা। এখন জনস্রোতের শব্দ মানে ক্রোধ, ধিক্কার। তাঁরা জবাব চান। সেই প্রশ্ন করার, বদলে দেওয়ার শপথের ভাষা পদযাত্রা আর ধারাবাহিক আন্দোলনের ময়দানে নির্ধারিত হচ্ছে।
ব্রিগেড রবিবার তা সোচ্চারে জানাবে। সঙ্ঘের মুখ আর মুখোশ— অপেক্ষা করুন।

 

Comments :0

Login to leave a comment