Post Editorial

কোন লক্ষ্যে 'লক্ষ কণ্ঠে গীতা পাঠ'

উত্তর সম্পাদকীয়​


অলকেশ দাস 
আদ্যন্ত অরাজনৈতিক (!)
'লক্ষ কণ্ঠে গীতা পাঠ'। এ বছরের ২৪  ডিসেম্বর। যিশুখ্রিস্টের জন্মের আগের দিন।হবে ব্রিগেড প্যারেড ময়দানে।  রাজনীতির চর্চিত স্থানে হবে ধর্মসভার আয়োজন। আয়োজক সনাতন ধর্ম, অখিল ভারতীয় সংস্কৃত পরিষদ, সনাতন সংস্কৃতি সংসদ, মোতিলাল ভারত তীর্থ সেবা মিশন আশ্রম। এদেরই কেউ ছিল এবছরের গোড়ায় সংগঠিত ত্রিবেণীর মেলায়। কল্পিত সাতশো তিন বছর আগের কুম্ভ মেলার পুনরুজ্জীবন  প্রকল্পের পশ্চাতে। আদ্যন্তে অরাজনৈতিক (!) ধর্মীয় এই অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করবেন দেশের প্রধানমন্ত্রী এবং বিভাজনের রাজনীতির শীর্ষ নেতা নরেন্দ্র মোদী। সাংবাদিক সম্মেলনে এই ধর্মীয় অরাজনৈতিক অনুষ্ঠানের ঘোষণা করেছেন বিজেপি’র রাজ্য সভাপতি ! তার আগে অবশ্য তথাকথিত সাধুসন্ত সংগঠকেরা দিল্লি গিয়েছিলেন মোদিকে নিমন্ত্রণ করতে। তিনি নাকি সাগ্রহে সেই নিমন্ত্রণ গ্রহণ করেছেন। তারই পালটা হিসাবে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী ঘোষণা করেছেন তিনিও চণ্ডীপাঠের আয়োজন করবেন। প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক সাম্প্রদায়িকতার আর এক নজির।
গর্ভ সংস্কার 
গীতা নিয়ে সঙ্ঘ পরিবারের উন্মাদনা তৈরির প্রয়াস নতুন নয়। তাদেরই এক শাখা সম্প্রতি ঘোষণা করেছে 'গর্ভ সংস্কার' নামক এক প্রকল্পের। গর্ভবতী মহিলাদের গীতা পাঠ করাতে উৎসাহিত করা হবে। এতে নাকি সন্তান সংস্কারী ও দেশভক্ত হবে।  দু'বছর আগে হরিয়ানা সরকার ১০০ কোটি টাকার প্রকল্প গ্রহণ করেছিল কুরুক্ষেত্রে গীতা উৎসবের আয়োজনে। সঙ্ঘ পরিবার মনে করে কুরুক্ষেত্র হচ্ছে সেই জায়গা যেখানে ভগবান কৃষ্ণ অর্জুনকে গীতার এই উপদেশ দিয়েছিলেন যা পরবর্তীতে ভগবৎ গীতায় রূপান্তরিত হয়েছিল।  বিজেপি সরকারের  তদানীন্তন মন্ত্রী সুষমা স্বরাজ তো ঘোষণাই করে দিয়েছিলেন  যে আর দেরি না করে গীতাকে জাতীয় গ্রন্থ হিসাবে স্বীকৃতি দেওয়া উচিত। দেশের প্রধানমন্ত্রী বিদেশে যখন যান তখন উপহার হিসাবে বিদেশি রাষ্ট্রনায়কদের গীতা উপহার দেন। আমেরিকার রাষ্ট্রপতি বারাক ওবামাকে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রী এই উপহার দিয়ে তার উল্লাস  চেপে রাখতে পারেননি। অথচ হিন্দু ধর্ম একটি ধর্ম এবং গীতা একটি ধর্মগ্রন্থ। ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের ভাবনার বিপরীতে সেই ধর্মগ্রন্থকে গুঁজে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে বিদ্যালয় শিক্ষায়। কর্নাটকে যখন বিজেপি সরকার ছিল তখন বিদ্যালয়ে গীতা শিক্ষা চালু করার পরিকল্পনা করেছিল। মধ্য প্রদেশের বিজেপি শাসিত রাজ্য সরকার বিদ্যালয়ে গীতার সারাংশ শেখানো শুরু করেছে। দিল্লির মিউনিসিপাল কর্পোরেশন বিদ্যালয়ের প্রাথমিক স্তরে ভগবত গীতা পাঠ্য হিসাবে প্রবর্তনের কথা বলেছে। বিজেপি গুজরাটে বিদ্যালয়ে বিষয় হিসাবে ভগবত গীতা প্রবর্তনের পরিকল্পনা করছে। ষষ্ঠ শ্রেণি থেকে দ্বাদশ শ্রেণিতে বাধ্যতামূলক বিষয় হিসাবে।
শ্রেণিবদ্ধ, শ্রেণিবিন্যাস 
ভাগবত গীতা একটি ৭০০ শ্লোকের ধর্মগ্রন্থ যা মহাকাব্য মহাভারতের অংশ। অর্জুন যখন যুদ্ধ প্রত্যাখ্যান করছেন এই দ্বিধাগ্রস্থতায় যে নিজের আত্মীয়কে হত্যা করে কোনও ফল তিনি লাভ করবেন ? তখন কৃষ্ণ অর্জুনকে ক্ষত্রিয় বর্ণের রাজকুমারের  কর্তব্য সম্পর্কে শিক্ষা দিয়েছেন। গীতায় কৃষ্ণ নিজেকে পরম সত্তা হিসাবে উল্লেখ করেছেন। হিন্দু দর্শনের মূল হিসাবে পরিচিত এই গ্রন্থে হিন্দু ধর্মতত্ত্বের কেন্দ্রীয় অংশ বর্ণের উৎপত্তি সম্পর্কে বিস্তৃত কথা আছে। সাম্প্রদায়িক শক্তিগুলি স্কুলগুলিতে এই পাঠ্যটি চালু করতে চায় কারণ তারা শুধু এই দেশে  হিন্দু জাতি, হিন্দুত্বের ধারণাকে চাপিয়ে দিতে চায় না বরং এই বইটির মাধ্যমে তাদের লক্ষ্য বর্ণধারণাকে শক্তিশালী করতে চায় যা হিন্দু ধর্মের ব্রাহ্মণ্য সংস্করণের অন্যতম মূল মতবাদ। বেদের পুরুষসুক্তে যেমন বলা হয়েছে যে কিভাবে ভগবান ব্রহ্মা বিরাট পুরুষের দেহ থেকে চারটি বর্ণ সৃষ্টি করেছেন, গীতায় ঠিক তেমনি ভগবান কৃষ্ণ বর্ণের ঐশ্বরিক উৎস সম্পর্কে বলেছেন যে গুণ এবং কর্মের বিভাজন অনুসারে চতুর্গুণক্রম তৈরি হয়েছিল। গীতায় যে ধর্মের কথা বলা হয়েছে তা মূলত বর্ণাশ্রম ধর্ম ,যা একটি শ্রেণিবদ্ধ, শ্রেণিবিন্যাস। যা ভারতীয় সংবিধানের চেতনা, স্বাধীনতা, সমতা এবং ভ্রাতৃত্বের মূল্যবোধের বিরুদ্ধে। গীতার বর্ণাশ্রম ধর্ম সাম্যের নীতি লঙ্ঘন করে। ভারত একটি ধর্মনিরপেক্ষ দেশ যেখানে সকল ধর্মের মানুষের জন্য নাগরিকত্ব সমান। সেখানে কোনও দেশ, রাজ্য, রাষ্ট্রনায়ক কোনও একটি ধর্মগ্রন্থের পৃষ্ঠপোষকতা করতে পারে না।
সাম্প্রদায়িক মেরুকরণ
আম্বেদকার বলেছিলেন গীতা হচ্ছে সংক্ষেপে একটি মনুস্মৃতি। আজকে যাকে হিন্দু ধর্ম বলে দাবি করা হচ্ছে আসলে তা হলও ব্রাহ্মণ্যবাদী হিন্দু ধর্ম। চিরাচরিত ঐতিহ্যের হিন্দু ধর্মের বিপরীতে গীতা ব্রাহ্মণ্য হিন্দু ধর্মের প্রতিনিধিত্ব করে। হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির প্রবক্তা আরএসএস বিজেপি সেই জন্য সচেতনভাবে গীতার প্রচার করছে। মনে রাখা দরকার ভারতীয় সংবিধান আমাদের জাতীয় গ্রন্থ। গীতা কোন জাতীয় গ্রন্থ নয় এটি নিশ্চিতভাবে একটি  হিন্দু