COP 30

বিপন্ন বিশ্ব

সম্পাদকীয় বিভাগ

রাষ্ট্রসঙ্ঘের জলবায়ু পরিবর্তন সম্মেলনে (COP) বিশ্বের সব দেশের নেতারা আলোচনা করেন কীভাবে আমাদের এই পৃথিবীকে রক্ষা করা যায়। ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে মাদ্রিদে অনুষ্ঠিত হয়েছিল ‘কপ ২৫’ । এই সম্মেলন ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ, কারণ সেখানেই চূড়ান্ত করার কথা ছিল প্যারিস চুক্তিকে কার্যকর করার সব নিয়ম। কিন্তু বিশ্ব জুড়ে যখন জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বন্যা, খরা আর ঝড় বাড়ছে, তখনও কিছু ক্ষমতাশালী দেশ এবং তাদের পেছনে থাকা বড় বড় কর্পোরেট সংস্থাগুলোর নিজেদের স্বার্থ রক্ষার কারণে সেই জরুরি সিদ্ধান্তগুলো নেওয়া সম্ভব হয়নি। ‘কপ ৩০’ ব্রাজিলের বেলেমে চলছে এখন। এই সম্মেলন নভেম্বর ১০ থেকে নভেম্বর ২১ পর্যন্ত চলবে। কপ ২৫-এর আলোচনার মূল বিষয় ছিল প্যারিস চুক্তির অনুচ্ছেদ ৬ অর্থাৎ কার্বন বাজার ব্যবস্থার নিয়মাবলী চূড়ান্ত করা। এই অনুচ্ছেদটিতে উল্লেখ করা আছে, আন্তর্জাতিক কার্বন বাজার ব্যবস্থার চেহারা নিয়ে। অর্থাৎ, যেসব কোম্পানি বা দেশ দূষণ কমাচ্ছে, তারা সেই ক্রেডিটগুলো অন্যদের বিক্রি করতে পারে।
কিন্তু এখানেই যত সমস্যা! দুটি বড় ফাঁদ তৈরি হলো, যার পেছনে ছিল মূলত ধনী দেশগুলো এবং তাদের প্রবল দূষণযুক্ত শিল্পের বড় বড় কর্পোরেট সংস্থাগুলো। ডাবল কাউন্টিং (Double Counting)-এর মাধ্যমে দুর্নীতি করছে তারা। এরা চেয়েছিল, কার্বন কমানোর কাজকে দু’বার গোনা হোক। একবার যে দেশ দূষণ কমালো সেটা এবং, আর একবার যে দেশ সেই ক্রেডিট কিনলো সেটা। এটা তো এক ধরনের হিসাবের জালিয়াতি। যদি একই দূষণ হ্রাস দু’বার গোনা হয়, তবে পৃথিবীতে দূষণের মাত্রা কাগজে-কলমে কম দেখালেও বাস্তবে কিন্তু তা কমবে না। এই ব্যবস্থা তৈরি করে বৃহৎ কর্পোরেট সংস্থাগুলো নিজেদের মুনাফা বাড়িয়ে পরিবেশ রক্ষার দায়িত্ব এড়াতে চায়। দ্বিতীয়ত পুরানো ক্রেডিট ব্যবহার নিয়ে ধনী দেশগুলোর চাপ তৈরির কৌশল। উন্নত দেশগুলো পুরানো, দুর্বল নিয়মে তৈরি সস্তা কার্বন ক্রেডিটগুলো প্যারিস চুক্তির লক্ষ্য পূরণ করার কাজে ব্যবহার করতে চায়। এর অর্থ, তারা আজকের দিনে দূষণ কমানোর জন্য নতুন প্রযুক্তি বা বড় বিনিয়োগ না করে শুধুই পুরানো কুপন দেখিয়ে পার পেতে চায়। এই প্রচেষ্টাই প্রমাণ করে, তারা পরিবেশ রক্ষার চেয়ে মুনাফা বাড়ানোকেই অগ্রাধিকার দিচ্ছে। ভারত সহ অনেকগুলি উন্নয়নশীল দেশ পরিষ্কার করে বলেছে, এই ফাঁকিবাজি চলবে না। যে ধনী দেশগুলো সবচেয়ে বেশি দূষণ করেছে, তাদেরই বেশি দায়িত্ব নিয়ে নির্গমন কমাতে হবে। ধনী দেশ এবং বৃহৎ কর্পোরেটদের দূষণের ফলে আমাদের মতো গরিব দেশগুলোতে বন্যা, খরা হচ্ছে, দ্বীপ রাষ্ট্রগুলির অস্তিত্বই বিপন্ন হয়ে পড়েছে, তার জন্য যারা বেশি দূষণ ছড়িয়ে আসছে, তাদেরই আর্থিক ক্ষতিপূরণ দিতে হবে।
কিন্তু জলবায়ু অর্থায়ন (Climate Finance) এবং নতুন প্রযুক্তি দেওয়ার প্রতিশ্রুতি সত্ত্বেও উন্নত দেশগুলো তাদের দায়িত্ব থেকে সরে দাঁড়াচ্ছে। ‘কপ ২৫’-এ আলোচনার সময় দু’দিন বাড়িয়েও যখন বিশ্ব নেতারা অনুচ্ছেদ ৬-এর বিষয়ে ঐকমত্যে পৌঁছাতে ব্যর্থ হলেন, তখনই স্পষ্ট হলো, ধনী দেশগুলি নিজেদের আর্থিক স্বার্থ এবং কর্পোরেট মুনাফাকেই পৃথিবীকে রক্ষার চেয়েও বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে। কপ ৩০ সম্মেলনে এখনও আলোচনা চলছে। বিশ্বে অগ্রগতির মূল্যায়ন ও পর্যালোচনা চলছে। উন্নত দেশগুলো কবে কীভাবে তাদের প্রতিশ্রুত বার্ষিক ১০০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করবে। ব্রাজিল যেহেতু আমাজন অঞ্চলে সম্মেলন করছে, তাই বন সংরক্ষণ এবং জীববৈচিত্র রক্ষার জন্য অর্থায়নের ওপর বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। কার্বন বাজার ব্যবস্থার চূড়ান্ত নিয়মগুলি নিয়ে এখনও তীব্র দর কষাকষি চলছে। আগামী ২১ নভেম্বরের মধ্যে চূড়ান্ত ফলাফল জানা যাবে। এই সম্মেলন বিশ্বকে দেখিয়ে দিয়েছে যে, বিজ্ঞান এবং ন্যায়বিচারকে উপেক্ষা করা সম্ভব নয়। তরুণ প্রজন্মের কাছে এখন বার্তা স্পষ্ট— পরিবেশ রক্ষার লড়াইয়ে সাধারণ মানুষকেই নেতৃত্ব দিতে হবে, যাতে ভবিষ্যতে কোনও কর্পোরেট বা ধনী দেশ তাদের মুনাফার জন্য এই পৃথিবীকে আরও বিপদে ফেলতে না পারে।

 

Comments :0

Login to leave a comment