চন্দন দাস: বৈষ্ণবনগর
পুলিশ সুতির ইজাজ আহম্মেদের শরীর ছিন্নভিন্ন করা বুলেট সরিয়েছে। সামশেরগঞ্জে দুষ্কৃতীরা যাতে চার-পাঁচ ঘণ্টা তাণ্ডব চালাতে পারে, সেই সুযোগও দিয়েছে পুলিশ। আবার সেই পুলিশই বৈষ্ণবনগরের মাঝিদের আটকেছিল নৌকা নিয়ে উদ্ধারে যেতে। সামশেরগঞ্জের ঘরছাড়াদের আশ্রয় দিয়েছে মালদহের বৈষ্ণবনগরের গ্রাম। সেই গ্রামের শিবিরে ঢুকে বিজেপি’র নেতা ভাষণ দিয়ে ‘সনাতন ধর্মের’ মানুষের মধ্যে মঙ্গলবার উদ্বেগ ছড়ালেন। অথচ এই পুলিশ সোমবার সুতি, সামশেরগঞ্জে বামপন্থীদের প্রতিনিধি দলকে আটকানোর চেষ্টা করেছিল।
মুর্শিদাবাদ-মালদহের সীমান্তের গ্রামগুলিতে গত কয়েকদিনের ঘটনা বলছে, তৃণমূলের প্রধান এজেন্ট হিসাবে পুলিশ বিজেপি-কে তুলে ধরার, হিন্দুত্ব প্রচারের সুযোগ করে দেওয়ার টেন্ডার নিয়েছে।
মূলত মাঝিদের তৎপরতায় রাতের গঙ্গা পেরিয়ে মুর্শিদাবাদের সামশেরগঞ্জ থেকে মালদহের বৈষ্ণবনগরের পারলালপুরে আশ্রয় নিতে পেরেছিলেন আক্রান্তরা। আশ্রয় শিবির করেছেন পারলালপুরের গ্রামবাসীরা। নমশূদ্ররা এই গ্রামে সংখ্যাগরিষ্ঠ। অধিকাংশের পূর্বপুরুষ বাংলাদেশের পাবনা, রাজশাহী সহ কয়েকটি অঞ্চলের বাসিন্দা ছিলেন। সেই গ্রামবাসীদের মধ্যে সিপিআই(এম) সমর্থক, তৃণমূল সমর্থক, বিজেপি’র সমর্থকরা আছেন। তবে যদি নির্দিষ্ট একটি বৈশিষ্ট্যে পারলালপুরের মানুষকে চিহ্নিত করতে হয়, তাহলে অনায়াসে বলা যায়, গরিবরা এই এলাকায় সংখ্যাগুরু। ভুট্টা চাষ আছে। আর আছে, বিশেষত আছে, ইলিশ, পিয়ালীর মতো মাছের খোঁজে সন্ধ্যা, রাত তোলপাড় করা মানুষ।
পারলালপুরের বাতাসে পদ্মাপারের গান। সেই পারলালপুরে এখন রাতের গঙ্গা উজিয়ে ‘মাছ-মারাদের’ ছোট নৌকায় বেতবোনা, জাফরাবাদের মানুষদের উদ্ধারের অহঙ্কার আর সেই মানুষদের যন্ত্রণার অংশীদারিত্ব। উত্তম মণ্ডলের কথায়, “ওপারে অনেক আত্মীয় থাকে। অনেক বন্ধুরা আছে। তাদের বিপদ বুঝে আমরা আশ্রয় দিয়েছি। কোনও দল দেখে দিইনি। আমরাও কে কোনও দলের ভোটার, কর্মী ভাবিনি। প্রথম দু’দিন আমরাই, গ্রামের সবাই চাঁদা তুলে এতগুলো লোকের খাওয়ার ব্যবস্থা করেছি।”