ধর্মগ্রন্থ। আম্বেদকার বলেছিলেন গীতাতে হিংস্রতা এবং জাতভেদের  ন্যায্যতা তুলে ধরা হয়েছে। কর্মের ধারণাকে উদ্বুদ্ধ করে বর্ণপ্রথাকে রক্ষা করা হয়েছে। অর্জুনকে কেবলমাত্র ক্ষত্রিয় হিসাবে যুদ্ধ করার কর্তব্য বিষয়ে জ্ঞান দিয়ে বর্ণের ধারণাকে ন্যায়সঙ্গত করা হয়েছে। শিক্ষাক্ষেত্রে গীতার অনুপ্রবেশ হিংসা ও জাতিভেদের প্রথা স্থায়ী করার লক্ষ্যেই। ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রে শিক্ষা হবে ধর্মনিরপেক্ষ, কেন সেখানে ধর্মীয় পাঠ্য শিখতে হবে? ফ্যাসিবাদীদের প্রথম কাজ শিক্ষা ব্যবস্থায় অনুপ্রবেশ করা। এখানেই তারা  সরল মনের গঠনকে বিকৃত করতে পারে। 'গীতাপাঠ' সাম্প্রদায়িক মেরুকরণের বহুমুখী পদক্ষেপের একটি অন্যতম প্রয়াস।
নর-বানরের শিক্ষা
আরএসএস’র  ইতিহাস শাখা ইতিহাস সংকলন যোজনার মতে গীতার সৃষ্টি ৫১৬২ বছর আগে।  গীতায় কৃষ্ণের বর্ণানুযায়ী  মনু তার পুত্র এই পৃথিবীর অধীশ্বর ইক্ষুকুকে এই ভগবত গীতার জ্ঞান দান করেছিলেন। আর তারপর আজ থেকে  প্রায় ৫০০০ বছর আগে কৃষ্ণ পুনরায় অর্জুনকে তা দান  করেন। এবার চলে আসা যাক সময় কাল নির্ধারণে। বলা হয় পৃথিবীতে এখন কলি যুগ। তার ৫০০০ বছর চলছে। কলি যুগের আগে ছিল দ্বাপর যুগ। যা চলেছে ৮ লক্ষ বছর ধরে। তার আগে ছিল ক্রেতা যুগ। তা চলেছে ১২ লক্ষ বছর ধরে। অর্থাৎ কলি, দ্বাপর, ক্রেতা যুগের এই মোট প্রায় কুড়ি লক্ষ পাঁচ হাজার বছর আগে মনু  ইক্ষুকুকে এই ভগবত গীতার জ্ঞান দান করেছিলেন। বিজ্ঞান বলছে এই কুড়ি লক্ষ বছর আগে ছিল আদিম মানুষ ও বানরের মাঝামাঝি মানুষের পূর্বপুরুষ অস্ট্রালোপিথেকাস। এর জীবাশ্ম অর্থাৎ জীবের ছাপ বা দেহাংশ যা পাথরে পরিণত হয়েছে পাওয়া গেছে আফ্রিকার দক্ষিণ পূর্ব অংশের তাঞ্জানিয়া,কেনিয়া, ইথিওপিয়ায়। এরা গাছের ডালে, কোটরে বাস করত। খেতো ফলমূল, কাঁচা মাংস। এরা ছিল অর্ধ নর- বানর। তাহলে ওই অর্ধ নর-বানরকে কি শ্রীকৃষ্ণের গীতার জ্ঞান দান করা হয়েছিল? তারাও কি গীতা পড়তো ? সিন্ধু সভ্যতার পূর্ণতা প্রাপ্তি ২৩০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে ১৭৫০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের মধ্যে। তারপরে আর্যরা ভারতে আসে। এবং এই আগমন চলতে থাকে ১৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ অবধি। তার মানে আর্যরা এসেছিল প্রায় সাড়ে তিন হাজার বছর আগে। বলা হয় আর্যরা ভারতে এসে মহাভারত, রামায়ণ, গীতা রচনা করেছে। অথচ গীতার বয়স বলা হচ্ছে প্রায় পাঁচ হাজার বছর । মিলছে না। এইরকম গোঁজামিলকেই ভারতীয় দর্শনের গ্রন্থ হিসাবে চালানোর চেষ্টা হচ্ছে।
সঞ্জয় দেখলেন,শুনলেন কি করে?
