ED RATION SCAM

হাসপাতাল জানালো ‘ভর্তি থাকার দরকার নেই’

রাজ্য

  তৃণমূলের হেভিওয়েটদের বারংবার অনুরোধ রাখল না বেসরকারি হাসপাতাল। সকালে বিপদমুক্ত, ভালো আছেন বলে বিকালে জ্যোতিপ্রিয় মল্লিককে ছুটির প্রস্তাব করল হাসপাতাল। আর সেই মেডিক্যাল রিপোর্ট সন্ধ্যায় আদালতে জমা দিয়ে জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক ওরফে বালুকে নিজেদের হেপাজতে নিয়ে নিলো এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট (ইডি)। আদালতের পূর্বোক্ত নির্দেশ অনুযায়ী ধৃত বালুকে সন্ধ্যায় আলিপুর কম্যান্ড হাসপাতালে নিয়ে শারীরিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে সরকারিভাবে নিজেদের হেপাজতে নেবে ইডি। 
রবিবার রাতে অবশ্য বালুকে ক্রিটিক্যাল কেয়ার ইউনিট থেকে হাসপাতালে ব্যক্তিগত কেবিনে পাঠানো হয়েছিল জ্যোতিপ্রিয় মল্লিককে। তিনি পুরোদস্তুর যে সুস্থ রয়েছেন সেই সিদ্ধান্ত নিতে সোমবার বিকালে হাসপাতালে বসেছিল মেডিক্যাল বোর্ড। সেখানে চিকিৎসকরা তাঁকে ছুটি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। গ্রেপ্তার হওয়া মন্ত্রীর সমস্ত শারীরিক পরীক্ষার রিপোর্টই স্বাভাবিক রয়েছে বলে জানা গেছে। হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, গত শুক্রবার ইডি’র তল্লাশি ও পরে গ্রেপ্তারির জেরে ২৪ ঘণ্টার বেশি সময় ওষুধ না খাওয়ার জেরেই অসুস্থ হয়ে গিয়েছিলেন জ্যোতিপ্রিয়। 
রাতে হয়তো খাওয়া দাওয়াও করেননি ঠিক করে। এর ফলে জ্ঞান হারান তিনি। পরবর্তীকালে যেন এই ধরনের পরিস্থিতি এড়িয়ে চলার পাশাপাশি মন্ত্রী নিয়মিত সুগার আর প্রেশারের ওষুধ খান, সেটা দেখতে হবে। মেডিক্যাল রিপোর্টে যা বলা হয়েছে তাতে  জ্যোতিপ্রিয় মল্লিকের শারীরিক যা অবস্থা তাতে তাঁকে হেপাজতে নিয়ে জেরা করা যাবে। তাতে কোনও বাধা নেই। এক মাস পরে তাঁকে ফের হাসপাতালে আসতে বলা হয়েছে। এই রিপোর্ট পাওয়ার পর ইডি’র গোয়েন্দাদের বাকি কাজ করতে আর বেশি সময় লাগেনি। 
গত শুক্রবার গ্রেপ্তারির পর ব্যাঙ্কশাল আদালতে  আচমকা অসুস্থ হয়ে পড়ার ভিত্তিতে প্রাক্তন খাদ্য মন্ত্রীকে ওই দিন রাতে ইস্টার্ন মেট্রোপলিট্যান বাইপাসের একটি বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। আদালতে প্রাক্তন খাদ্যমন্ত্রীর ১০ দিনের ইডি হেপাজত হলেও হাসপাতাল ‘সুস্থ’ ঘোষণা না করার পর্যন্ত তাঁকে জেরা করা যাবে না বলে সুস্পষ্ট নির্দেশ ছিল আদালতের। বেসরকারি হাসপাতালে যাবতীয় খরচ মন্ত্রীর পরিবারকে বহন করার পাশাপাশি আদালত জানিয়ে দিয়েছে সুস্থ হওয়ার পরে ইডি’র কাছে তুলে দেওয়া থেকে হেপাজতের দিন গোনা শুরু হবে। সেই হিসাবে এদিন থেকে শুরু হচ্ছে ইডি’র হেপাজতের মেয়াদ।  
