শ্যামল কুমার মিত্র
ভারত দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে বিভক্ত হয়ে স্বাধীনতা পেয়েছিল। অনেকের ধারণা শুধু মহম্মদ আলি জিন্নার নেতৃত্বে মুসলিম লিগের দাবিতে ভারত ভাগ হয়। মুসলিম লিগ ২৪ মার্চ, ১৯৪০ লাহোর অধিবেশনে দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে মুসলিমদের জন্য পৃথক পাকিস্তান দাবি করেন। এই ঘটনার ১৭ বছর আগে ১৯২৩ সালে ‘হিন্দুত্ব’ নামক পুস্তকে বিনায়ক দামোদর সাভারকার লিখেছিলেন, ‘প্রকৃত হিন্দু সেই ব্যক্তি যিনি সিন্ধুনদ থেকে সমুদ্র পর্যন্ত ভূখণ্ডকে পিতৃভূমি ও পবিত্র ভূমি বলে মনে করেন এবং বিশ্বাস করেন যে এই ভূখণ্ডই হচ্ছে তাঁর ধর্মের ধাত্রী।’ মুসলিম এবং খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীদের ধর্মীয় পবিত্রভূমি যেহেতু যথাক্রমে মক্কা এবং জেরুজালেম, তাই তাঁরা এই বৃহত্তর হিন্দু পরিবারের অংশ নয়। ১৯২৫ সালে জন্মলগ্ন থেকেই আরএসএস দৃঢ়ভাবে ঘোষণা করে ভারত শুধুমাত্র হিন্দুদেরই দেশ। তাই ‘ধর্ম নিরপেক্ষ ভারত’ নয়, ‘হিন্দু রাষ্ট্র’ হিসাবে তারা ভারতকে দেখতে চায়। এই ভারতে অহিন্দুদের থাকতে হলে আরএসএস’র ‘হিন্দুত্ব’ গ্রহণ করতে হবে অথবা দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক হয়ে থাকতে হবে।
এরা মানুষকে বোঝায়, যে সব দেশে মুসলিমরা সংখ্যাগরিষ্ঠ, তারা মুসলিম দেশ হলে ভারত হিন্দু রাষ্ট্র হবে না কেন? আজারবাইজান নামের একটি দেশ আছে যে দেশে ৯৭ শতাংশ অধিবাসী মুসলিম। সেই দেশের সংবিধানের ৪৮ নম্বর ধারায় দেশটিকে ‘ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র’ হিসাবে ঘোষণা করা হয়েছে। আজারবাইজানের মুসলিমরা বিশ্বাস করেন, তাদের দেশে মানুষদের ‘ধর্ম’ পালন এবং ধর্ম পালন না করার সমান অধিকার আছে, কিন্তু রাজনীতি ও রাষ্ট্র পরিচালনায় ‘ধর্ম’-এর কোনও ভূমিকা থাকতে পারে না। ‘ধর্ম’ একান্তই ব্যক্তিগত বিষয়, রাষ্ট্র প্রত্যেক ধর্মের মানুষদের ব্যক্তিগত স্তরে ধর্মাচারণের স্বাধীনতা দেবে, কিন্তু রাষ্ট্র ও রাজনীতি সম্পূর্ণ ধর্মনিরপেক্ষ হবে। আমাদের জাতীয় নেতারাও সংবিধানে ঠিক এই কথাগুলিই লিপিবদ্ধ করে গেছেন। ১৯৩৭ সালে অর্থাৎ জিন্নার দাবি তোলার ৩ বছর আগে হিন্দু মহাসভার আমেদাবাদ অধিবেশনে সভাপতির ভাষণে এই সাভারকার বলেছিলেন, ‘আজ ভারতকে একক ও সমজাতীয় জাতি বলে ধরে নেওয়া যায় না, বরং এর বিপরীতটাই হলো সত্য — এখানে প্রধানত দুটি জাতি রয়েছে— হিন্দু এবং মুসলমান। এই দুটি জাতি ভারতে পাশাপাশি অবস্থান করছে।" অর্থাৎ মুসলিম লিগের অনেক আগে থেকেই আরএসএস, হিন্দু মহাসভার মতো সঙ্ঘপরিবার নামে পরিচিত হিন্দুত্ববাদীরা দ্বিজাতি তত্ত্বের বিষ ছড়িয়েছিল।