প্রথমে ছিল গীতা। পরে হলো শ্রীমৎভগবদগীতা। এই পরিবর্তনও শ্রেণিগত কারণে। শ্রী ভগবান স্বয়ং গীতা ব্যক্ত করেছেন বলে গীতার এই নাম। গীতায় শ্রীকৃষ্ণ অবতার। গীতা হলো মহাভারতের অংশ। মূল মহাভারতে কিন্তু কৃষ্ণ অবতার নন। শ্রীকৃষ্ণ আসলে গোয়ালা। যদুকুলের নায়ক। সমাজে চালু চতুর্বর্ণের নিয়ম অনুযায়ী তার সংস্কৃত ভাষা জানার কথা নয়। কারণ সেটা তখন কেবলমাত্র ব্রাহ্মণদের ভাষা। তাহলে কৃষ্ণ যুদ্ধক্ষেত্রে সংস্কৃতে নাতিদীর্ঘ বক্তব্য রাখলেন  কি করে? গীতাই বা তৈরি হলো কি করে?
গীতা আসলে যুদ্ধের বিবরণী। সঞ্জয় এবং ধৃতরাষ্ট্রের কথোপকথনের লিখিত রূপ। তারা বসেছিলেন উত্তর প্রদেশের হরিয়ানার রাজ অন্তঃপুরে। কয়েকশো মাইল দূরে কুরুক্ষেত্রে যুদ্ধ হচ্ছিল। সাধারণভাবে সঞ্জয়ের সেই যুদ্ধ দেখতে পাওয়ার কথা নয়। সেটার সামাল দেওয়া হয়েছে, যে ব্যাসদেব নাকি সঞ্জয়কে দিব্যদৃষ্টির শক্তি দিয়েছিলেন। এতেই নাকি সে যুদ্ধ দেখতে পেয়েছিল। কিন্তু যুদ্ধে কৃষ্ণ এবং অর্জুন কি কথোপকথন করছে তা সে শুনতে পেল কি করে? তাকে তো কেউ দিব্যশ্রবণশক্তি দেয়নি। যুদ্ধ যখন শেষ হয়ে যায় তখন অর্জুন শ্রীকৃষ্ণকে বলে— আমি যুদ্ধে আসক্তচিত্ত থাকায় যেসব কথা আপনি বলেছিলেন (গীতা) সে সমস্ত আমার লুপ্ত হয়ে গেছে। আপনি আমাকে তা শোনান। কৃষ্ণ প্রত্যুত্তরে বলেছিলেন— ধনঞ্জয়, তাহা আবার সমস্ত বলা আমার শক্তিসাধ্য নয়। তার মানে শ্রীকৃষ্ণ ভুলে গেছেন। তাহলে কি তিনি অবতার নন, সাধারণ মানুষ? সঞ্জয় এবং ধৃতরাষ্ট্রের মধ্যে কথোপকথনই গীতা। কিন্তু কথাগুলো লিখল কে? সেখানে তো কোনও লিপিকার ছিল না। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে কৌরব ও পাণ্ডব পক্ষ যুদ্ধের জন্য তাদের যোদ্ধাদের নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে লাইন দিয়ে। যুদ্ধ এক্ষুনি হবে। শুধু শঙ্খধ্বনির অপেক্ষা। প্রশ্ন হচ্ছে কৃষ্ণ এবং অর্জুনের বাক্‌ বিনিময়ের দীর্ঘ সময় যোদ্ধারা কি প্রতীক্ষা করছিল? যুদ্ধক্ষেত্রের মাঝখানে দাঁড়িয়ে এত দীর্ঘক্ষণ এই ধরনের সমাজসংস্কার ভিত্তিক, লোক-পরলোক সংক্রান্ত দীর্ঘ ভাষণ, কৃত্রিম কাহিনি শোনা কারো পক্ষে সম্ভব? সেই জন্য বলা হয় যে গীতা কোনও মৌলিক গ্রন্থ নয়, পরে তা সংযোজিত হয়েছে মহাভারতে।  বিবেকানন্দ সন্দেহ করতেন ভগবত গীতার সততা নিয়ে। সারা ভারতে খুঁজেছেন আসল গীতাকে। বলেছেন অষ্টম শতাব্দীর আগে গীতা জানতো না কেউ। শঙ্করাচার্য এর উপর মন্তব্য করে একে বিখ্যাত করেন। বলতেন অনেকে মনে করে শঙ্করাচার্য গীতা লিখে মহাভারতে ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন। 