এদিকে, জ্যোতিপ্রিয়’কে জেরার করতে ইডি’র পূর্ববর্তী সব পরিকল্পনা বানচাল হয়ে গেছে। ইডি’র গোয়েন্দারা চেয়েছিলেন জ্যোতিপ্রিয় মল্লিককে গ্রেপ্তারের পর নিজেদের হেপাজতে নিয়ে বাকিবুর রহমানের সামনে বসিয়ে জেরা করতে। কিন্তু মন্ত্রীর শরীর খারাপ হওয়ায় সেই গুড়ে বালি। সোমবারে আবার বাকিবুরের ইডি হেপাজত শেষ হচ্ছে। আদালত পরিষ্কার জানিয়ে দিয়েছে হাসপাতাল থেকে মন্ত্রী ছাড়া না পেলে তাঁকে হেপাজত শুরু হবে না। তাই এই পরিস্থিতিতে ইডি’র গোয়েন্দারা তদন্তের মোড় অন্যদিকে ঘোরাতে শুরু করল। তার ইঙ্গিত রবিবারেই মিলেছে। গতকালই মন্ত্রীর মেয়ে প্রিয়দর্শিনী মল্লিককে তলব করা হয়েছিল। সেই মতো তিনি এলেও ইডি’র গোয়েন্দারা অফিসে না থাকায় তিনি নাকি কোনও নথি জমা দিতে পারেননি। 
ওয়াকিবহাল মহল সূত্রে ইডি’র গোয়েন্দারা এখন প্রিয়দর্শিনীর আয়-ব্যয়ের মধ্যে বিস্তর ফারাকের তথ্য সংগ্রহ করতে আদা-জল খেয়ে নেমেছেন। তবে সোমবার সল্টলেকে সিজিও কমপ্লেক্সে ইডি দপ্তরে গিয়েছিলেন জ্যোতিপ্রিয় মল্লিকের দাদা দেবপ্রিয় মল্লিক। তিনি একপাতার একটি চিঠি লিখেই এনেছিলেন। তাঁকে ওই মামলার কেন পার্টি করা উচিত নয়, সেই ব্যাখ্যা ই ছিল ওই চিঠিতে। এদিন গোয়েন্দারা অবশ্য দেবপ্রিয় মল্লিককে জেরা করেননি, উলটে তাঁকে যথেষ্ট প্রাধান্য দিয়ে সামান্য সময় তাঁর সঙ্গে কথা বলেছেন।
তবে হঠাৎ করে মন্ত্রীর পরিবার নিয়ে ইডি টানাটানি করার পরিপ্রেক্ষিতে জানা যাচ্ছে রেশনের টাকা নয়-ছয় করতে তৈরি একাধিক শেল কোম্পানির ডাইরেক্টর পদে রয়েছেন বালু’র আত্মীয়-পরিজনরা। রেশন দুর্নীতির পরিপ্রেক্ষিতে রাজ্যের বিভিন্ন জেলার ১১টি চালকলে তল্লাশি অভিযান চালানোর সময়ই ওই সব ভুয়ো কোম্পানির হদিশ পায় ইডি। ইডির দাবি, ওই সব ভুয়ো সংস্থা নিজের স্ত্রী, পরিবারের সদস্য এবং বাকিবুরের মতো ঘনিষ্ঠদের মাধ্যমে চালাতেন বালু। 
আর ওই সব কোম্পানির মারফত ৯৫ কোটি টাকা তছরুপ করা হয়েছে বলে ইডি সূত্রে জানা গেছে। এই পরিস্থিতিতে জ্যোতিপ্রিয়’র পারিবারিক অ্যাকাউন্ট বাজেয়াপ্ত করেছে ইডি। বালু’র স্ত্রী এবং মেয়ের উপার্জনের ওপরেও বিশেষভাবে নজর রাখা শুরু হয়েছে। আয়কর রিটার্নের নথি খতিয়ে ইডি’র গোয়েন্দারা জানতে পেরেছেন, জ্যোতিপ্রিয়’র মেয়ে প্রিয়দর্শিনী নাকি টিউশন পড়িয়ে ৩.৩৭ কোটি টাকা উপার্জন করেছেন। যেটা একটু অস্বাভাবিক বিষয়!
