Sagardighi

সাগরদিঘির সেই পঞ্চায়েতে বোর্ড বাম-কংগ্রেসেরই

রাজ্য

অনির্বাণ দে: বহরমপুর

টানা ২৬দিনের লড়াই অবশেষে পূর্ণতা পেল বুধবার দুপুরে। পুলিশ প্রশাসন ও শাসক তৃণমূলের যাবতীয় বাধা উড়িয়েই সাগরদিঘির কাবিলপুরে বোর্ড গঠন করল সিপিআই(এম) ও কংগ্রেস যৌথভাবে। প্রধান হলেন সিপিআই(এম)’র রোজিনা বেগম এবং উপপ্রধান হলেন কংগ্রেসের মমতাজ খাতুন। 
এই মমতাজ খাতুনের শ্বশুরকে হুমকি দিয়েই সাগরদিঘি থানার পুলিশ, সিভিক পুলিশ ও তৃণমূলী বাহিনী মঙ্গলবার দুপুরে চড়াও হয়েছিল ঝাড়খণ্ডের পাকুড়ে। রাজ্যে গণতন্ত্রের এমনই চেহারা যে গত ১১ জুলাই ভোটের ফলপ্রকাশের পরেই শাসক তৃণমূল ও পুলিশের হামলা,  মিথ্যা মামলার শঙ্কায় নির্বাচিত সিপিআই(এম) ও কংগ্রেসের ১৪জন পঞ্চায়েত সদস্য ভিনরাজ্যে আশ্রয়ে ছিলেন। গত প্রায় ২৬দিন ধরে জয়ী ১৪জন সদস্য পাকুড় থানা এলাকায় একটি বাড়িতে শিবির করেছিলেন। 
বোর্ড গঠনের আগের দিন অর্থাৎ মঙ্গলবার দুপুরে ঝাড়খণ্ডের সেই পাকুড়েই হানা দেয় সাগরদিঘি থানার পুলিশ। ভিন রাজ্যে গিয়ে জয়ী সিপিআই(এম) ও কংগ্রেসের সদস্যদের তুলে নিয়ে এসে তৃণমূলে যোগ দেওয়াতে চেয়েছিল মমতা ব্যানার্জির পুলিশ প্রশাসন। আগে থেকেই সেই আশঙ্কায় তাই ১৪জন একসঙ্গে গত ২৬ দিন ধরে ভিনরাজ্যে ছিলেন। কংগ্রেসের জয়ী সদস্য, এদিনই উপপ্রধান পদে শপথ নেওয়া মমতাজ খাতুনের শ্বশুরকে সঙ্গে নিয়ে পুলিশ ও তৃণমূলী বাহিনী পাকুড়ের ঠিকানায় হানা দেয়। যদিও প্রবল বাধার মুখে পড়তে হয় তাঁদের। মমতাজ বেগম জানিয়ে দেন, মরে গেলেও তৃণমূলে যোগ দেব না, আমরাই একসঙ্গে বোর্ড গড়ব। স্থানীয় বাসিন্দারাই খবর দেন পুলিশকে। শেষপর্যন্ত পাকুড় থানার পুলিশ সাগরিদঘির থানার পুলিশ বাহিনী ও তৃণমূলীদের রাত পর্যন্ত থানায় আটকে রাখে। পরে তাঁদের ছেড়ে দেওয়া হয়।
এদিকে সারা রাত জেগে যেন বুধবার ভোরের আলোর প্রতীক্ষাতেই ছিলেন কাবিলপুরের জয়ী ১৪জন সিপিআই(এম) ও কংগ্রেস সদস্য। তাঁদের সঙ্গেই থাকা সিপিআই(এম) নেতা ইসমাইল শেখ বলেন,  এতদিন ধরে এত কষ্টের মধ্যেও সকলে বাড়িঘর,  পরিবার ছেড়ে পাকুড়ে ছিলেন। রাজ্যের গণতন্ত্রের এই তো হাল। পুলিশ মিথ্যা মামলা দেবে, শাসক দলে যোগ দিতে চাপ দেবে সেই কারণে নির্বাচিত সদস্যদের ভিন রাজ্যে আশ্রয় নিতে হলো ২৬দিন ধরে’। 
