NTA MODI

মৌনী গুরু

সম্পাদকীয় বিভাগ

সর্বভারতীয় মেডিকেলে ভর্তির পরীক্ষায় এবং ক‍‌লেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা ও পিএইচডি গবেষণার যোগ্যতা নির্ণায়ক পরীক্ষায় অনিয়ম, অস্বচ্ছতা ও দুর্নীতির যে কুৎসিত চেহারা ইতিমধ্যে প্রকাশ হয়েছে তাতে ন্যূনতম নৈতিক দায়বদ্ধতা থাকলে এবং আত্মসম্মানবোধ থাকলে কেন্দ্রীয় শিক্ষামন্ত্রীর নিজের থেকেই পদত্যাগ করা উ‍‌‍‌চিত ছিল। কিন্তু তিনি যখন তা না করে পদ আঁকড়ে ল্যা‍‌জে গোবরে অবস্থার শিকার হচ্ছেন তখন প্রধানমন্ত্রীর উচিত ছিল তাঁকে বরখাস্ত করে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নি‍‌জের দায়বদ্ধতা প্রমাণ করা। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীও তাঁর দায়বদ্ধতার প্রমাণ দেননি। অবশ্য প্রধানমন্ত্রীর কাছে তেমন দায়বদ্ধতা আশা করা বাতুলতা। তি‍‌নি অতিমাত্রায় ভাবমূর্তি সচেতন কৌশলী রাজনীতিক। সরকার পরিচালনায় ব্যর্থতা-অপদার্থতা নিয়ে বিতর্ক দেখা  দিলে বা দুর্নীতি-কেলেঙ্কারি নিয়ে শোরগোল শুরু হলে তিনি সচেতনভাবে তার থেকে নিজেকে সরিয়ে মৌনব্রত অবলম্বন করেন। এক পক্ষকাল থেকেও বেশি সময় ধরে নিট ও নেট পরীক্ষায় সীমাহীন দুর্নীতির অজস্র নমুনা সামনে এলেও এবং দেশময় তোলপাড় শুরু হলেও প্রধানমন্ত্রী যথারীতি নীরব। এখনও পর্যন্ত তার মুখে একটি শব্দও শোনা যায়নি। তিনি দেশে বিদেশ ঘুরে বেড়াচ্ছেন, একই সরকারি প্রকল্পের কথা বার বার ঘোষণা করছেন। ‍ভোটমুখী কাশ্মী‍রে পরপর সন্ত্রাসবাদী হামলায় উদ্বিগ্ন হয়ে মোকাবিলার নির্দেশ দিচ্ছেন। নি‍‌জের নির্বাচন কেন্দ্র সফর করছেন। যোগাসন করতে কাশ্মীরে ছুটে যাচ্ছেন। কিন্তু উচ্চশিক্ষা ও চিকিৎসা শিক্ষায় ভয়াবহ দুর্নীতি নিয়ে একটা শব্দও ব্যয় করার প্রয়োজন বোধ করেননি। অর্থাৎ তার কাছে এসব দুর্নীতি স্বাভাবিক ঘটনা।

শিক্ষামন্ত্রী প্রথমে সমস্ত অভিযোগ সরাসরি অস্বীকার করে বিরোধীদের রাজনীতি বলে উড়িয়ে দিলেও এখন প্যাঁচে পড়ে দায় স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছেন। বিজেপি শাসিত দুই রাজ্য বিহার ও গুজরাট থেকেই দুর্নীতির অজস্র প্রমাণ মিলেছে, গ্রেপ্তারও হয়েছে অনেক। স্পষ্ট হয়ে যাচ্ছে মোদী জমানায় তৈরি এনটিসি শিক্ষা মাফিয়াদের কবজায় চলে গেছে। কেন্দ্রীভূত পরীক্ষা ব্যবস্থা চালু করে দুর্নীতির চক্রজালে জড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। শত শত কোটি টাকার ব্যবসা শুরু হয়ে গেছে এক একটি পরীক্ষাকে কেন্দ্র করে। গত  ছ-সাত বছর ধরে একটার পর একটা পরীক্ষায় দুর্নীতির অভিযোগ সামনে এলে উড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। কোনোরকম তদন্ত না করে দুর্নীতির জালকে আরও পোক্ত হবার সু‍‌যোগ ‍‌তৈরি করে দেওয়া হয়েছে। এখন সেটা এতটাই ব্যাপক ও ভয়াবহ আকার নিয়েছে যে, সবটাকেই কার্যত গ্রাস করে ফেলেছে।

দুর্নীতি যে হচ্ছে এবং বাড়ছে সেটা সরকারের অজানা ছিল না। ভূত ছিল সরষের মধ্যেই। কিন্তু সেটাকে আড়ালে রাখাই ছিল সর্বোচ্চ অগ্রাধিকারে। দুর্নীতি আড়াল করতেই ১৪ দিন আগে আচমকা ভোটের ফল প্রকাশের দিন নিটের ফল প্রকাশ করে দেওয়া হলো যাতে কেউ সেদিকে নজর দিতে না পারে। মন্ত্রীও সরাসরি সব অভিযোগ অস্বীকার করেছিলেন  দুর্নীতি লুকোবার জন্যই। প্রধানমন্ত্রীও নীরবতা পালন করছেন সেই একই উদ্দেশ্যকে সামনে রেখেই। আসলে ৭৫ বছর ধরে তিলে তিলে গড়ে ওঠা শিক্ষাব্যবস্থাকে ভেঙে তছনছ করে যুক্তিহীন অবৈজ্ঞানিক কুসংস্কার সর্বস্ব শিক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলার লক্ষ্যে মোদী সরকার যেসব পদক্ষেপ নিয়েছে তারই অনিবার্য পরিণতি এটা। ইতিহাস শিক্ষাকে বেদ-উপনিষদ-পুরাণ-মহাকাব্যের খাঁচায় আবদ্ধ করা হয়েছে। বিজ্ঞানকে উচ্ছেদ করে অন্ধ বিশ্বাস ও কুসংস্কারকে প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে। দর্শন শিক্ষাকে পরিণত করা হয়েছে হিন্দু ধর্মতত্ত্বে। তারজন্য শিক্ষা সংক্রান্ত সমস্ত প্রতিষ্ঠানের মাথায় এবং বিশ্ববিদ্যালয়, গবেষণা সংস্থার মাথায় বসানো হয়েছে বাছাই করা আরএসএস’র লোকদের। এরা সকলে মিলে আধুনিক উচ্চ শিক্ষার মানেটাই বদলে দিয়েছেন। সারাবিশ্বের কাছে ভারতের উচ্চ শিক্ষা ব্যবস্থা হাস্যকর করে তুলেছেন। ডাক্তারি পরীক্ষার প্রশ্নে রামায়ণ-মহাভারত, বেদ-পুরাণের প্রশ্নের বালখিল্যপনার ছড়াছড়ি। বিশ্বগুরু যে ভারতকে কত নিচে নামাতে পারেন উচ্চ শিক্ষা ব্যবস্থাই তার কুৎসিত নমুনা।

Comments :0

Login to leave a comment