ছলের অভাব হয় না
গীতার রচনাকাল প্রকৃতপক্ষে খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম শতক থেকে খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতক। মোটামুটিভাবে খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতককেই গীতার রচনাকাল বলে ধরা হয়। সেই সময়  কুষাণ যুগ। চারিপাশের সমাজে বৌদ্ধ প্রভাব স্পষ্ট। ধর্ম সেখানে মানবিকতা অর্থাৎ অহিংসা, মৈত্রী, করুণা। এই সময়ে সমাজে ধর্মবোধ, নানা দেশ থেকে নানা ধর্মের উৎপত্তি ও বিকাশ ও সংঘাতও ছিল। ব্রাহ্মণ্য ধর্ম এই সব কিছুর মধ্যে পুরানো প্রভাবের জায়গায় ছিল না। বৈদিক যজ্ঞ কিছু কিছু অনুষ্ঠিত হলেও মোটামুটি তার উপর থেকে সাধারণ মানুষের বিশ্বাস  বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মের প্রভাবে শিথিল হয়ে এসেছিল। বহু উপাস্যের ভিড়ে একটা অস্থিরতা সমাজে ঘুর্ণিত হচ্ছিল। তাই  ব্রাহ্মণ্যবাদের প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল অন্য সব মতের বিরুদ্ধে তার মতকে অভ্রান্ত বলে প্রতিষ্ঠিত করা। এর জন্য প্রয়োজন ছিল একটি মতাদর্শ এবং একটি কেন্দ্রীয় চরিত্র যিনি মতাদর্শের প্রবক্তা বা প্রতীক যাতে জনগণের বহুধা প্রসারিত ভক্তি এবং উপাসনার প্রবৃত্তি একটি স্থিরকেন্দ্র পায়। গীতা এবং কৃষ্ণ সেই কাজ সমাধা করে। যে মিশ্র সমাজ সে সময় নির্মিত হয়েছিল তাকে পরিচালনা করবার জন্য নির্দিষ্ট কোনও ছক বা নিয়মাবলী তৈরি ছিল না। নতুন বিন্যাসের জন্য নতুন নির্দেশ পাওয়া গেল কৃষ্ণের গীতাতে। বর্ণাশ্রম ধর্ম,নারীর সতীত্ব, রাজার সার্বভৌম আধিপত্য এবং শুদ্রের প্রশ্নাতীত হীনত্ব ও একনিষ্ঠ সেবা— এইগুলির ওপর দাঁড়িয়ে গেল গীতা নির্দেশিত সমাজ।
মানবিক নয় দানবিক
আত্মীয় বধের আশঙ্কায় যখন অর্জুন যুদ্ধে হতোদ্যম তখন কৃষ্ণ অর্জুনকে বলেছিলেন— দেহ জীর্ণ হলে নতুন এক দেহ পরিগ্রহ করে। দেহের সঙ্গে আছে আত্মা।"আত্মাকে তো কেউ বিনাশ করতে পারে না তাহলে সে কাহারো বিনাশের কারণ হইলো বলিয়া দুঃখিত হইবে কিরুপে?"। অর্থাৎ অর্জুন যদি কোনও ব্যক্তিকে যুদ্ধে হত্যা করেন তাহলে সেটা হত্যা নয়। কারণ এতে দেহ হয়তো নষ্ট হচ্ছে কিন্তু আত্মা থেকে যাচ্ছে।  