বুধবার ভোর পাঁচটার সময় তাঁরা পাকুড় থেকে সাগরদিঘির কাবিলপুর অঞ্চলে এসে পৌঁছান। তারপর সেখানে একটি বাড়িতে ফের সবাই একসঙ্গে দল বেঁধে ছিলেন। এরপর সকাল সাড়ে দশটা নাগাদ গ্রামের হাজার দু’য়েক মানুষের মিছিলে কার্যত ভেসেই তাঁরা পৌঁছান পঞ্চায়েত অফিসে। গোটা গ্রাম জুড়ে যেন উৎসবের মেজাজ।  দুই দলের পতাকা হাতেই গ্রামের মানুষ মিছিলে শামিল হন। ২৫টি আসনের মধ্যে সিপিআই(এম) ও কংগ্রেস ১৪টি আসনে জয়ী হয়ছিল। বিধানসভা উপনির্বাচনের পর বাইরন বিশ্বাসের দলত্যাগে তৃণমূলের বিরুদ্ধে ক্ষোভ বেড়েছিল গ্রামে। সেই ক্ষোভের তীব্রতাও জানান দিয়েছে এদিন গ্রামের মানুষের লড়াকু মেজাজের মিছিল। তৃণমূলের আমলে দুর্নীতির কেন্দ্রে পরিণত হয়েছিল কাবিলপুর গ্রাম পঞ্চায়েত। সেই পঞ্চায়েতকে মানুষের পঞ্চায়েতে রূপায়িত করা হবে বলে জানান প্রধান রোজিনা বেগম।
এদিকে বুধবার জলঙ্গির খয়রামারি গ্রাম পঞ্চায়েতও তৃণমূলের হাত ছাড়া হয়ে গেল। এই পঞ্চায়েতে ঐক্যবদ্ধভাবে বোর্ড গড়ল সিপিআই(এম) ও কংগ্রেস। প্রধান হলেন সিপিআই(এম)’র মিঠুন বিশ্বাস। জলঙ্গী ব্লকের খয়েরামারি গ্রাম পঞ্চায়েতে ২৩টি আসনের মধ্যে মাত্র ৮টি আসন পেয়েছিল তৃণমূল। সিপিআই(এম) জয়ী হয় ৮টি আসনে এবং কংগ্রেস ৭টি আসন জেতে। কংগ্রেসের সদস্যদের দলে টেনে পঞ্চায়েত দখলের চেষ্টা করেছিল তৃণমূল। সিপিআই(এম)’র নির্বাচিত সদস্যদের চাপ দেওয়া হচ্ছিল,  চলছিল পুলিশের হেনস্তা। এর মাঝেই কংগ্রেসের এক সদস্য তৃণমূলে যোগ দেন। মঙ্গলবার রাতে গোপন আশ্রয় থেকে বাড়ি ফেরেন নির্বাচিত সদস্যরা। হরেকৃষ্ণপুরে কংগ্রেসের প্রার্থীদের বাড়িতে হামলা করে তৃণমূল। সেই সময় গ্রামের মানুষ প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। গাড়ি নিয়ে এলাকা ছাড়তে বাধ্য হয় তৃণমূলের বাহিনী। এদিন গোপন ব্যালটে পঞ্চায়েতে প্রধান নির্বাচনে ভোটাভুটি হয়। সদস্য সংখ্যা ২৩ জন। সিপিআই(এম) ও কংগ্রেসের প্রস্তাবিত প্রধান প্রার্থী মিঠুন বিশ্বাস পেয়েছেন ১৪ ভোট এবং তৃণমূল পেয়েছে ৯টি ভোট।    
এদিন খড়গ্রামের কীর্তিপুর গ্রাম পঞ্চায়েতও হাতছাড়া হয়েছে তৃণমূলের। এই পঞ্চায়েতে বোর্ড গড়ল কংগ্রেস ও সিপিআই(এম) জোট। এই পঞ্চায়েতের মোট আসন ৩০। পঞ্চায়েত ভোটে ১৪টি আসনে জয়ী হয়েছিল তৃণমূল,  ৩টি আসন পায় সিপিআই(এম), ১২টি আসন পায় কংগ্রেস,  ১টি আসনে জেতেন নির্দল প্রার্থী। এদিন সিপিআই(এম)’র সমর্থনে প্রধান নির্বাচিত হয়েছেন কংগ্রেসের সদস্য পিঙ্কি বেগম,  উপপ্রধান হয়েছেন নির্দল হয়ে জয়ী সাহিনা খাতুন।