বৈষ্ণবনগরের এই নদী-ছুঁয়ে আসা বাতাস বুকে ভরে বেঁচে থাকা গ্রামে ১৯৭৮-এ তৈরি হাইস্কুলে হয়েছে আক্রান্তদের শিবির। সেখানেই ‘হিন্দুদের এবার ঐক্যবদ্ধ হওয়ার’ প্রচার করছে বিজেপি, আরএসএস। মঙ্গলবার আশ্রয় শিবিরে এসেছিল বিজেপি’র একটি দল। হাইস্কুলে আশ্রয় শিবির। স্কুলের মধ্যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নামাঙ্কিত মঞ্চে দাঁড়িয়ে বিজেপি’র নেতা খগেন মুর্মু ভাষণ দিলেন। তাঁর দাবি, “সর্বত্র, প্রতি দিন সনাতন ধর্মের মানুষের উপর এই আক্রমণ চলছে। এটি আমরা বরদাস্ত করবো না। আরও বড় বড় ঘটনা ঘটনা ঘটতে পারে। আমরা খবর পাচ্ছি।”
আধা সামরিক বাহিনীর নিরাপত্তা রক্ষী নিয়ে আশ্রয় শিবিরে ‘আক্রান্ত সনাতন ধর্ম’ নিয়ে ভাষণ দেওয়ার সুযোগ সাংসদ মুর্মুকে কে দিলো, নিঃসন্দেহে এটা প্রশ্ন। অথচ সোমবার বামপন্থীদের প্রতিনিধি দল সামশেরগঞ্জ, সুতির আক্রান্তদের বাড়ি বাড়ি গিয়েছে। কিন্তু মহম্মদ সেলিম, মীনাক্ষী মুখার্জি সহ সেই প্রতিনিধি দলের কেউ ভাষণ দেওয়ার চেষ্টা করেননি।
তৃণমূল সরকারের অপদার্থতায়, পুলিশের নিষ্ক্রিয়তায় তৈরি সাম্প্রদায়িক উত্তেজনার লাভের গুড় এভাবেই তুলতে নেমেছে সঙ্ঘ পরিবার।
মাঝে গঙ্গা। উত্তরে মালদহ জেলার পারলালপুর। দক্ষিণে সামশেরগঞ্জের জাফরাবাদ, বেতবোনা প্রভৃতি গ্রাম। শুক্রবার রাতে সামশেরগঞ্জের আক্রান্ত গ্রামবাসীদের পারলালপুরে নিয়ে এসেছেন যাঁরা, তাঁরা মৎস্যজীবী। সেই আক্রান্তদের উদ্ধারেও বাধা দিয়েছে পুলিশ। সাক্ষী পারলালপুর, সামশেরগঞ্জ। নিজের জেলে নৌকায় ৮জনকে এপারে নিয়ে আসা বিষ্ণু মণ্ডল মঙ্গলবার বললেন,” তখন নদীতে মাছ মারছিলাম। ফোনে খবর এল ওপারের আত্মীয়, বন্ধুরা বিপদে। আমরা গ্রামে উঠে এসে সবাইকে খবর দিই। আরও অনেকে বেরিয়ে আসে। অনেকগুলি নৌকা লাগবে। আমাদের মাছ-মারা নৌকায় তো আর অনেকজন করে হবে না। তাই বেশি নৌকা লাগবে। আমরা যখন সবাই নদী পেরিয়ে ওপারের চর থেকে বেতবোনা, গিধড়ি, জাফরাবাদের লোকজনকে নিয়ে আসতে যাচ্ছি, পুলিশ রাস্তা আটকে বলে ‘যাওয়া যাবে না। ওপারের লোকের ব্যবস্থা ওরাই বুঝবে।”
তারপর?