প্রাক্ স্বাধীনতা কালে মুসলিম লিগ ও হিন্দু মহাসভা এবং আরএসএস ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশগ্রহন না করে ব্রিটিশ সরকারের সহযোগী ছিল এবং ব্রিটিশদের ‘ডিভাইড অ্যান্ড রুল’ নীতির সুবিধা করে দিতেই দ্বিজাতি তত্ত্বের নামে হিন্দু- মুসলমানের পারস্পরিক বিদ্বেষের পটভূমি তৈরিতে ব্যস্ত ছিল। হোয়াটস অ্যাপ ইউনিভার্সিটির পণ্ডিতরা দেশ বিভাজনের জন্য কংগ্রেস ও বামপন্থীদের উপর দায় চাপিয়ে আত্মশ্লাঘা বোধ করতেই পারেন, কিন্তু তাতে স্বাধীনতা সংগ্রামে হিন্দু মহাসভা, আরএসএস, মুসলিম লিগের নিন্দনীয় ভূমিকার ইতিহাস বদলাবে না। এ কথাও অস্বীকার করা যাবে না যে ব্রিটিশ সরকারকে সমর্থন ও সহযোগিতা এবং ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশ না নেওয়ার মুচলেকা দিয়েই সাভারকার ভাতৃদ্বয় ব্রিটিশ কারাগার থেকে মুক্তি পেয়েছিলেন। হিন্দু ও মুসলিম মৌলবাদীদের উগ্র সাম্প্রদায়িক ও ধর্মান্ধ কার্যকলাপে সে সময় দেশের পরিস্থিতি এমন হয়েছিল যে উইনস্টন চার্চিল ভারতের স্বাধীনতাপন্থী অ্যাটলি সম্পর্কে বলেছিলেন, ‘অ্যাটলি জানে না ও কি করতে যাচ্ছে। ভারতীয়রা স্বাধীনতা পেলে ধর্ম নিয়ে দাঙ্গা বাঁধিয়েই রাখবে, জাতপাত নিয়ে দেশটাকে ফুটিফাটা করে ছাড়বে।’ ফলে ভারত বিভক্ত হয়েই স্বাধীনতা পেয়েছিল এবং তার বিষময় ফল হিসাবে আজও পাকিস্তান ও বাংলাদেশে ধর্মের নামে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের উপর অত্যাচারে প্রাণে বাঁচতে হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান ধর্মের মানুষরা এবং ঐ দুই দেশের মৌলবাদী শাসকদের বিরুদ্ধে সোচ্চার মুসলিমরা রাজরোষ থেকে বাঁচতে এ দেশে চলে এসেছেন বড় সংখ্যায়। প্রশ্ন এটাই, রাষ্ট্র হিসাবে ভারত মানবিকতার দৃষ্টিকোণ থেকে এদের সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নেবে, নাকি অনুপ্রবেশকারী হিসাবে বিতাড়ন করবে? অনুপ্রবেশ ইস্যুটির পেটেন্ট, কপি রাইট মমতা বন্দোপাধ্যায়ের। মোদী-অমিত শাহ জুটি শুধু ইস্যুটি ছিনতাই করেছেন। কংগ্রেসমুক্ত ভারত গড়ার লক্ষ্যে আরএসএস’র পরিকল্পনায় ১৯৯৮ সালে কংগ্রেস ভেঙে তৃণমূল কংগ্রেস তৈরি করে। বিজেপি’র রাজ্য সভাপতি শমীক ভট্টাচার্য নিজেও এ কথা বলেছেন। মমতা ব্যানার্জি এই বক্তব্যের বিরোধিতা করেননি। ১৯৯৮ থেকেই মমতা ব্যানার্জি দাবি করতে থাকেন, ‘পশ্চিমবঙ্গটা উগ্রপন্থীদের মরুদ্যান হয়ে গেছে। ভোটার লিস্টে প্রচুর বাংলাদেশি। ওদেরও ভোটার কার্ড আছে, আমাদেরও ভোটার কার্ড আছে। বামফ্রন্ট দলে দলে এ রাজ্যে বাংলাদেশি ঢোকাচ্ছে, ভোটার তালিকায় নাম তুলে দিচ্ছে, তাদের ভোটে জিতছে। ব্যাপক অনুপ্রবেশ বাংলার শান্তি, ভারতের শান্তি নষ্ট করছে, ভারতের ইন্টারনাল সিকিউরিটি বিপন্ন।’ ২০০৫ সালের ৪ আগস্ট লোকসভায় স্পিকারের চেয়ারে বসা ডেপুটি স্পিকার চরণজিৎ অটওয়ালের দিকে একগোছা কাগজ ছুঁড়ে চিৎকার করে বলেছিলেন, ‘অনুপ্রবেশকারী বাংলাদেশিদের ভোটে নির্বাচিত অবৈধ বামফ্রন্ট সরকারকে বরখাস্ত করতে হবে। অনুপ্রবেশ বন্ধ করতে হবে। অনুপ্রবেশকারীদের ভারত থেকে তাড়াতে হবে।’
মমতা ‘স্বঘোষিত মুসলিম মসিহা’। কিন্তু তিনিই সর্বপ্রথম পশ্চিমবঙ্গে প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে বসবাসকারী মুসলিমদের পিঠে স্থায়ীভাবে ‘বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারী’র তকমা সেঁটে দিয়েছিলেন। ভিন রাজ্যে বসবাসকারী প্রত্যেক মুসলিম বাঙালিকে এই সন্দেহের বাতাবরণে এনে ফেলেছিলেন যে তাঁরা বাংলাদেশি। আজ মমতা সিএএ’র বিরুদ্ধে সোচ্চার। অথচ ২০০৩ সালে অটলবিহারী বাজপেয়ীর নেতৃত্বে এনডিএ সরকার যখন ‘The Citizenship Ammendment Act-2003’ আনেন, তখন সেই এনডিএ সরকারেরই মন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায়। মোদী-অমিত শাহ জুটি, বঙ্গ বিজেপি আজ যা বলছেন, হুবহু একই কথা তিনি বলতেন। ২০০২ সালে এ রাজ্যে এসে এনডিএ সরকারের বিজেপি উপমুখ্যমন্ত্রী লালকৃষ্ণ আদবানি বলেছিলেন, পশ্চিমবঙ্গে অনুপ্রবেশকারী অন্তত ২ কোটি। ২০২৫ এ অমিত শাহ এসে বললেন, অন্তত ২ কোটি বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারী রয়েছে। ২০০২ সালেও ২ কোটি, ২০২৫ সালেও ২ কোটি! তাহলে বিজেপি যে রোজ কোটি কোটি অনুপ্রবেশের কথা বলছে তার কি হলো? তার মানে ২০০২ থেকে ২০২৫ পর্যন্ত সময়ে ১ জন অনুপ্রবেশকারীও পশ্চিমবঙ্গে আসেনি? উত্তরটা বিজেপি-কেই দিতে হবে।
২০২৩ সালের ১২ ডিসেম্বর সুপ্রিম কোর্টে হলফনামা দিয়ে কেন্দ্র সরকার জানিয়েছে, ‘ভারতে অনুপ্রবেশকারীদের সংখ্যা সম্পর্কে কোনও তথ্য সরকারের কাছে নেই।’ এদেশে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ সম্পর্কে ভারত সরকারের তথ্য, ‘দেশে শরণার্থী শিবিরে ৪০,০০০ রোহিঙ্গা আছেন, পশ্চিমবঙ্গে ৩৬১ টি রোহিঙ্গা পরিবার রয়েছে।’ তাহলে কোন তথ্যের উপর ভিত্তি করে কোটি কোটি মুসলিম অনুপ্রবেশের গল্প বলছেন বিজেপি নেতারা? উল্লেখ্য, মায়ানমারের সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের কোনও সীমান্ত নেই। সীমান্ত আছে অরুণাচল প্রদেশ, নাগাল্যান্ড, মণিপুরের। অথচ ভোটার তালিকা থেকে রোহিঙ্গা উৎপাটনে এসআইআর হচ্ছে পশ্চিমবঙ্গে অথচ অরুণাচল প্রদেশ, নাগাল্যান্ড, মণিপুর বাদ! বিজেপি নেতৃত্ব কি বলবেন?