রানিনগর ২ব্লকের রানিনগর ২, কাতলামারি ১ ও কাতলামারি ২ গ্রাম পঞ্চায়েতে বোর্ড গড়েছে সিপিআই(এম) ও কংগ্রেস। রানিনগর-২ গ্রাম পঞ্চায়েতে প্রধান হয়েছেন সিপিআই(এম)’র  গোলাম মোর্তুজা, উপপ্রধান হয়েছেন কংগ্রেসের আসাদুল ইসলাম। কাতলামারি ২ গ্রাম পঞ্চায়েতে প্রধান হয়েছেন কংগ্রেসের ধনঞ্জয় মণ্ডল,  উপপ্রধান হয়েছেন সিপিআই(এম)’র আবুল কাশেম। কাতলামারি ১ গ্রাম পঞ্চায়েত প্রধান হয়েছেন কংগ্রেসের মাসোয়ারা খাতুন,  উপপ্রধান হয়েছেন কংগ্রেসের আফিরুল ইসলাম।
এদিন লাল আবির উড়ল লালগোলাতেও। লালগোলার আইড়মারী কৃষ্ণপুর গ্রাম পঞ্চায়েতে বোর্ড গঠন করেছে সিপিআই(এম) ও কংগ্রেস। এই গ্রাম পঞ্চায়েতে মোট ১৪টি আসন ছিল,  তার মধ্যে সিপিআই(এম) ৯টি আসনে জয়লাভ করে,  কংগ্রেস পেয়েছিল ২টি আসন ও শাসক তৃণমূল কংগ্রেস পেয়েছিল ৩টি আসন। এই ফলাফলের ভিত্তিতে প্রধান নির্বাচিত হলেন সিপিআই(এম) সদস্য আওয়াল হোসেন। উপপ্রধান নির্বাচিত হয়েছেন সিপিআই(এম) প্রার্থী সুলতানা বিবি। 
লালগোলার কালমেঘা গ্রাম পঞ্চায়েত এদিন তৃণমূলের হাতছাড়া হলো। এই পঞ্চায়েতের মোট আসন ছিল ২২টি। তার মধ্যে শাসক দল তৃণমূল পেয়েছিল ৮টি আসন। কালমেঘাতে শাসকদলকে সরিয়ে বোর্ড গঠন করেছে সিপিআই(এম) ও কংগ্রেস। প্রধান নির্বাচিত হলেন কংগ্রেস থেকে জয়ী প্রার্থী সুপ্রিয়া দাস সরকার,  উপপ্রধান নির্বাচিত হলেন সিপিআই(এম) থেকে জয়ী প্রার্থী।
নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা ছাড়াই তৃণমূলের নির্দলদের সমর্থনে টেয়া বৈদ্যপুরে বিজেপি’র দখলে গিয়েছে গ্রাম পঞ্চায়েত বোর্ড। ভরতপুর ২নম্বরের টেয়া বৈদ্যপুর গ্রাম পঞ্চায়েতে মোট আসন ছিল ১৯টি। যার মধ্যে বিজেপি পেয়েছিল ৮টি আসন,  ২টি আসন পায় তৃণমূল ও ৩টি আসন পায় কংগ্রেস, ২টি আসন পায় সিপিআই(এম),  ৪টি আসনে জেতেন নির্দল প্রার্থীরা। এই নির্দল প্রার্থীরা ছিলেন ভরতপুরের তৃণমূল বিধায়ক হুমায়ুন কবিরের প্রার্থী। তাঁরা এলাকায় ভোট চেয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নামেই। বুধবার পঞ্চায়েতে ৪জন নির্দল প্রার্থী বিজেপি’র প্রধানকে সমর্থন করে বোর্ড গঠন করেন।

 

Comments :0

Login to leave a comment