বিষ্ণু মণ্ডলের পাশে এসে দাঁড়ানো বিভাস বললেন, ‘‘আমরা বাধা মানিনি। বিডিও-কে ফোন করে বলেছি আমরা যাবো। পুলিশকে বলুন সরতে। বিডিও না বলতে পারেননি। আমরা চলে যাই রাতের নদী পেরিয়ে ওপারের চরে।”
ওপারের পুলিশ দুষ্কৃতীদের বাধা দেয়নি ভাঙচুর, লুট, খুন করতে। এপারের পুলিশ সেই আক্রান্তদের উদ্ধারে বাধা দিয়েছে। অযথা দেরি করিয়েছে।
কালিয়াচক-৩ নং ব্লকের যে ভিডিও শুক্রবার রাতে নিমরাজি হয়ে উদ্ধারে বাধা দেননি গ্রামবাসীদের, সেই বিডিও-র বিরুদ্ধে অভিযোগ জানিয়েছেন পারলালপুরের গ্রামবাসীরা। সনৎ মন্ডলের কথায়, “উনি শনিবার এসে বলেছেন, কে বিপদে ঠিক নেই/ পাড়াপড়শির ঘুম নেই। আমরা ওনাকে বলেছি, আপনি যান। গিয়ে ঘুমোন এসি ঘরে। আমরা বুঝে নিচ্ছি কে জাগবে, কে জাগবে না।”
পারলালপুরের এই গ্রামবাসীরাই শনিবার বৈষ্ণবনগরের বিধায়ক, তৃণমূল নেত্রী চন্দনা সরকারকে ঘিরে বিক্ষোভ দেখিয়েছেন। তৃণমূলের ওই বিধায়ককে কার্যত তাড়িয়েছেন। কেন? গোবিন্দ পালের কথায়, ‘‘এমএলএ এসে আমাদের সাহায্য করবেন, সেটাই তো আমরা আশা করেছিলাম। উনি এসে খবরদারি করার মতো কথা বলতে শুরু করলেন। মহিলারা ওনাকে ঘিরে ধরেন। উনি হুমকি দিতে দিতে চলে যান।”
তৃণমূলের নেতাদের দেখা যাচ্ছে না পারলালপুরে। তৃণমূলের নেতাদের দেখা যাচ্ছে না নদীর ওপারে সামশেরগঞ্জ, সুতির আক্রান্ত এলাকাতেও। সুতির যে এলাকায় পুলিশের গুলিতে একুশ বছরের যুবক ইজাজ আহম্মেদের মৃত্যু হয়েছে, সেই কাশিমনগর সহ লাগোয়া গ্রামগুলিতে তৃণমূলের নেতারা পা রাখতে ভরসা পাচ্ছেন না। এক ছবি পারলালপুরেও। তৃণমূল অথবা রাজ্যের সরকার— দুইয়ের প্রতিনিধি হিসাবে শুধু হাজির পুলিশের উচ্চ পদস্থরা। কিন্তু পুলিশের অবস্থাও শোচনীয় হতে দেখা যাচ্ছে। মঙ্গলবার পুলিশকে ধাক্কা মেরে সরিয়ে একদল গ্রামবাসীকে দেখা গেল পারলালপুরের আশ্রয় শিবিরের লোহার দরজা খুলে ঢুকে পড়তে।
তৃণমূলের প্রতিনিধি হিসাবে সামনে পাওয়া পুলিশকে যা খুশি বলছেন গ্রামবাসীরা, ক্ষোভে, রাগে। সুতিতে কাশিমবাজারে নিরপরাধ যুবকদের রাতে থানায় তুলে নিয়ে গেছে পুলিশ। ক্ষোভ সেখানেও।
মঙ্গলবার পারলালপুরে আশ্রয় শিবিরে গিয়ে আক্রান্তদের সঙ্গে কথা বলেন সিপিআই(এম)’র এক প্রতিনিধি দল। সেই দলে ছিলেন পার্টির মালদহ জেলা সম্পাদক অম্বর মিত্র, পার্টিনেতা তথা প্রাক্তন বিধায়ক বিশ্বনাথ ঘোষ, এসএফআই’র জেলা সম্পাদক চিরঞ্জিত মণ্ডল প্রমুখ। তাঁরা আক্রান্তদের সঙ্গে কথা বলেছেন। তাঁদের পাশে থাকার বার্তা দিয়েছেন।
Communal tension
বিজেপি-কে তুলে ধরার তৃণমূলী প্রকল্পের টেন্ডার নিয়েছে পুলিশ

×
Comments :0