Post Editorial

বঞ্চনার ১০০০ দিন— ইনসাফ চাই

উত্তর সম্পাদকীয়​


ইন্দ্রজিৎ ঘোষ 
আগামী ৯ ডিসেম্বর ধর্মতলার গান্ধী মূর্তির পাদদেশে ধরনা আন্দোলনের ১০০০ দিন। 
প্রায় ৩ বছর। স্বাধীন ভারতে সে সমস্ত আন্দোলন  শাসক দলেকে ভয় ধরিয়েছে সব আন্দোলনের গুরুত্ব  মাথায় রেখেই বলছি, আমাদের রাজ্যে শিক্ষক নিয়োগে দুর্নীতির বিরুদ্ধে আন্দোলনের মাত্রা সেই আন্দোলনগুলির সমকক্ষ দাবি না করলেও আন্দোলনের মাত্রা ওই আন্দোলনগুলির থেকে কিছু কম নয় তা বলাই যেতে পারে। 
রোদ, ঝড় , বৃষ্টি , কুয়াশা, শীত সব কেটেছে ধরনা মঞ্চে। শারদ উৎসব, দীপাবলি,ভাইফোঁটা,  ঈদ, বকরিঈদ,মহরম, বড়দিন, পৌষপার্বন, নববর্ষ... সবই কেটেছে রাস্তায়। উৎসবের আলোয় যখন শহর মাতোয়ারা তখনও আন্দোলন চলেছে।
হ্যাঁ, কার্নিভাল করার জন্য কাপড় দিয়ে ঢাকা হয় ধরনামঞ্চ, তাতেও নিরাপত্তার অভাব বোধ করে শাসক দল, তাই ওই দিন ধরনা মঞ্চ বন্ধ করে দেওয়া হয়। ঈদের নামাজ হয় রেড রোডে, ধরনা মঞ্চেও নামাজ পড়ে সংখ্যালঘু ভাইবোনরা। ঈদের দিন  মুখ্যমন্ত্রী আশ্বাস দিয়ে চলে যান কিন্তু কিছুই হয় না। 
আন্দোলনকারীদের ডেকে নিয়ে যাওয়া হয় খোকাবাবুর অফিসে সেখানেও আশ্বাসবাণী শোনানো হয় কিন্তু কোনও কাজ হয় না। 
হবে না এটা আমরা সবাই জানি। কারণ ওরা শাসক দলের নেতা মন্ত্রীদের দুর্নীতির শিকার। 
তৃণমূলের নেতারা চুরি করেছে তাই ওরা বঞ্চিত।

তৃণমূল নেতারা কিভাবে চুরি করল একটু বিস্তারিত বলি। 
বামফ্রন্ট সরকারের সময় স্কুল সার্ভিস কমিশন তৈরি হয়। সেই সময় স্কুল গুলি শিক্ষক নিয়োগ হতো RLST (Regional Lavel Selection Test) এর মাধ্যমে।  পশ্চিমবঙ্গ ৫ টা রিজিওনালে ভাগ করে পরীক্ষা নেওয়া হতো যাতে প্রান্তিক অংশের স্কুল গুলিতে ও ভালোভাবে শিক্ষক নিয়োগ করা যায়। এই সরকার এসে প্রথমেই সেটা ভেঙে SLST (State Lavel Selection Test) করল। ফলে প্রান্তিক গ্রামের স্কুলগুলিতে শিক্ষক পাওয়ার সমস্যা আছে। আর কেন্দ্রীয়ভাবে পরিকল্পনা করেই দুর্নীতি করা। 
২০১৬ সালে পরীক্ষা নোটিফিকেশন হয়।  পরীক্ষা ও হয় ২০১৬ সালের ২৭ নভেম্বর ও ৪ ডিসেম্বর  । ২০১৭ সালের মে-জুন মাস নাগাদ ফল বেরোয়। ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বর মাস থেকে নিয়োগ শুরু হয়। আচমকাই দেখা যায় নিয়োগে গোলমাল। 
উত্তর দিনাজপুর জেলার দারিভিটার ঘটনা কথা আপনাদের মনে থাকবে। এর পর নিয়োগ বন্ধ। 
তার পর প্রায় ৬ মাস পর নিয়োগ চালু হয়।

