গৌতম রায়:
ধর্মান্ধ, সাম্প্রদায়িক, মৌলবাদী হিন্দু শিবিরকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে সঙ্ঘবদ্ধ করার তাগিদেই ১৯২৫ সালে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের জন্ম। সঙ্ঘের প্রধান হিসেবে হেডগেওয়ার আরএসএসের তাত্ত্বিক ভিত্তির মূলেই ‘অখন্ড ভারত’-কে জায়গা দিয়েছেন। মুসলিমকে বিচ্ছিন্ন করে, হিন্দু প্রধান অঞ্চলগুলিকে নিয়ে ‘হিন্দু ভারত' প্রতিষ্ঠার কথা বলেছেন। ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের গোটা সময়কালটাতে আরএসএস, একদিকে ব্রিটিশ সম্রাজ্যবাদের সহায়ক শক্তি, অপরদিকে হিন্দু- মুসলমানে বিভাজনের শক্তি।
ইতালিতে মুসোলিনীর প্রত্যক্ষ আতিথ্য গ্রহণ করে, তাদের সন্ত্রাসবাদী সংগঠন ' বালিল্লা' র আদলে নিজেদের সংগঠনকে হেডগেওয়ার, বিএস মুঞ্জেরা গড়ে তুললেও সংগঠনটির সময়োপযোগী যে আদর্শগত তাত্ত্বিক ভিত্তি, তা তৈরি হয়েছিল গোলওয়ালকর সরসঙ্ঘচালক থাকাকালীন। তাত্ত্বিক ভিত্তির এই নবনির্মাণে গোলওয়ালকর যে ' সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদে' র কথা বলেন, তার একমাত্র বিষয় হল, মুসলমান মুক্ত ভারত।
জাতীয় আন্দোলনের চূড়ান্ত পর্যায়ে হিন্দু ও মুসলিম উভয় সাম্প্রদায়িক, মৌলবাদী শক্তি যখন দেশভাগের পক্ষে, দেশভাগকে এড়ানোর শেষ চেষ্টায় ক্যাবিনেট মিশনের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে জওহরলাল নেহরুর '৪৬ সালের ১০ ই জুলাইয়ের বিবৃতি, যাকে মৌলানা আজাদ এভাবেই বর্ণনা করেছিলেন, ' আমাকে একথা লিখতেই হবে যে, জওহরলালের বক্তব্য ভ্রান্ত ছিল' ( ইন্ডিয়া উইনস ফ্রিডম)। এরপর '৪৬ এর যে ভয়াবহ দাঙ্গা, যা উভয় মৌলবাদী শক্তির ঈপ্সিত দেশভাগকে অবশ্যম্ভাবী করে তোলে। মুসলিম জাতীয়তার ভিত্তিতে তৈরি পাকিস্তানের পাল্টা হিশেবে হিন্দু জাতীয়তাকে ভিত্তি করে রাজনৈতিক হিন্দু ভারত প্রতিষ্ঠা আরএসএসের লক্ষ্য হয়ে দাঁড়ায়।
আরএসএস’র এই রাজনৈতিক হিন্দু রাষ্ট্র তৈরিই এখন কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন , সঙ্ঘের রাজনৈতিক সংগঠন বিজেপির একমাত্র লক্ষ্য।
আর যেসব রাজ্য গুলিতে সরাসরি ক্ষমতায় নেই বিজেপি, যেমন; পশ্চিমবঙ্গ, ওডিশায় সেখানকার শাসক দলকে কখনো নরম, কখন ও গরম ভাবে, সঙ্ঘ পরিবারের মাধ্যমে, প্রশাসনের একটা বড় অংশকে নিজেদের বৃত্তের ভিতরে নিয়ে আসতে সক্ষম হয়েছে। প্রশাসনের ভিতরে একদম আড়াআড়ি ভাবে বিভাজন তৈরি করে আমলা থেকে করণিক-- এঁদের ভিতরে একটা বড় অংশ কে মুসলমান বিদ্বেষী করে তোলবার জন্যে সঙ্ঘ পরিবারের বিভিন্ন শাখা সংগঠনের ভিতর দিয়ে নিরন্তর প্রয়াস চালিয়েছে আরএসএস। সঙ্ঘের সেই প্রয়াসের সাফল্যের ছবিই কিন্তু আমরা পশ্চিমবঙ্গে বিগত কয়েকবছর ধরে রামনবমীকে কেন্দ্র করে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনার ভিতরে আংশিক ভাবে দেখতে পাচ্ছি।
