নরেন্দ্র মোদীর রাজত্বে দেশের সংসদীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা যে পদে পদে দলিত ও লাঞ্ছিত হয়ে চলেছে তার সর্বশেষ দৃষ্টান্ত ওয়াকফ সংশোধনী বিল নিয়ে যৌথ সংসদীয় কমিটির তুঘলকী সিদ্ধান্তে। কোনোরকম আলোচনা ছাড়াই কমিটির বিজেপি চেয়ারম্যান স্বৈরাচারী কায়দায় একতরফাভাবে বিরোধীদের আনা সবকটি সংশোধনী বাতিল করে দিলেন আর শাসক দল তথা বিজেপি’র আনা সবকটি সংশোধনী গ্রহণ করার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করে দিলেন। দেশটাকে নিজেদের জমিদারি ভাবার অভ্যেস প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে শাসকদলের নেতারা যে রপ্ত করে ফেলেছেন তা আর একবার প্রমাণ করে দিলেন ওয়াকফ সংশোধনী বিল সংক্রান্ত যৌথ সংসদীয় কমিটির চেয়ারম্যান জগদম্বিকা পাল। কয়েকদিন আগে কমিটির সভা চলাকালীন তুমুল বিতর্কের মধ্যে বিরোধী সদস্যদের সভা থেকে বহিষ্কার করে নিজের দলীয় সদস্যদের নিয়ে সভা করেন। এবার গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের শেষ অবশেষটুকুও বিসর্জন দিয়ে কোনোরকম আলোচনা পর্যালোচনার সুযোগ না দিয়ে বিরোধীদের সব সংশোধনী একবাক্যে খারিজ করে দিলেন। গ্রহণ করলেন কেবলমাত্র নিজের দলের সাংসদদের দেওয়া সংশোধনী। এরপর পরবর্তী বৈঠকে নিজেদের দেওয়া সংশোধনীর ভিত্তিতে রিপোর্ট তৈরি করে লোকসভার অধ্যক্ষের কাছে জমা দেওয়া হবে। সেই রিপোর্টের উপর দাঁড়িয়ে সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে পাশ করানোর চেষ্টা হবে ওয়াকফ সংশোধনী বিল।
সংসদীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় যে কোনও সিদ্ধান্ত নেবার আগে বা যে কোনও বিল পাশ করানোর আগে সেই বিষয় বা বিল নিবিড়ভাবে অনুধাবন করা সুযোগ দিতে হয় সব সদস্যকে। তারপর পক্ষে বিপক্ষে সমস্ত মতামত ব্যক্ত করার, ব্যাখ্যা করার, আলোচনা করার, এমনকি বিতর্ক করারও পর্যাপ্ত সময় দিতে হয়। যেসব বিল অনেকটা জটিল, যেগুলি গভীরে গিয়ে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া প্রয়োজন সেগুলি নিয়ে সংসদে অল্প সময়ের আলোচনার বদলে যৌথ সংসদীয় কমিটিতে বিস্তারিত আলোচনার ব্যবস্থা হয়। ওয়াকফ বিলের মতো একটি ধর্মীয়ভাবে সংবেদনশীল বিষয় নিয়ে হিন্দুত্ববাদী দৃষ্টিভঙ্গিতে একতরফা সিদ্ধান্ত নেওয়াকে মেনে নেয়নি বিরোধী। মূলত বিরোধীদের চাপেই সরকার বাধ্য হয় যৌথ সংসদীয় কমিটি গঠনে। কিন্তু তাতেও জমিদারিসুলভ স্বৈরাচারী চরিত্র ফিকে হয়নি। আসলে শাসক দল আগে থেকেই ঠিক করে রেখেছে তারা যেভাবে চায় ঠিক সেভাবেই বিলটি সংশোধন করবে। কোনোরকম অন্যথা হতে দেবে না। তাই সমস্ত রকমের গণতান্ত্রিক রীতি-নীতি-পদ্ধতি ছুঁড়ে ফেলে বিরোধীদের অধিকারকে নস্যাৎ কর নিজেদের মতো করে রিপোর্ট তৈরির বন্দোবস্ত করা হয়েছে।
এখন প্রশ্ন হলো মোদী-শাহ’রা যদি এটাই চান যে তাঁরা যেহেতু ক্ষমতায় তাই তাঁরা যা যা যেমনভাবে চান তেমনই হবে তাহলে জেপিসি গঠনের প্রয়োজনই ছিল না। সংসদেও আলোচনা ছাড়া ধ্বনি ভোটে পাশ করিয়ে নিতে পারতেন, যেমন বেশিরভাগ বিলের ক্ষেত্রে অতীতে করা হয়েছে। মোদীদের কাছে এই বিল মুসলিমদের ওয়াকফ সম্পত্তি রক্ষা ও পরিচালনা আসল উদ্দেশ্য নয়, একে ঘিরে বিতর্ক তৈরি করে ধর্মীয় ও সাম্প্রদায়িক বিভাজনই লক্ষ্য। আর বিতর্ক তৈরি করার জন্যই বোর্ডে দু’জন মহিলা সদস্য এবং দু’জন অন্য ধর্মের লোক রাখার কথা বলা হয়েছে। অর্থাৎ মুসলিমদের ধর্মীয় এক্তিয়ারে অন্য ধর্মের অর্থাৎ হিন্দুদের ঢুকিয়ে ধর্মীয় বিবাদ সৃষ্টির স্থায়ী ব্যবস্থা করতে চাইছে। ওয়াকফ বোর্ড একান্তভাবে মুসলিমদের ধর্মীয় পরিসর। সেখানে সরকারি হস্তক্ষেপ বা অনুপ্রবেশ কোনও ধর্মনিরপেক্ষ দেশে চলতে পারে না।
এই বিতর্কের মধ্যেই হিন্দু সাধুরা সনাতন বোর্ড গঠন করে দেশের সব মন্দির, ধর্মীয় সম্পত্তি, জমি জমা সেই বোর্ডের হাতে তুলে দেবার দাবি তুলেছে। অর্থাৎ সুপরিকল্পিতভাবে বিদ্বেষ-বিরোধ তৈরি করে অশান্তির আগুন জ্বালানোর চেষ্টা হচ্ছে। সংখ্যালঘুদের ধর্মীয় পরিসরে এমন গেরুয়া দাপট বৃদ্ধির এমন সর্বনাশা খেলা অবিলম্বে বন্ধ না হলে দেশের সম্প্রীতি ও ঐক্যের বিপদ আরও বাড়বে।
Comments :0