উচিত নয়। কারণ—"যে জন্মে তাহার মরণ নিশ্চিত। যে মরে তাহার জন্ম নিশ্চিত। সুতরাং অবশ্যম্ভাবী বিষয়ে তোমার শোক করা উচিত নয়"। এককথায় যে মরবে তাকে খুন করে দেওয়া কোনও খারাপ কাজ নয়। খুনির খুনের গ্যারান্টি তৈরি করে দেওয়া!  এইভাবে যুদ্ধ করানোর ফাঁদ তৈরি করা হয়েছে। সারা পৃথিবী যুদ্ধের পরিবর্তে শান্তি চাইছে মানবতার কারণে। যুদ্ধে প্রণোদিত করা শ্রীকৃষ্ণের গীতা তাহলে কি অমানবিক নয়? কৃষ্ণ অর্জুনকে ভয় দেখিয়েছে  যুদ্ধ না করলে সে পাপের ভাগী হয়ে নরকে যাবে। লোকে তাকে মরণ সমান অকৃতি,ভীতু ,ছোট ভাববে। লোভ দেখিয়েছে  যুদ্ধে মৃত হলে সে স্বর্গে যাবে, জয়ী হলে পৃথিবী ভোগ করবে। যাবতীয় দর্শন ও নীতি বাক্য দিয়ে যখন অর্জুনকে রাজি করাতে পারেনি তখন কৃষ্ণ বিশ্বরূপ দর্শন করিয়েছে। মহাভারতে দুর্যোধন যাকে বলেছেন-বিশ্বরুপ তো যাদুবিদ্যা,ওটা আমরাও পারি। অর্জুন বিশ্বরুপে দেখেছেন -"... ভীষ্ম দ্রোণ কর্ণ এরা সব দ্রুত বেগে তোমার মুখের অভ্যন্তরে প্রবেশ করছে তোমার করাল দন্তে পৃষ্ঠ হচ্ছে। কেউ বা দন্তের ফাঁকে আটকে আছে..."। কৃষ্ণ এটাকে দেখিয়েই বলেছেন-তুমি যাদের বাঁচাতে চাইছো আমি তো ওদের মেরেই ফেলেছি। তুমি নিমিত্ত মাত্র। এতে তোমার দোষ নেই। ভাবের নীতি, দর্শন, ছলের শেষে শেষ অবধি কৃত্রিম অলৌকিকতার কৌশল নিতে হলো শ্রীকৃষ্ণকে, নিজেকে প্রতিষ্ঠার জন্য।
অবতার ও ধর্ম 
ধর্মযুদ্ধ? ধর্মরাজ যুধিষ্ঠির। নিজের স্ত্রীকে বাজি রেখে পাশা খেলেন। বনবাস পর্বে বলেও ফেলেন যে আসলে পাশাখেলায় জিতলে ইন্দ্রপ্রস্থ ছাড়াও  হস্তিনাপুর পাবো ভেবেছিলাম। তার মানে লোভ। লোভী দুর্যোধন একা নয়, যুধিষ্ঠিরও ছিলেন। তাহলে কে কার বিরুদ্ধে ধর্ম যুদ্ধ করছেন? কৃষ্ণ নিজে বলেছেন যে মায়াজাল সৃষ্টি করে তিনি যুদ্ধে জিতেছেন। কৃষ্ণ ও কুন্তী যুদ্ধের ঠিক আগে কর্ণকে আড়ালে নিয়ে গিয়ে বলেছিলেন যে পাণ্ডবেরা তোমার ভাই। নিঃস্বার্থ ছিল না। কর্ণকে মানসিকভাবে দুর্বল করে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে দেওয়া হয়েছিল। দ্বৈপায়ন হৃদে ভীম গদা যুদ্ধে পলায়মান দুর্যোধনকে শ্রীকৃষ্ণের ইঙ্গিতে অন্যায়ভাবে হত্যা করল। বলরাম  রেগে  তার লাঙল নিয়ে ভীমের দিকে তেড়ে আসলে কৃষ্ণ তাকে নিরস্ত করেন এই বলে— অন্যায় উপায়েই কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ জিততে পাণ্ডবদের  সাহায্য করেছি। কিন্তু তা  যাদব কুলের জাগতিক