রোহিঙ্গা কারা? মায়ানমার মূলত বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের দেশ। সে দেশে মুসলিমদের সংখ্যা ২৩,৫৮,৫৭৭। মায়ানমারের আরাকান প্রদেশের অধিবাসীদের বলা হয় রোহিঙ্গা (স্থানীয় নাম রোহং থেকে)। সেই দেশের সব মুসলিমই আরাকান প্রদেশে থাকেন না। রোহিঙ্গাদের ভাষার সঙ্গে চট্টগ্রামের ভাষার কিছুটা মিল আছে, তবে লেখার হরফ ভিন্ন। আরবির প্রভাব আছে। লিপি প্রায় উর্দুর মত। বাংলা বর্ণ পরিচয়ের চিহ্নমাত্র কোথাও নেই। তাদের চেহারায় দক্ষিণ এশিয়দের প্রভাব রয়েছে। তাই এরাজ্যে জনারণ্যে রোহিঙ্গা মুসলিমদের মিশে যাওয়া অসম্ভব। মায়ামার সরকারের সেনাবাহিনী ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট মায়ানমারের আরাকান প্রদেশে রোহিঙ্গা মুসলিমদের উৎখাত করতে ২৫ আগস্ট থেকে এক মাসের মধ্যে কমপক্ষে ৬,৭০০ রোহিঙ্গাকে হত্যা করা হয়। (MSF Report)। রোহিঙ্গাদের উপর মায়ানমারের সরকারের নৃশংশ আক্রমণ আজও চলছে। ফলে রোহিঙ্গারা প্রাণ বাঁচাতে জন্মভিটে ছেড়ে অনিশ্চিতের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়ে। মায়ানমারের ২৩ লক্ষাধিক রোহিঙ্গা সকলে দেশ ছাড়েননি। রাষ্ট্রসঙ্ঘের হিসাবে ১৩ লক্ষের মতো রোহিঙ্গা দেশত্যাগ করেছেন। ১২ লক্ষ রোহিঙ্গাকে বাংলাদেশের পূর্বতন শেখ হাসিনার সরকার মানবিকতার কারণে সে দেশে আশ্রয় দিয়েছিলেন। বাকি ১ লক্ষের মতো রোহিঙ্গা বিভিন্ন দেশে আশ্রয় নিয়েছেন। ভারতে এসেছেন মাত্র ৪০,০০০। তার মধ্যে পশ্চিমবঙ্গে আছেন মাত্র ৩৬১ টি পরিবার। এই সংখ্যাকে লক্ষ লক্ষ বানিয়ে মুসলিম বিদ্বেষের বীজ ছড়ানো কেন?
পশ্চিমবঙ্গে কোটি কোটি বাংলাদেশি মুসলিম অনুপ্রবেশকারীর অস্তিত্ব সম্পর্কে বিজেপি’র ভাষ্য সম্পর্কে কেন্দ্র সরকারের তথ্য কি বলে? ২০০১ থেকে ২০১১ পর্যন্ত ভারতে মুসলিম জনসংখ্যার বৃদ্ধির গড় ২৪.৬ শতাংশ, পশ্চিমবঙ্গে তা ২১.৮ শতাংশ, জাতীয় গড়ের থেকে ২.৮ শতাংশ কম। সীমান্তবর্তী রাজ্যগুলির মুসলিম জনসংখ্যা বৃদ্ধির জাতীয় গড় ১৭.৭ শতাংশ। পশ্চিমবঙ্গে তা ১৩.৮ শতাংশ। পশ্চিমবঙ্গে ৩.৯ শতাংশ কম। সদ্য প্রকাশিত নীতি আয়োগের ‘সামারি রিপোর্ট ফর দ্য স্টেট অফ ওয়েস্ট বেঙ্গল’-এ বলা হয়েছে, ‘২০২৩ সালের সেন্সাস পপুলেশন প্রজেকশন অনুসারে জনসংখ্যা বৃদ্ধির জাতীয় গড় ০.৯ শতাংশ। পশ্চিমবঙ্গে তা ০.৫ শতাংশ। পশ্চিমবঙ্গে ০.৪ শতাংশ কম।’ অর্থাৎ কেন্দ্রের সরকারি তথ্য প্রমান করে, পশ্চিমবঙ্গে বাংলাদেশীদের ব্যাপক অনুপ্রবেশ নিয়ে সর্বৈব মিথ্যাচার করছে মোদি-শাহ জুটি ও তাঁদের বশংবদ বাহিনী।
