Post Editorial RSS

ফ্যাসিবাদ এবং আরএসএস’র দর্শন এক সূত্রে বাঁধা

উত্তর সম্পাদকীয়​

অচিন্ত্য মল্লিক

দুনিয়াজুড়ে দক্ষিণপন্থার বিপদ 
বিশ্ব পুঁজিবাদ গভীর সঙ্কটে জর্জরিত ৷ ২০০৮ সাল থেকে পুঁজিবাদের সৃষ্ট সঙ্কট থেকে তাদের মুক্তি পাওয়ার বিন্দুমাত্র লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না, শুধু তাই নয় বরং বৃদ্ধির প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে ৷ অতি সম্প্রতি আমেরিকার কয়েকটি ব্যাঙ্কে তালা ঝোলাতে হয়েছে, অথবা তাদেরই প্রতিদ্বন্দ্বী সংস্থার কাছে বিক্রি করতে হয়েছে ৷ এই ঘনীভূত সঙ্কটের ফলে পুঁজিবাদ বা ধনতন্ত্র নিজেকে রক্ষা করতে আরো আগ্রাসী হয়ে উঠেছে ৷ উৎপাদনে পুঁজি বিনিয়োগ নয়, আজকের পুঁজিবাদ ধান্দার পুঁজিবাদের চেহারা নিয়েছে, যাকে সহজ কথায় বলা যায় লুটেরা পুঁজিবাদ ৷ দুনিয়াজুড়ে ধান্দার ধনতন্ত্রের অবাধ লুট চলছে ৷ আর এই অবাধ লুটের পথকে মসৃণ করতে সমস্ত ক্ষেত্রেই দক্ষিণপন্থার উত্থান মাথাচাড়া দিচ্ছে ৷ নয়া ফ্যাসিবাদী শক্তির আবির্ভাব ঘটছে ৷
বর্তমান সময়ে অনেক দেশে, বিশেষ করে ইতালিতে নয়া ফ্যাসিবাদের ভয়ঙ্কর আক্রমণ আমরা প্রত্যক্ষ করছি ৷ কিন্তু এর বিপরীতে মানুষের লড়াই-এর শক্তির সমাবেশও সংগঠিত হচ্ছে ৷ এই সময়কালের মধ্যে ইউরোপের বিভিন্ন দেশের শ্রমজীবী মানুষের লড়াই-সংগ্রাম উল্লেখযোগ্য ৷ অতি সম্প্রতি জার্মানিতে রেল শ্রমিকদের ধর্মঘট দেশকে স্তব্ধ করে দেবার ঘটনা সারা দুনিয়ার মানুষের নজর কেড়েছে ৷ লাটিন আমেরিকা শুধু নয়, ইউরোপের বিভিন্ন দেশে বামপন্থী, মধ্যবামপন্থী, সোশাল ডেমোক্রাট এবং কমিউনিস্ট পার্টিগুলির নির্বাচনী সংগ্রামে জনসমর্থন বৃদ্ধি পেয়েছে এতদসত্ত্বেও, একথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, দুনিয়াজুড়ে দক্ষিণপন্থার উত্থানকে মোকাবিলা করাই আজকের সময়ে সমাজের অগ্রগতির পথে প্রধান চ্যালেঞ্জ ৷