একই কথা প্রযোয্য কিন্তু ওড়িশার ক্ষেত্রেও। সে রাজ্যেও ক্ষমতাসীন বিজেডি, যারা এককালে মমতারই মতো বাজপেয়ী সরকারের শরিক ছিল, তাদের দলীয় অস্তিত্বকে বিপন্ন করে দিতে বাজপেয়ীর শাসনকালে যে দ্রোহী মানসিকতা বিজেডির ভিতরে তৈরি হয়েছিল, সেটা ওই দলের ভিতরে এখন আর নেই। দুই দফাতে ইউপিএ যখন কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন ছিল, তখন কংগ্রেসের সঙ্গে কোনো সংঘাতে না গিয়েও ওড়িশার আদিবাসী অধ্যুষিত এলাকাগুলিতে সঙ্ঘ পরিবারের বিভিন্ন শাখা সংগঠনগুলিকে কিন্তু অবাধে কাজ করতে দিয়েছিল বিজেডি। নরেন্দ্র মোদী কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন হওয়ার পর ওড়িশাতে সঙ্ঘের আগ্রাসনের স্টাইলটা কিন্তু বাজপেয়ী জামানার মত প্রকাশ্য উগ্র নয়। তা বলে সঙ্ঘ গ্রামীণ ওড়িশাতে নিজেদের বিভাজনের রাজনীতিকে কমজোরি করে ফেলেছে ভাবলে ভুল হবে। আগের থেকে হাজার গুণ বিভাজনের আঙ্গিককে ক্ষিপ্র করে তুলেও কৌশলগত কারনেই সেই আঙ্গিকের প্রকাশ্য অবস্থান ঘিরে আর এস এস এখন অনেক বেশি সতর্ক। ফলে নবীন পট্টনায়কের সঙ্গে বাজপেয়ী জামানার শেষ দিকে যে সংঘাতের পরিবেশ তৈরি হয়েছিল, তেমন পরিবেশ কিন্তু এখন আর নেই। সেই কারনেই নবীনের মন্ত্রীসভার একদা মন্ত্রী দ্রৌপদী মুর্মুকে রাষ্ট্রপতি করে নিজেদের ব্রাহ্মণ্যবাদী তকমা মুছতে চায় আরএসএস-বিজেপি। এই পরিকল্পনার সঙ্গী থেকেছে বিজেডি।
সঙ্ঘ ঘরানার ,' সোশাল ইঞ্জিনিয়ারিং' হলো কেবলমাত্র একক গরিষ্ঠতায় বিজেপিকে ক্ষমতাসীন করা নয়। সেই ক্ষমতাকে হিটলারের পদ্ধতিতে চিরস্থায়ী করাটাই হল আর এস এসের মূল টার্গেট।
ধীরে অথচ নিজেদের যাবতীয় রাজনৈতিক কর্মসূচিকে ' সামাজিক' কর্মসূচির একটা তথাকথিত আবরণের ভিতর দিয়ে আরএসএস পর্দার আড়াল থেকে মোদি সরকার কে পরিচালিত করছে। অতীতে বাজপেয়ী সরকার যেভাবে বাজার অর্থনীতির পথে চলেছিল, লোকদেখানো ভাবে আরএসএসের শাখা সংগঠন ,' স্বদেশি জাগরণ মঞ্চে' র মত কিছু সংগঠন তার বিরোধিতা করে গেছে। এই বিরোধিতার বিষয়টি ছিল বাজপেয়ী সরকারের সঙ্গে সঙ্ঘের একটা বোঝাপড়া। সঙ্ঘে তখন ও অতীতের ধ্যানধারণা নিয়ে গোঁড়া মানসিকতা সম্পন্ন যে সব নেতা- কর্মী ছিল, সেই সাধারণ স্তরের কর্মীদের বশে