স্বার্থে। ভগবান নিজে স্বার্থান্বেষী এবং অন্যায়কারী! যুদ্ধের শেষে পাণ্ডবের পাঁচজন আর গৌরবের তিনজন বেঁচে ছিলেন। এদের মধ্যে কে দুষ্ট, কে সাধু, কে অসাধু কোনও কিছুই বোঝা যায়নি। যুদ্ধে যাদের মৃত্যু হলো তারা সকলেই সাধু বা সকলেই অসাধু নয়। অথচ কৃষ্ণের মতে যেহেতু তারা যুদ্ধে মৃত হয়েছে তারা সকলেই স্বর্গপ্রাপ্ত হয়েছে। তাহলে দেখা যাচ্ছে অসাধুরাও স্বর্গে চলে যেতে পারে ! ধর্ম সংস্থাপনার্থায় সম্ভাবামি যুগে যুগে-হলো কি করে? কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের পর কোনও ধর্মরাজ্য স্থাপিত হয়নি। যুদ্ধ শেষে বৃদ্ধ অন্ধ রাজা ধৃতরাষ্ট্র নিঃসহায় হয়ে বনে গেলেন। কুন্তী, গান্ধারীর বনে আগুনে পুড়ে মৃত্যু হলো। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের পর যুধিষ্ঠিরের হাতে রাজ্যভার অর্পণ করে শ্রীকৃষ্ণ দ্বারকায় চলে গেলেন। গান্ধারীর অভিশাপে নিজেদের মধ্যে যুদ্ধ করে যদুবংশ নির্মূল হয়ে গেল। পুত্র ও পতিহীন রমণীদের হৃদয় বিদারী ক্রন্দন, হাহাকার এবং দীর্ঘশ্বাসের মধ্যে  কৃষ্ণ রুক্মিণীকে আক্ষেপে বলে উঠলেন— আমার ধর্মরাজ্য ধুলায় গড়াগড়ি খাচ্ছে। উদভ্রান্ত কৃষ্ণ পাহাড়ের টিলায় বসে থাকা অবস্থায় জরা নামক নিষাদের নিক্ষিপ্ত তিরের আঘাতে দেহত্যাগ করলেন। এই হলো অবতারের অবতারত্ব, ধর্মরাজ্য স্থাপনের পরিণতি।
কোথা তুমি খুঁজিছ ঈশ্বর?
কাজ তোমার অধিকার, ফলে যেন তোমার কখনো প্রবৃত্তি না হয়। অতএব ফলের আশা ত্যাগ করে তুমি কর্ম করে যাও। কর্মফলে যেন তোমার আসক্তি না জন্মায়। বলছেন বৃন্দাবনের রাজপুত্র কৃষ্ণ। এর অর্থ পরিশ্রমের যত ফল সমাজের উচ্চাসনে অধিষ্ঠিত শ্রেণির মানুষেরা পাবে। শ্রেণিবিভক্ত সমাজে শাসক কৃষ্ণের এ'কথা বলা ছাড়া আর কোনও উপায় ছিল না।  গীতায় বলা হয়েছে— "অর্থ ত্যাগ ,আসক্তি ত্যাগ, বাসনা ত্যাগ, সংসারে আসক্তি ত্যাগ, করিয়াও সংসার করা যায়। বিষয় কামনা না করিয়াও বিষয় ভোগ করা যায়। ফল কামনা না করিয়াও কর্ম করা যায়।" একদিকে তিনি আসক্তি ছাড়ার জন্য অর্জুনকে বলছেন আবার অন্যদিকে রাজ্য দখল করার জন্য যুদ্ধ করতেও বলছেন। ক্ষত্রিয়কে যেমন স্বধর্ম পালন করার কথা বলছেন ঘুরিয়ে শ্রমজীবী, শুদ্রকেও  বার্তা পাঠাচ্ছেন যে স্বধর্ম পালন করো। মানে পরিশ্রম করো, ফলের আশা করো না ও  অন্য ত্রিবর্ণের সেবা করো। গীতায় বিবৃত আত্মা,পুনর্জন্ম, ঈশ্বর, জন্মান্তরবাদ— এসব শাসক- শোষক ও ধর্মব্যবসায়ীদের শোষণের বড় হাতিয়ার।  