আমাদের দেশ বড় বিপদের মুখোমুখি 
২০১৯ সালে দ্বিতীয়বারের জন্যে মোদী ক্ষমতায় প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পরে আরএসএস নিয়ন্ত্রিত বিজেপি সরকারের ফ্যাসিবাদী প্রবণতা তীব্র গতিতে বৃদ্ধি পেয়েছে ৷ অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে আক্রমণ তীব্রতর হচ্ছে এবং তা ক্রমবর্ধমান ৷ নয়া উদারবাদী আর্থিক সংস্কার উত্তেজক গতি পেয়েছে ৷ প্রথাগত বেসরকারিকরণ আর কর্পোরেটদের কর মকুবের বাইরে গিয়ে বহুমাত্রিক ধারায় ভারতবর্ষের আর্থিক সার্বভৌমত্ব ধবংস করা হচ্ছে ৷ ভারতবর্ষের স্বনির্ভরতার মুখ্যভিত্তি রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা বিশেষ করে সামরিক ক্ষেত্রের উৎপাদন লঘু করার ফলে দেশকে ভয়ঙ্কর দিকে নিয়ে যাচ্ছে, যা দেশের অর্থনীতিকে আগামী দিনে পরনির্ভরতায় নামিয়ে আনবে ৷
আর্থিক মন্দা, কৃষিক্ষেত্রে যন্ত্রণা, মানুষের ওপর বোঝা বৃদ্ধি, জাতীয় সম্পদ লুণ্ঠন, দারিদ্র বৃদ্ধি, ক্রমবর্ধমান বেকারি, ক্ষুধার্ত মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধি, ভয়ঙ্কর মূল্যবৃদ্ধি সবদিক থেকেই দেশকে খাদের কিনারায় নিয়ে এসে দাঁড় করিয়েছে ৷ ক্ষুধা সূচক সংক্রান্ত সাম্প্রতিক সমীক্ষায় পৃথিবীর ১২৫ টি দেশের মধ্যে আমাদের দেশের স্থান ১১১ নম্বরে ৷ এ থেকেই দেশের অর্থনৈতিক চেহারা স্পষ্ট ৷
এই পেক্ষাপটেই একদিকে শুধু গণতান্ত্রিক আন্দোলনই নয়, যে কোনও স্বাধীন মতামত এবং মুক্তচিন্তাকে হিংস্রভাবে দমন করা হচ্ছে, অন্যদিকে দেশজুড়ে সাম্প্রদায়িক হিংসা, বিদ্বেষ, দাঙ্গার ঘটনা ঘটে চলেছে ৷ সংখ্যালঘুরা বিপজ্জনকভাবে আক্রান্ত ৷ আমাদের রাজ্যেও এই সময়কালে সাম্প্রদায়িক হিংসার ঘটনা ঘটেছে ৷ রাজ্যের শাসকদলও এ ধরনের ঘটনায় প্রত্যক্ষভাবে মদত জোগাচ্ছে, কারণ আসলে এ-রাজ্যের শাসকদল তৃণমূল কংগ্রেসেরও জন্মস্থান হলো নাগপুর।  দেশজুড়ে বাড়ছে বিভাজনের রাজনীতি ৷ লোকসভা নির্বাচনী বৈতরণী পার হওয়ার লক্ষ্যে রামমন্দির উদ্বোধনের দিন ঘোষণা করা হয়েছে ৷ সাম্প্রতিক পাঁচ রাজ্যের নির্বাচনের সাম্প্রদায়িকতাই প্রধান অবলম্বন বিজেপি’র ৷ শেষ পর্যন্ত উগ্র জাতীয়তাবাদ তৈরির লক্ষ্যে তাদেরই সৃষ্ট পুলওয়ামার-এর মতো ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটতেও পারে ৷ রাষ্ট্রের সমস্ত ক্ষেত্রে সাম্প্রদায়িক শক্তির অনুপ্রবেশ ঘটছে ৷ দেশের সংবিধানের মূল চারটি স্তম্ভ আজ আক্রান্ত ৷ ধর্মনিরপেক্ষ, গণতন্ত্র, যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা, সামাজিক ন্যায় এবং অর্থনৈতিক সার্বভৌমত্ব সব ক্ষেত্রেই হামলা তীব্র হচ্ছে ৷ সংসদ, বিচারব্যবস্থা, নির্বাচন কমিশন, শিক্ষা, সংবাদ মাধ্যম, কেন্দ্রীয় সংস্থা সহ সমস্ত স্বাধীন প্রতিষ্ঠানগুলির ওপর চলছে দখলদারি ৷ এসব ঘটনাবলি প্রমাণ করে দেশের শাসন ক্ষমতায় প্রতিষ্ঠিত শক্তির দ্রুত গতিতে বাড়ছে ফ্যাসিবাদী প্রবণতা ৷ অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে ক্রমবর্ধমান সঙ্কটের অনিবার্যতাই দেশের কর্পোরেট-হিন্দুত্ব মিশেলে তৈরি সরকারকে ক্রমশ ফ্যাসিবাদের দিকে ঠেলে দিচ্ছে ৷

