বিকাশের বা উন্নয়নের পাখির চোখ যদি হয় বিজেপি’র পরিমাণ ও জিডিপি বৃদ্ধির হাত এবং অতি উচ্চ হারে কর্পোরেট মুনাফা বৃদ্ধি ও বিত্তবানের সম্পদের পাহাড় তাহলে শ্রমিক-কর্মীদের যতদূর সম্ভব খাটিয়ে অতিরিক্ত শ্রম নিঙড়ে নেওয়াই অনিবার্য। কারণ অর্থনীতির যে তত্ত্বই অনুসৃত হোক না কেন এবং উৎপাদন ব্যবস্থা ও পরিচালন কৌশলে যে পরিবর্তনই আনা হোক না কেন শেষ পর্যন্ত সম্পদ সৃষ্টির মূলে থাকে শ্রমজীবী মানুষের শ্রম, তা সে কায়িক শ্রম হতে পারে আবার মেধা শ্রমও হতে পারে। পুঁজি দেশীয় হোক বা বিদেশি, তা দিয়ে মুনাফাও হয় না, নতুন সম্পদও তৈরি হয় না। শ্রমিক-কর্মীদের শ্রমই পুঁজি থেকে সম্পদ তৈরি করে, উদ্বৃত্ত মূল্য সৃষ্টি করে। শ্রমিক-কর্মীদের বঞ্চিত করে সেই উদ্বৃত্ত মূল্য হাতিয়ে নিয়েই হয় মুনাফা এবং কর্পোরেট মালিক সম্পদ।
পুঁজিবাদ বিকাশের বর্তমান স্তরে ক্ষুদ্র একাংশের সম্পদ যত দ্রুত বাড়ছে, সমাজে আয় ও সম্পদ বৈষম্য যত প্রকট হচ্ছে ততই বেশি বেশি করে খর্বিত হচ্ছে শ্রমজীবী মানুষের অধিকার। শ্রমিক-কর্মীদের যেসব অধিকার ও নিরাপত্তা এতকাল স্বীকৃত ছিল এখন তার বেশির ভাগই উধাও হয়ে গেছে। উন্নয়নের নামে বিকাশের নামে যাবতীয় শ্রম আইন বদলে দিয়ে শ্রমিকদের ঠেলে দেওয়া হয়েছে মুনাফাখোর হাঙরদের মুখে। এখন কাজের জন্য ৮ঘণ্টা সময় নির্দিষ্ট নেই। দিনে ১২ থেকে ১৮ ঘণ্টা হলেও কর্মীদের নীরবে মুখ বুজে করে যেতে হবে। স্থায়ী চাকরির প্রথাই কার্যত উঠে গেছে। সকলেই প্রায় চুক্তিভিত্তিক বা অস্থায়ী। কাজ আজ আছে তো কাল নেই। কাজ চলে গেলে কোনও ক্ষতিপূরণ নেই। আর একটা কাজ খুঁজে পাওয়া পর্যন্ত কেউ দেখার নেই। নতুন কাজ মিললেও আগের মতো মজুরির গ্যারান্টি নেই। কাজের উপযুক্ত পরিবেশ নেই, নিরাপদ ব্যবস্থা নেই। আছে শুধু চাপ। দু’দিনের কাজ সারতে হবে একদিনে। দু’জনের বা তিনজনের কাজ করতে হবে একজনকেই। তাতে যদি দিনে ১৫ ঘণ্টা, ১৮ ঘণ্টাও কাজ করতে হয় করতে হবে। সমস্যার কথা বলা যাবে না, প্রতিবাদ করা যাবে না, দাবি করা যাবে না। তারজন্য কোনও সংগঠন-ইউনিয়নও করা যাবে না। অর্থাৎ শ্রমিকদের জোট বেঁধে নিজেদের কথা সোচ্চারে বলার অধিকারও কেড়ে নেওয়া হয়েছে। নীরবে শোষিত, বঞ্চিত, লাঞ্ছিত হয়ে মেনে নিতে হবে সব রুজির দায়ে।
যে হারে কাজের বোঝা বা চাপ বাড়ছে, মজুরি কিন্তু বাড়ছে না। কাজের চাপ শ্রমিকের ব্যক্তিগত ও পারিবারিক জীবনকে তছনছ করে দিচ্ছে। শারীরিক ও মানসিকভাবে তারা বিপর্যস্ত হয়ে পড়ছেন। এই চাপ সইতে না পেরে কেউ জটিল রোগের শিকার হচ্ছেন, কেউ মানসিক অবসাদগ্রস্ত হচ্ছেন, কেউ ঢলে পড়ছেন মৃত্যুর কোলে। এমনকি কেউ বেছে নিচ্ছেন আত্মহত্যার পথ। সাম্প্রতিককালে এমন তিনটি ঘটনা সারা দেশে তীব্র আলোড়ন তুলেছে। মহারাষ্ট্রের পুনেতে বহুজাতিক সংস্থা আর্নস্ট অ্যান্ড ইয়ং-এর কর্মী অ্যানা সেবাস্তিয়ালের মৃত্যু হয়েছে অস্বাভাবিক কাজের চাপে। চেন্নাইয়ের এক বেসরকারি সংস্থার সফ্টওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার কার্তিকেয়ান কাজের চাপে দু’বছর মানসিক অবসাদে ভুগে আত্মহত্যা করেছেন। লক্ষ্ণৌয়ে বেসরকারি ব্যাঙ্ক এইচডিএফসি’র কর্মী সাদাত ফতিমা কাজের চাপে কর্মরত অবস্থায় হৃদরোগে মারা গেছেন। এখনো মারা যাননি এমন পরিস্থিতির শিকার লক্ষ লক্ষ শ্রমিক-কর্মী।
বিকাশ নিয়ে আলোচনা হয়, উৎপাদন বৃদ্ধি নিয়ে আলোচনা হয়, মুনাফা নিয়ে আলোচনা হয় কিন্তু কর্মী বৃদ্ধি, মজুরি বৃদ্ধি, সুযোগ সুবিধা বৃদ্ধি নিয়ে আলোচনা হয় না। কর্পোরেটদের প্রশংসা হয় কিন্তু কর্মীরা বিষাক্ত পরিবেশে কাজ করলেও আলোচনা হয় না। শ্রমিকদের সুযোগ-সুবিধা, তাদের শারীরিক ও মানসিক সুস্থতা নিয়ে কেউ ভাবে না। লক্ষ্য একটাই শ্রমখাতে যত কম ব্যয় করে যত বেশি মুনাফা করা যায়। এটাই নাকি কর্পোরেট দক্ষতার চাবিকাঠি। এমন এক দুঃসহ পরিবেশ থেকে মুক্তি পেতে তামিলনাড়ুতে স্যামসঙ কারখানায় শ্রমিকরা ইউনিয়ন গড়ার দাবিতে ধর্মঘট করছেন। এটাই বাঁচার পথ।
Editorial
বিষাক্ত পরিবেশে বিপন্ন কর্মীরা
×
Comments :0