অবতার মানে অবতীর্ণ হওয়া । ঈশ্বর তো সর্বত্র বিরাজমান, তাহলে তাকে নতুন করে অবতীর্ণ হতে হবে কেন? যিনি এই মহাবিশ্বের অধীশ্বর তাকে তুচ্ছ কংসকে মারতে কেন জন্ম নিতে হবে? বেদে কিন্তু অবতার বলে কোনও শব্দ নেই, যা গীতায় আছে। অবতারত্ব মনুষ্যত্বের অবমাননা। তা মানুষের আত্মবিশ্বাস খর্ব করে হীনমন্যতাবোধ তৈরি করে।
জাগতে রহো
অনেকে বলেন মনুস্মৃতি ত্রুটিপূর্ণ, কিন্তু গীতা ভালো। আম্বেদকর তাদের তীব্র সমালোচক ছিলেন। তিনি বলতেন ফারাক শুধুমাত্র বিশদ বিবরণে, ধারণা বা দর্শনে নয়। গীতা লেখার উদ্দেশ্য দার্শনিক ভিত্তিতে ধর্মের কিছু মতবাদকে রক্ষা করা। যেমন শরীর এবং আত্মা পৃথক। যা তৈরি করা হয়েছে যুদ্ধ এবং যুদ্ধে হত্যার অজুহাতের জন্য। আম্বেদকার বলেছেন যে কৃষ্ণ প্রত্যেককে তার বর্ণের জন্য নির্ধারিত দায়িত্ব পালন করতে বলেন এবং ভক্তদের সতর্ক করেন যে শুধু ভক্তির মাধ্যমে তারা পরিত্রাণ পাবেন না ,বর্ণের জন্য নির্ধারিত কর্তব্যও তাকে পালন করতে হবে। অর্থাৎ শূদ্র যতই ভক্ত হিসাবে বড় হোক না কেন তাকে তার সঙ্গে উচ্চশ্রেণির সেবা করেই যেতে হবে। আম্বেদকার বলেছিলেন যে বুদ্ধ অহিংসা প্রচার করেছিলেন। ব্রাহ্মণরা ব্যতীত জনসাধারণের সিংহভাগ এটিকে জীবনের পথ হিসাবে গ্রহণ করেছিল। বুদ্ধ নিজেও চতুর্বর্ণের বিরুদ্ধে প্রচার করেছিলেন। বলেছিলেন শুদ্র এবং মহিলারাও সন্ন্যাসী হতে পারে। জনপ্রিয় এবং সেই সময়ের নিরিখে বিপ্লবী বৌদ্ধ ধর্মকে মোকাবিলা করবার জন্য  গীতা আনা হয়েছিল।
গীতা ভারতবর্ষের পশ্চাৎ মুখীনতার একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ আদর্শিক অস্ত্র যা... কুসংস্কার ও নিয়তিবাদী ও রহস্যবাদী ধারণা, এমনকি সাম্প্রদায়িক অবস্থানেরও সূচিমুখ। গীতা মানুষকে যুক্তিবাদ থেকে বিশ্বাসে নির্ভর করতে শিখিয়েছে, মিথ্যাকে সত্য হিসাবে দেখিয়েছে, ধর্মীয়কে রাজনৈতিক হিসাবে এবং রহস্যময়তাকে যুক্তিতে স্থাপন করেছে। অযোধ্যায় রাম মন্দিরের উদ্বোধনীর প্রস্তুতি চলছে। সেখানেও আদালত যুক্তিবাদ থেকে বিশ্বাসে ঝুঁকে পড়েছে। পুরাণকে ইতিহাস বানানো  হয়েছে। রাম মন্দিরের মাটি সংগ্রহ হচ্ছে গোটা দেশের আনাচে কানাচে থেকে। আসলে  হিন্দুত্বের আওয়াজ ছড়ানো হচ্ছে। গীতা পাঠের আসর আসলে রাম মন্দিরের খুঁটি পুজো। জাগতে রহো।

Comments :0

Login to leave a comment