Editorials

বিচার ব্যবস্থাতেও কর্তৃত্ববাদ?

সম্পাদকীয় বিভাগ


বিচার বিভাগের সঙ্গে কি সরাসরি সংঘাতের রাস্তাতে যেতে চাইছে নরেন্দ্র মোদীর সরকার? বিভিন্ন হাইকোর্ট ও সুপ্রিম কোর্টে বিচারপতি নিয়োগের প্রশ্নে সরকারের ভূমিকায় এমন আশঙ্কা জোরালো হয়ে উঠেছে। স্বাধীন ভারতে এতকাল ধরে যে কলেজিয়াম প্রথায় শীর্ষ ও সর্বোচ্চ আদালতে বিচারপতি নিয়োগ ও বদলির কাজ চলছে সেই ব্যবস্থাকে কার্যত অস্বীকার করছে সরকার। ফলে দীর্ঘদিন ধরে কার্যত বিচারপতি নিয়োগের কাজ বন্ধ। এদিকে সমস্ত হাইকোর্টে ও সুপ্রিম কোর্টে বিচারপতির শূন্যপদের সংখ্যা বিপুল আকার ধারণ করেছে। বিচারপতির অভাবে জমছে মামলার পাহাড়। বিচার দীর্ঘায়িত হচ্ছে। সাধারণ মানুষ ন্যায় বিচার থেকে বঞ্চিত থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। একটা সত্য গণতান্ত্রিক দেশে বিচারব্যবস্থা ও সরকারের মধ্যে এধরনের সংঘাত প্রত্যাশিত নয়। সংবিধান উভয়ের কাজের পরিধি বা এক্তিয়ার নির্দিষ্ট করে দিয়েছে। সরকারকে যেমন অক্ষরে অক্ষরে সংবিধান মেনে চলতে হয় তেমনি সর্বোচ্চ আদালতের দায় সংবিধানকে রক্ষা করা। আইন ও সংবিধান মেনে সবকিছু ঠিকঠাক চলছে কিনা সেটা দেখা আদালতের কাজ। উভয় কর্তৃপক্ষ যদি নিজেদের এক্তিয়ার ও দায় সম্পর্কে সচেতন থাকে তাহলে বিরোধের কোনও সুযোগ থাকে না। এক্ষেত্রে লক্ষ্য করা যাচ্ছে সরকার তাদের দায়িত্ব পালন করছে না।
নিয়ম অনুযায়ী প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বাধীন সুপ্রিম কোর্টের শীর্ষ বিচারপতিদের কলেজিয়াম বিচারপতি নিয়োগের জন্য বাছাই করে নাম পাঠায় কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে। সেই নাম যাচাই করে সরকারের যদি কোনও নামে আপত্তি থাকে তাহলে পুনর্বিবেচনার জন্য কলেজিয়ামের কাছে ফেরত পাঠায়। পুনর্বিবেচনার পর কলেজিয়াম যদি ফের সেই নাম সুপারিশ করে তবে সরকার তাদের নিয়োগ করে। অতীতে এই ফেরত পাঠানোর ঘটনা ঘটলেও ইদানীং সেটা বাড়াবাড়ি ভাবে বেড়ে গেছে। তেমনি অতীতে দ্বিতীয়বার পাঠানো সুপারিশকে মান্যতা দিয়ে নিয়োগ করা হতো। কিন্তু মোদী জমানায় বিস্ময়করভাবে লক্ষ্য করা যাবে দ্বিতীয়বারের সুপারিশগুলি মাসের পর মাস ফেলে রাখা হচ্ছে, নিয়োগ করা হচ্ছে না। অর্থাৎ সরকার সুপ্রিম কোর্টকে বার্তা দিতে চাইছে সরকারের কাউকে তারা বিচারপতি হিসাবে নিয়োগ করতে রাজি নয়। কেবলমাত্র মোদী-শাহদের পছন্দের আরএসএস’র আদর্শের অনুসারীদেরই তারা বিচারপতি হিসাবে নিয়োগে আগ্রহী যাতে সরকার সংবিধান আইনের ধার না ধেরে খুশিমতো সরকার চালাতে পারে এবং সিদ্ধান্ত নিতে পারে। তাহলে আদালতের দিক থেকে আর কোনও বাধা থাকবে না।
সংবিধান মেনে চলার শপথ নিয়ে সরকারে এলেও আরএসএস’র আদর্শ পুরোপুরি সংবিধান বিরোধী। তাই তাদের লক্ষ্য সংবিধান বদলে পুরোপুরি হিন্দুত্ববাদী সংবিধান রচনা। তাতে ধর্মনিরপেক্ষ তার বদলে আসবে হিন্দুরাষ্ট্র। তদনুযায়ী বাকি সব ধারা বিন্যস্ত হবে। যতদিন না তা সম্ভব হচ্ছে ততদিন সরকারি কর্ম প্রণালীর মধ্যেই সংবিধানকে অস্বীকার অমান্য করে পরিস্থিতি বদলের চেষ্টা হবে। তারা চায় সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ সাংবিধানিক পদে, এমনকি কেন্দ্রীয় সরকারি প্রতিষ্ঠানে বেছে বেছে আরএসএস অনুগামীদের বসাতে। নির্বাচন কমিশনে যেমন চায় নিজেদের লোক বসাতে, তেমনি বিচারপতি পদেও চায় নিজেদের লোকদের। কলেজিয়াম প্রথা তাদের সেই ইচ্ছাপূরণে প্রধান বাধা। তাই তারা চায় কলেজিয়াম তুলে দিয়ে বিচারপতি নিয়ো‍‌গের ক্ষমতা ঘুরপথে সরকারের হাতে নিয়ে আসতে। তাই ক্ষমতায় আসার পরে পরেই বিচারপতি নিয়োগের জন্য জুডিশিয়াল কমিশন গঠন করে। সুপ্রিম কোর্ট সেই কমিশনকে সংবিধানবিরোধী বলে বাতিল করে দেয়। তারপর থেকেই কার্যত প্রতিহিংসাপরায়ণ মনোভাব নিয়ে সরকার বিচারপতি নিয়োগে ইচ্ছাকৃত ঢিলেমি শুরু করেছে। গত বছর এই ঢিলেমি বন্ধ করতে নিয়োগ প্রক্রিয়ার বিভিন্ন ধাপে সময়সীমা বেঁধে দেয় সুপ্রিম কোর্ট। সর্বোচ্চ আদালতের সেই নির্দেশকেও সচেতনভাবে অস্বীকার করে চলেছে কোর্ট। অর্থাৎ সরকার আরও স্পষ্ট করে দিতে চাইছে তাদের পছন্দের ছাড়া অন্য কাউকে তারা বিচারপতি নিয়োগ করবে না। এহেন দলতান্ত্রিক একগুঁয়ে মনোভাবের জেরে বিচারব্যবস্থা ভেঙে পড়ার জোগাড়।
 

Comments :0

Login to leave a comment