তা বলে পশ্চিমবঙ্গে কি বাংলাদেশি অনুপ্রবেশ ঘটছে না? অবশ্যই ঘটছে। কিন্তু মুসলিমরা পাকিস্তান, বাংলাদেশে সংখ্যাগুরু জনগোষ্ঠী হওয়ার সুবিধা ছেড়ে দলে দলে ভারতে চলে আসছেন, এই তথ্য অসত্য। কিন্তু মুসলিমদের একটা অংশ অবশ্যই এসেছেন অর্থনৈতিক কারণে, উপার্জনের তাগিদে এবং ধর্মে মুসলিম কিন্তু মৌলবাদ বিরোধী রাজনৈতিক কর্মী স্বদেশের রাজরোষ থেকে বাঁচতে। পাকিস্তানে ১৯৪৭ সালে মোট জনসংখ্যায় হিন্দু ছিলেন ২৪ শতাংশ। বর্তমানে তা ১৫ শতাংশ। বাংলাদেশে ১৯৭২-এ হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টানরা ছিলেন সেদেশের জনসংখ্যার ১৯.৬ শতাংশ। বর্তমানে তা কমবেশি ৭.৯শতাংশ। ইউনাইটেড নেশনস হাইকমিশন ফর রিফিউজিস এর ৪২৮(৫) ধারা অনুযায়ী, ‘জাতি, ধর্ম, বর্ণ ,সংস্কৃতি, রাজনৈতিক বিশ্বাসের প্রশ্নে অত্যাচারিত হয়েছেন বা অত্যাচারিত হতে পারেন এমন আশঙ্ক্ষা থেকে দেশ ত্যাগ করে অন্য দেশে চলে এসেছেন অথবা চলে আসতে বাধ্য হয়েছেন এমন মানুষ হলেন উদ্বাস্তু।’ রাষ্ট্র হিসাবে ভারত বরাবর উদ্বাস্তুদের প্রতি সহমর্মিতা দেখিয়েছে। আজ কেন অনুপ্রবেশ নিয়ে গোয়েবেলসীয় প্রচার কায়দায় মুসলিম জনগোষ্ঠীকে টার্গেট করা হচ্ছে?
বিহারে মোদী-অমিত শাহ জুটি ‘ঘুসপেটিয়া’, ‘ঘুসপেটিয়া’ করে চিল চিৎকার করছিলেন। বিহারে এসআইআর হওয়ার পর দেখা গেল চূড়ান্ত ভোটার তালিকায় ৭৪২ কোটি ভোটারের মধ্যে ‘বিদেশি’ হিসাবে নাকি চিহ্নিত ৯,৫০০ জন, মোট ভোটারের মাত্র ০.০০১২ শতাংশ। কমিশন নিশ্চুপ। বিহারে বলা হয়ে থাকে, ‘বিহার আর নেপালের মধ্যে রুটি-বেটির সম্পর্ক। ‘১৯৫০ সালের নেপাল-ভারত মৈত্রী চুক্তি অনুসারে উভয় দেশের নাগরিকরা পাসপোর্ট, ভিসা ছাড়াই যাতায়াত করতে পারে। ফলে ভারতে বসবাসকারী নেপালিদের কোন ভাবেই বে-আইনি অনুপ্রবেশকারী বলা যায় না। এই তথাকথিত ‘বিদেশি’দের ৮৫ শতাংশই নেপাল সীমান্তবর্তী ৪ জেলা সীতামারহি, পূর্ব ও পশ্চিম চম্পারন, সুপৌল এবং কিষানগঞ্জ জেলার। ভারত-নেপাল সম্পর্ক এবং দশকের পর দশক ধরে চলে আসা সামাজিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক সম্পর্কের কারণে এবং বিবাহসূত্রে বিহারবাসী নেপালি গৃহবধুরা কি আদৌ ‘বিদেশি’? কিন্তু বাংলাদেশ, পাকিস্তান থেকে আসা কতজন ‘ঘুসপেটিয়া’কে সনাক্ত করল এসআইআর? আপ সাংসদ সঞ্জয় সিং-এর তথ্য অনুযায়ী মাত্র ৩১৫ জন বাংলাদেশী, যাদের মধ্যে মুসলিম মাত্র ৭৮ জন। গোটা বিহারকে ‘ঘুসপেটিয়া’দের স্বর্গরাজ্য বলা মোদী-অমিত শাহ কী এই সরকারি পরিসংখ্যানে বিহারবাসীর কাছে ক্ষমা চাইবেন?