আর দুর্নীতি প্রকাশ্য আসতে থাকে। তৃণমূল নেতা পরেশ অধিকারীর মেয়ে অঙ্কিতা অধিকারী কোনও লিস্টে না থেকেও চাকরি পেল। 
শুরু হয় যোগ্য প্রার্থীদের আন্দোলন।
ধর্মতলায় প্রেস ক্লাবের সামনে ২৯ দিন অনশন আন্দোলন। তার পর মুখ্যমন্ত্রী আসেন। আশ্বাস দেন। যোগ্যদের নিয়োগ হবে। 
পরবর্তী সময়ে মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশে ৫ সদস্যের একটি কমিটি তৈরি হয়েছিল নিয়োগ প্রক্রিয়াতে স্বচ্ছতা আনার জন্য।   মাথায় ছিলেন শান্তিপ্রসাদ সিনহা। তিনি এখন গ্রেপ্তার হয়ে জেলে বন্দি। 
এই ৫ সদস্যের কমিটির মাধ্যমে লিস্টে পিছনে থাকা প্রার্থীরা চাকরি পায়,  ফেল করা লোকজনও চাকরি পায়। যাদের স্বচ্ছতা আনার দায়িত্ব দিয়েছিলেন তাদের নেতৃত্বেই চুরি চলল দেদার। 
আর এই দুর্নীতির বিরুদ্ধে  রাজ্যজুড়ে গণআন্দোলন শুরু হলো চাকরিপ্রার্থীদের। একাধিক মামলা হয় আদালতে। রাস্তায় ও আদালতে  ধারাবাহিক আন্দোলন চলছে। ওয়েটিং লিস্টের চাকরিপ্রার্থীরা ১০০০দিন ধরে ধর্মতলার গান্ধী মূর্তির পাদদেশে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন।  কেবল অবস্থান আন্দোলন নয় মিছিল বিক্ষোভ পুলিশের আক্রমণ গ্রেপ্তার সব হতে হচ্ছে।
৫০০ দিনেরও বেশী রাস্তার আন্দোলন ও আদালতের আন্দোলনের ফলে শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী পরেশ অধিকারীর কন্যা অঙ্কিতা অধিকারী  চাকরি বাতিল হয়েছে অঙ্কিতার। ফেরত দিতে হয়েছে মাইনের টাকা। 
আদালতের নির্দেশ সিবিআই, ইডি তদন্ত করছে। 
প্রাক্তন শিক্ষা মন্ত্রী পার্থ চ্যাটার্জির ঘনিষ্ঠ বান্ধবী অর্পিতার  বাড়ি থেকে কোটি কোটি নগদ টাকা ছাড়াও প্রচুর সম্পত্তি উদ্ধার হচ্ছে।  
টাকা দিয়ে চাকরি পাওয়া শিক্ষকদের সংখ্যা   কয়েক হাজারের ও বেশি। মাথাপিছু ১৫ থেকে ২০ লক্ষ টাকা দিয়েছেন এরা।
ফলে খুব সহজেই অনুমান করা যায়, আসলে ঠিক কত টাকার বেনিয়ম হয়েছে। যা উদ্ধার হয়েছে তা সামান্য। 
প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রী, উপদেষ্টা শান্তিপ্রসাদ সিনহা পর গ্রেপ্তার হয়েছেন মধ্য শিক্ষা পর্ষদের প্রাক্তন চেয়ারম্যান কল্যাণময় গাঙ্গুলি, প্রাক্তন স্কুল সার্ভিস কমিশনের চেয়ারম্যান ও উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য সুবীরেশ ভট্টাচার্য। 
তৃণমূলের যুব নেতা কুন্তল শান্তনু, সহ কালীঘাটের কাকু সুজয় কৃষ্ণ ভদ্র (যিনি রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী ও তার ভাইপো অভিষেক ব্যানার্জির খুব ঘনিষ্ঠ)  এরা সবাই গ্রেপ্তার হয়েছে। 
নবম দশম শ্রেণির ক্ষেত্রে ৯৫২ ও একাদশ দ্বাদশ শ্রেণির ক্ষেত্রে ৯০৭ টি সাদা OMR বা ম্যানুপুলেটেড OMR প্রকাশ্য এসেছে। সাদা OMR এ চাকরি পেয়েছে এটা খোদ স্কুল সার্ভিস কমিশনের ওয়েব সাইটে প্রকাশ হয়েছে। এটা কেবল OMR দুর্নীতি। আরো অনেকভাবে দুর্নীতি হয়েছে। কাস্ট সার্টিফিকেট জালিয়াতি করা হয়েছে। ইচ্ছামত ইন্টারভিউতে নাম্বার দেওয়া হয়েছে। সেগুলোও সামনে আসছে ক্রমশ।

মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী ক্যাবিনেট মিটিং-এ সিন্ধান্ত করেছিলেন যাদের ব্যাতিক্রমী নিয়োগ হয়েছে তাদের জন্য সুপার নিউমারিক পোস্ট তৈরি করে এই অযোগ্যদের চাকরি বাঁচাবে। 
ভাবখানা এমন যে সে বঞ্চিতদের চাকরি দিতে চায় কিন্তু সরকার ভালো করেই জানে আদালত এটা মানবে না। আদালতে সরকার আর কমিশন আলাদা আলাদা বক্তব্য প্রেস করল। 
কমিশন এতো নির্লজ্জ যে বলেই দিল যে অবৈধ নিয়োগ হয়েছে তাই সুপারনিমারিক পোস্ট। আদালতে ধমকানিতে সেই পোস্ট প্রত্যাহার করল কমিশন। অযোগ্যদের বাদ দিয়ে কেবল যোগ্যদের জন্য সুপারনিউমারিক পোস্ট হলে হয়তো একটা কথা ছিল। কিন্তু সরকার তা করবে না। সরকার তো অযোগ্যদের বাদ দিতেই চায় না। অযোগ্যদের বাদ দিয়ে যোগ্যদের নিয়োগ শুরু করলেও এতোদিনে অনেকের চাকরি হয়ে যেত। তারপরও কিছু যোগ্য প্রার্থীর চাকরি হতো না তাদের জন্য সুপার নিউমারিক পোস্ট  তৈরি করে চাকরি দিতে হতো। এটা একটা প্রক্রিয়া হতে পারত।

কিন্তু সরকার তা না করে অযোগ্যদের বাঁচাতে মামলা সুপ্রিম কোর্টে যায়। সুপ্রিম কোর্ট আবার কলকাতা হাইকোর্ট মামলা ফেরত পাঠিয়ে দ্রুত নিস্পত্তি করতে বলেছেন। হাইকোর্ট সিবিআই ও ইডি-কে ৩১ ডিসেম্বর মধ্যে তদন্ত শেষ করতে বলেছেন। 
গত ৬ ডিসেম্বর কলকাতা হাইকোর্টের ডিভিসন বেঞ্চ ওর্ডার দিয়েছেন  যে যারা চাকরি করছেন তাদের সকলের কাছে নোটিস দিতে। এবং জানাতে  তাদের চাকরি যে মামলার রায়ের উপরেই নির্ভরশীল। 
ফলে সকলের টেনশন শুরু হয়েছে।
রাজ্য সরকার এমন প্রচার করছে মামলার জন্য সব ঘাঁটছে।  যে মামলা হলো বলেই নিয়োগ আটকে গেল।  কিন্তু তাদের এই চালাকি সবাই বুঝতে পারছে। 
যোগ্য চাকরিপ্রার্থীরা কোনোভাবেই এটা মানবে না। অযোগ্য আর যোগ্যরা এক আসনে বসতে পারেনা কখনো। মুড়ি মিছরি এক না। অনেক হয়েছে। একটা দুর্নীতি ঢাকতে আরও বড় দুর্নীতি নয়।

দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াই, দ্রুততার সাথে স্বচ্ছতার ভিত্তিতে  নিয়োগের আন্দোলন চলবে। যোগ্যদের বঞ্চিত করা যাবে না। তাদের দ্রুত নিয়োগ দিতে হবে। অযোগ্যদের বার করার পর প্রয়োজন হলে সুপার নিউমারিক পোস্ট করতে হবে। 
সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে এই আন্দোলন চলবে।
আর যারা দুর্নীতি করে চাকরি পেল তাদের চাকরি থেকে বরখাস্ত করতে হবে। বেতন হিসাবে যা টাকা পেয়েছে তা সুদসহ ফেরত দিতে হবে। তার সাথে যথোপযুক্ত শাস্তি দিতে হবে। 
এখানে থামলে হবে না, যে অফিসাররা দুর্নীতি করে চাকরি দিয়েছে তাদের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করতে হবে সাথে জেল। 
আর যে মন্ত্রী নেতাদের কথায় এই আধিকারিকরা এই কাজ করেছেন তাদের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে জেলে  অবশ্যই পাঠাতেই হবে।
এই দুর্নীতির প্রভাব কেবল ধরনা মঞ্চে যারা আছে কেবল তাদের পড়েছে এমন নয়। 
দুর্নীতির কারণে হাইকোর্টে একাধিক মামলা চলছে। আর মামলার ফলে একাধিক নিয়োগ প্রক্রিয়াতে স্টে পড়েছে। ফলে নিয়োগ প্রক্রিয়া থমকে আছে। তার প্রভাব সরাসরি পড়েছে রাজ্যের স্কুলগুলিতে। 
রাজ্যের অনেক  স্কুলে শিক্ষক নেই বিশেষত গ্রামীণ স্কুলগুলিতে। হাইস্কুল গুলিতে এমনও ঘটনা ঘটছে ইতিহাসের শিক্ষক মহাশয় বাংলা পড়াছেন, অঙ্কের মাস্টারমশাই ভূগোল পড়াচ্ছেন। ছাত্র শিক্ষক অনুপাত কোথাও মানা হচ্ছে না। প্রান্তিক এলাকার স্কুলগুলিতে পড়াশুনার পরিবেশ থাকছে না। স্কুল ছুট বাড়ছে প্রতিদিন। ফলস্বরূপ ২০২১ সালের থেকে ২০২২ সালে মাধ্যমিক পরীক্ষার্থীর সংখ্যা প্রায় ৪ লক্ষ কমেছে। 
দ্বিতীয় বড় ক্ষতির জায়গা তৈরি হয়েছে যোগ্যতা না থাকার পর টাকা দিয়ে চাকরি পাওয়ার যে প্রবণতা প্রকাশ পেয়েছে তার ফলে যারা যোগ্য মেধাবী অথচ টাকা দেওয়ার ক্ষমতা নেই তারা হতাশ হয়ে  নিজেদেরকে গুটিয়ে নিচ্ছে। যোগ্যতাসম্পন্ন মেধাবী চাকরিপ্রার্থীরা শিক্ষকতার পেশায় আসছে না। 
আর একটা প্রবণতা আসছে চাকরি পেতে গেলে যদি টাকা দিতে হয় তবে আর পড়াশোনা করে নিজের যোগ্যতা বাড়াবো কেন??
ফলে সামগ্রিকভাবে যোগ্যতা ও গুণমানের মারাত্মক অবনতি হচ্ছে।

স্কুলগুলিতে পড়াশোনা হচ্ছে না তার ফলে পড়াশোনার জন্য প্রাইভেট টিউটর-এর উপর নির্ভরশীল হচ্ছে। যাদের প্রাইভেট টিউটর রাখার ক্ষমতা নেই তারা  শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। 
টাকা যার শিক্ষা তার এই নীতি সুচতুরভাবে কার্যকর হচ্ছে। 
যোগ্যতা সম্পন্ন চাকরিপ্রার্থীরা দিনের পর দিন চাকরি না পেয়ে মানসিক সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে সংসারা জীবনে তার মারাত্মক প্রভাব পড়ছে। 
রেগুলার পরীক্ষা না হওয়ার কারণে বিএড বা ডিএলএড কলেজে ভর্তির সংখ্যাও কমছে। সরকারি বিএড বা ডিএলএড কলেজগুলিতে ছাত্র ভর্তি কমছে। যাদের টাকা আছে তারা দুর্নীতির মাধ্যমে বিএড ও ডিএল এড সার্টিফিকেট কিনছে। একটা ব্যাপক দুর্নীতি চক্র তৈরি হয়েছে। 
এই দুর্নীতির ফলে আমাদের রাজ্যের আগামী প্রজন্ম, আমাদের রাজ্যের ভবিষ্যৎ আজ অন্ধকার। তাই শিক্ষক নিয়োগের দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াই কেবল চাকরি প্রার্থীদের নয় আমাদের সকলের। সকলের জন্য শিক্ষা এবং শিক্ষান্তে কাজ এই দাবিতে আন্দোলন আরও জোরালো করতে হবে। 
এই কাজ না হওয়া পর্যন্ত আমাদের লড়াই চলবে।
এই লড়াইতে আমাদের জিততে হবে।রাজ্যের জন্য। ভবিষৎ প্রজন্মের জন্য।

Comments :0

Login to leave a comment