আয়কর রিপোর্ট বলছে, ইউনিয়ন ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়া’র শাখায় রয়েছে প্রিয়দর্শিনী মল্লিকের অ্যাকাউন্ট। পেশায় প্রিয়দর্শিনী কলেজের সহকারী অধ্যাপক। তাঁর বার্ষিক আয় ২.৪৮ লাখ টাকা। অথচ তাঁর অ্যাকাউন্টে রয়েছে ৩.৩৭ কোটি টাকা। ইডির জেরার মুখে পড়ে বালু কন্যার দাবি, তিনি নাকি টিউশন পড়িয়ে ওই বাড়তি টাকা উপার্জন করেছেন। কত জন, কত টাকা নিয়ে পড়ালে ওই কোটি টাকা প্রাইভেট টিউশন থেকে পাওয়া যায়, তার চুলেচেরা বিশ্লেষণ চালাচ্ছে ইডি। 
এর পাশাপাশি বালু’র স্ত্রী মণিদীপা মল্লিকের অ্যাকাউন্ট রয়েছে আইডিবিআই ব্যাঙ্কে। সেখানে রয়েছে ৪.৩ কোটি টাকা রয়েছে। যতক্ষণ না পর্যন্ত ওই টাকার হিসাব পুরোদস্তুর মিলবে ততক্ষণ দুই অ্যাকাউন্ট ‘ফ্রিজ’ করে রাখা হবে বলে ইডি সূত্রে জানা গেছে। সোমবার আবার দুইজনের দুটি ব্যাঙ্ক লকারের সন্ধান মিলেছে। চাবিও এখন ইডি’র হাতে। গোয়েন্দা টিউশনি করে কোটি টাকা কামানোর প্রিয়দর্শিনী সম্পর্কে বিস্তারিত খোঁজ চালাচ্ছেন। প্রিয়দর্শিনী আগে উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা সংসদের সচিব হিসাবে নিযুক্ত ছিলেন। তিন বছর উচ্চ মাধ্যমিকের শিক্ষাসচিব পদ সামলানোর পর হঠাৎ তিনি কলকাতার আশুতোষ কলেজের মাইক্রোবায়োলজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক পদ পান। সেখানেই এখন রয়েছেন। 
জ্যোতিপ্রিয় মল্লিকের স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তির হিসাব করতে গিয়ে ইডি’র গোয়েন্দাদের রীতিমতো বিপাকের মধ্যে পড়তে হচ্ছে। রেশন বণ্টন দুর্নীতি একদিন সামনে আসবে, সেটা জানতেন বালু। তাই কৌশলে সব ক্ষেত্রেই প্রাক্তন খাদ্য মন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক নিজেকে আড়াল করে রাখার চেষ্টা চালিয়ে গেছেন।  রেশন দুর্নীতির কালো টাকা সাদা করার জন্য  তিনটি সংস্থা খোলা হলেও কোনও সংস্থাতেই তিনি অধিকর্তা হিসাবে ছিলেন না।