আসলে উন্নয়ন, সুশাসন, কর্মসংস্থান, বেকারি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বাসস্থান, পরিকাঠামো সহ ‘রোটি, কাপড়া আউর মকান’ এর মতো মূল ইস্যুতে নির্বাচন লড়ার ক্ষমতা নেই বিজেপি’র। তাই ‘অনুপ্রবেশ’কে হাতিয়ার করে সাম্প্রদায়িক বিভাজন, বিদ্বেষজনিত ধর্মীয় মেরুকরণের তাস খেলছেন মোদী-অমিত শাহ। বিহারে যে ৪৩ লক্ষ মানুষের নাম বাদ গেল তাদের ৮০ শতাংশই হিন্দু, ২০ শতাংশ মুসলিম সহ অন্যান্য ধর্মের এবং সিংহভাগ মহিলা। এঁদের অবস্থান কি? এঁরা কি দেশের নাগরিকত্ব হারালেন? সমস্ত সরকারি নাগরিক পরিষেবা ও অধিকার থেকে কি এঁরা বঞ্চিত হবেন? নিরুত্তর বিজেপি সরকার, জাতীয় নির্বাচন কমিশন।
অসমে প্রথমে এসআইআর তারপর হলো এনআরসি। ১৯ লক্ষ নাম এনআরসির খসড়া তালিকা থেকে বাদ গেল। এই ১৯ লক্ষের মধ্যে হিন্দু ১৪ লক্ষ, মুসলিম ৫ লক্ষ। বিজেপি লাগাতার প্রচার করেছে এসআইআর, এনআরসি, সিএএ-তে হিন্দুদের কোনও ভয় নেই, বিপদে পড়বে শুধুই মুসলিমরা। বিহার এবং অসমে অনেক হিন্দু বেশ আনন্দে ছিলেন বিজেপি’র আশ্বাসবাণীতে। কিন্তু বাস্তবে বিহার ও অসমের হিন্দুরা বুঝছেন হিন্দুরাই বেশি বিপদে। এই রাজ্যে বিজেপি সিএএ ক্যাম্প করে মতুয়া, রাজবংশী সহ উদ্বাস্তুদের প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে – এসআইআর-এ নাম বাদ গেলে সিএএ’র মাধ্যমে তাদের নাগরিকত্ব দেবে, ভোটার তালিকায় তাদের নাম তুলবে। সিএএ ভারতীয়দের নাগরিকত্ব দেওয়ার আইন নয়, বিদেশিদের ভারতীয় নাগরিকত্ব দেওয়ার আইন। তাই সিএএ-তে ভারতীয় নাগরিকত্ব চাওয়ার প্রথম শর্ত, একটি ‘সেল্ফ ডিক্লারেশন’ যেখানে আবেদনকারীকে লিখতে হবে, ‘আমি ভারতের নাগরিক নই। অবৈধভাবে ভারতে প্রবেশ করেছি।’ রাষ্ট্রের কাছে এই স্বীকারোক্তি লিখিতভাবে দিলে মতুয়া, রাজবংশী সহ উদ্বাস্তুদের পক্ষে তা ভয়ঙ্কর বিপদ হতে পারে। ২০০৩ সালে সিএএ আইন হয়েছে, এ পর্যন্ত অসমে ৩ জন এই আইনে নাগরিকত্ব পেয়েছেন। বিষয়টা যদি এতই সহজ হতো, তাহলে কয়েক লক্ষ হিন্দু উদ্বাস্তু ইতিমধ্যেই এই আইনে ভারতীয় নাগরিকত্ব পেয়ে যেতেন। ২০১৪ সাল থেকে কেন্দ্রে বিজেপি ক্ষমতায়, তাহলে এতদিন সিএএ’র মাধ্যমে নাগরিকত্ব দেয়নি কেন? সিএএতে বলা আছে, ‘১৯৮৪ সাল বা তার পরে যাঁরা এদেশে জন্মেছেন, তাঁরা জন্মসূত্রে এই দেশের নাগরিক নন। তাদের প্রমাণ করতে হবে তাদের মা/বাবা কেউ একজন এ দেশের নাগরিক ছিলেন।’ এখন নির্বাচন কমিশন বলছে, ‘১৯৮৪ সাল বা তার পরে যাঁরা এ দেশে জন্মেছেন, তাঁরা ভোটার কিনা তা সন্দেহজনক। তাঁদের প্রমান করতে হবে তাঁদের বাবা/মা যে কোনও একজন ২০০২ সালে পশ্চিমবঙ্গের কোথাও ভোটার ছিলেন।’ প্রথমে ‘বিদেশি’ চিহ্নিতকরণ, তারপর ভোটার তালিকা থেকে বাদ, তারপর এ দেশ থেকে বহিষ্কার– এটাই ওদের ক্রোনোলজি।
Muslim Population Bengal
ক্রোনোলজিটা বুঝুন
×
Comments :0