রাখতে একদিকে এই ' স্বদেশি জাগরণ মঞ্চ' কে আর এস এস ব্যবহার করেছিল, অপর দিকে , বাজপেয়ী সরকারের আমেরিকা ভজনাকেও কোনো ভাবে সঙ্ঘ বাধা দেয়নি। বাজার অর্থনীতির পথেই প্রায় সাড়ে ছয় বছরের শাসনকালে বাজপেয়ী সরকার হেঁটেছে আর দত্তপন্থ ঠেঙরের মতো কিছু প্রবীণ সঙ্ঘ নেতাকে সামনে রেখে তথাকথিত স্বদেশিয়ানার বুকনি তখন সঙ্ঘ দিয়ে গেছে।
এনডিএ নামক নীতিবিহীন, সুবিধাবাদী জোটের মাধ্যমে ক্ষমতায় টিকে থাকতে এই ধরণের যেসব কৌশল তখন সঙ্ঘ নিয়েছিল, মোদির একক গরিষ্ঠতার কারণে তাই এখন আর সেইসব কৌশলের পথে হাঁটছে না সঙ্ঘ। গত প্রায় দশ বছরে সঙ্ঘের অতীতে সক্রিয়,' স্বদেশি জাগরণ মঞ্চ' কে তাই আমরা সেভাবে প্রকাশ্যে সক্রিয় থাকতে দেখছি না। স্বদেশি ঘিরে সঙ্ঘের ওই শাখা সংগঠনটির একটি বিবৃতিও আমরা গত প্রায় দশ বছরে , দুই দফায় মোদী সরকারের শাসনকালে দেখি নি। এই না দেখার কারণ হল, অতীতে তথাকথিত জোটের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করে , সেই জোট সরকারকে টিকিয়ে রাখতে যে বাধ্যবাধকতা সঙ্ঘের রাজনৈতিক সংগঠন বিজেপির ছিল, বর্তমানে বিজেপির একক গরিষ্ঠতার দ্বারা পরিচালিত সরকারের ক্ষেত্রে সেই বাধ্যবাধকতা আর সঙ্ঘের বা বিজেপির নেই। বাজপেয়ী জামানাতে জোট সঙ্গীদের আঞ্চলিক স্বার্থগুলি যাতে অক্ষুন্ন থাকে সেদিকে সঙ্ঘ কে নজর দিতে হয়েছিল। ফলে বাজপেয়ী সরকার মেধার দুনিয়াতে সাম্প্রদায়িক বিভাজনে এন সি ই আর টি র পাঠ্যক্রম থেকে জাতীয় আন্দোলনের ইতিহাসের গ্রন্থ ' টুওয়ার্ডস ফ্রিডমে' যতই সঙ্ঘ মানসিকতা র বিষয়গুলিকে ' ইতিহাস' বলে চালাবার চেষ্টা করুক না কেন (এগুলি আরও বেশি করে হিন্দুত্ববাদীদের পক্ষে সম্ভব হয়েছিল এই কারণে যে, ক্ষমতা ছাড়া আর অন্য কোনো বিষয়, বিশেষ করে মেধার দুনিয়া ঘিরে এনডিএ’র শরিক তৃণমূল, জয়ললিতার এআইএডিএমকে, অসম গণ পরিষদ ইত্যাদির মত আঞ্চলিক দলগুলির এতটুকু আগ্রহ ছিল না)।
বাবরি মসজিদের ধ্বংসস্তুপের উপর তথাকথিত রামমন্দির নির্মাণ, সংবিধানের ৩৭০ নং ধারা বাতিলের পর ,রাজনৈতিক হিন্দুরাষ্ট্রে ধর্মনিরপেক্ষ ভারত কে রূপান্তরিত করবার লক্ষ্যে আর এস এসের সম্ভাব্য পরবর্তী কর্মসূচি অভিন্ন দেওয়ানী বিধি বিষয়ক আইনের পথে হাঁটা। শোনা যাচ্ছে , সংসদের আগামী অধিবেশনে এই পথে নাকি বিজেপিকে হাঁটবার বিষয়ে ইতিমধ্যেই ছাড়পত্র দিয়েছে আরএসএস। তবে কর্ণাটকে ভরাডুবির পর , এ দিকে ঠিক এই মুহূর্তেই কতটা উগ্র অবস্থান আরএসএস নেবে, তা তাদের দু-চারদিনের অবস্থান দেখে একটা পরিষ্কার ধারণা করতে পারা যাবে।
Comments :0