যশোর  রোডের ভগবতী কলোনির ফ্ল্যাটে ছিল একটি ভুয়ো সংস্থার অফিস। খোঁজ নিয়ে দেখা যায় ওই ফ্ল্যাটের মালিকানায় নাম রয়েছে মন্ত্রীর আপ্ত সহায়ক অমিত দে’র নামে। তদন্তকারীদের দাবি, ভুয়ো তিন সংস্থার অধিকর্তাদের পদে রয়েছেন মন্ত্রীর স্ত্রী ও কন্যা। ওই সব সংস্থার পরিচালন বোর্ডে রেশন দুর্নীতিতে ধৃত বাকিবুর রহমান এবং মন্ত্রীর প্রাক্তন আপ্তসহায়ক অভিজিৎ দাসের পরিবারের সদস্যদের নাম থাকলেও মন্ত্রী নেই। আদালতে সেকথা হলফনামায় জানিয়েছে ইডি। 
দিনক্ষণের হিসাব লিখে গোয়েন্দারা জানিয়েছেন, ওই সংস্থাগুলির  মাধ্যমে কালো টাকা সাদা হওয়ার পরে সংস্থা থেকে মন্ত্রী’র স্ত্রী ও কন্যা পদত্যাগ করেন। দুর্নীতির কালো টাকার একটি বড় অংশ বাকিবুরের মালিকানাধীন ‘এনপিজি গ্রুপ অব কোম্পানি’র নামে থাকা হোটেল ও পানশালায় বিনিয়োগ করা হয়েছে। কাগজে কলমে এখনো কোথাও জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক ওরফে বালু’র নাম মিলছে না। চার্জশিট কিংবা আদালতে দুর্নীতি প্রমাণ করতে এটা একটা বড় সমস্যা। 
বাকিবুরের বয়ান আর তার মোবাইল হোয়াটসঅ্যাপ চ্যাটে টাকা দেওয়া নেওয়ার ভিত্তিতে রেশন দুর্নীতিতে জ্যোতিপ্রিয়’র নাম আসে। সেই সঙ্গে মন্ত্রী প্রাক্তন ও বর্তমান দুই আপ্ত সহায়কের দেওয়া বয়ানের ভিত্তিতে ইডি কয়েকটি নথি সংগ্রহ করতে পেরেছে। কিন্তু রেশন দুর্নীতির মতো বড় কেলেঙ্কারিতে জ্যোতিপ্রিয়’কে বিঁধতে হলে আরও অকাট্য প্রমাণ দরকার। বাকিবুরের হোয়াটসঅ্যাপ চ্যাটে ‘এমআইসি’ (মিনিস্টার ইন-চার্জ) হিসাবে জ্যোতিপ্রিয়কে ’একাধিক বার মোটা টাকা দেওয়া কথা আছে। 
এর পাশাপাশি প্রাক্তন আপ্ত সহায়ক অভিজিৎ দাসের হাওড়ার কদমতলার বাড়ি থেকে উদ্ধার মেরুণ ডায়েরিতে জ্যোতিপ্রিয় কার কাছ থেকে কতটাকা নিয়েছেন তা হিসাব আছে। তবুও প্রত্যক্ষ জড়িত থাকার একটা প্রমাণ মিললেই বাকিসব দিয়ে একটা অভিযোগের মালা তৈরি করা যাবে। অস্পষ্ট তদন্তরেখার মধ্যে ইডি’র একমাত্র আশার আলো বাকিবুর। কেননা বাকিবুরের ক্রমাগত সম্পত্তি উদ্ধার হচ্ছে। সোমবারেও উত্তর ২৪ পরগনার আমডাঙ্গায় ১হাজার কাঠা জমির সন্ধান মিলেছে। বাকিবুরের সম্পত্তি মানচিত্র কোনভাবে জ্যোতিপ্রিয় মল্লিকের কোনও অংশীদারিত্ব পেলেই কেল্লাফতে। সেই সঙ্গে বাকিবুরের একটাই কথা ইডি গোয়েন্দাদের আশ্বস্ত করছে —  ‘আমি ফাঁসলে সবার নাম বলে দেব।’

Comments :0

Login to leave a comment