আরএসএস প্রতিষ্ঠা ও তার মূল দৃষ্টিভঙ্গি
আরএসএস প্রতিষ্ঠা হয় ১৯২৫ সালে বিজয়া দশমীর দিন নাগপুরে ৷ এর দু'বছর আগে ভিডি সাভারকার ১৯২৩ সালে একটি মতাদর্শগত পুস্তিকা প্রকাশ করেন ৷ পুস্তিকাটির শিরোনাম ছিল ‘হিন্দুত্বের সারকথা’৷ পরে পুস্তিকাটির দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশের সময় নামকরণ করা হয় ‘হিন্দুত্ব : হিন্দু কে?’ এই পুস্তিকার মূল কথা ছিল, ধর্মবিশ্বাস যাই হোক না কেন, সেইসব মানুষ যারা মনে করে ভারত তাদের মাতৃভূমি, পিতৃভূমি এবং পুণ্যভূমি তারাই হিন্দুত্বের এক্তিয়ারভুক্ত ৷ ভারতে বসবাস করে, অথচ যাদের পুণ্যভূমি আলাদা যেমন মুসলিম (পুণ্যভূমি: মক্কা ও মদিনা) এবং খ্রিস্টান (পুণ্যভূমি: বর্তমানে যুদ্ধ বিধ্বস্ত প্যালেস্তাইনের জেরুজালেম) তারা হিন্দুত্বের এক্তিয়ার বহির্ভূত৷
সাভারকার জোর দিয়ে বলেছিলেন, ‘হিন্দুত্ব একটা রাজনৈতিক প্রকল্প এবং এর সাথে হিন্দু ধর্মের কোনও সম্পর্ক নেই ৷’ হিন্দুত্বের প্রতিষ্ঠাকল্পে তাঁর স্লোগান ছিল, ‘সামরিক বাহিনীর হিন্দুকরণ করো, হিন্দুত্বরাজের সামরিকীকরণ করো ৷’ বর্তমান সময়ে হিন্দুত্ব প্রচারের লক্ষ্যে যা চলছে এই স্লোগানই সেসবের প্রেরণার উৎস ৷
আরএসএস প্রতিষ্ঠার একটা প্রেক্ষাপট আছে ৷ প্রথম বিশ্বযুদ্ধ, নভেম্বর বিপ্লবের সাফল্য, ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি গঠন, শ্রমিক-কৃষক আন্দোলনের বিস্তার --- এই রকম একটা সময়ে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদকে সহযোগিতা করতে, ভারতে হিন্দু ও মুসলমানদের ধর্মের ভিত্তিতে ভেদাভেদ করার উদ্দেশ্যে আরএসএস প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ৷ ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ আরএসএস-এর প্রধান শত্রু কখনোই ছিল না ৷ আরএসএস-এর প্রধান শত্রু মুসলমান, খ্রিস্টান এবং কমিউনিস্টরা ৷ এমএস গোলওয়ালকর তাঁর ‘বাঞ্চ অফ্ থট্স্’ বইতে ‘হিন্দু নেশন অ্যান্ড ইটস এনিমিস্' অধ্যায়ে মুসলিম, খ্রিস্টান ও কমিউনিস্টদের অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে প্রধান শত্রু হিসেবে চিহ্ণিত করেছিলেন ৷ বর্তমান সময়ে, অতি সম্প্রতি আরএসএস প্রধান এবং স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী কমিউনিস্টদের প্রধান শত্রু হিসেবে ঘোষণা করে চলেছেন বার বার ৷
আরএসএস-এর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা বিএস মুঞ্জে ১৯৩১ সালে মার্চ মাসে ইতালি গিয়ে মুসোলিনির সাথে সাক্ষাৎ করেন। এবং তাঁদের মধ্যে দীর্ঘ আলোচনা হয় ৷ ইতালির ফ্যাসিস্ত বাহিনী ‘ব্ল্যাক শার্টস বাহিনী'র কাজ এবং সামরিক বাহিনীর প্রশিক্ষণ পর্বও দেখেন ৷ এরপরে মুঞ্জে ঘোষণা করেন, ভারতে বিশেষ করে হিন্দু ভারতে এরকম সংগঠন প্রয়োজন ৷ হিন্দুদের সামরিক নবজাগরণের জন্য এমনটাই দরকার ৷
মতাদর্শগতভাবে আরএসএস হলো মুসোলিনি ও হিটলারের অনুগামী সংগঠন ৷ এমনকি ব্রিটিশ সরকারের নথিতেও আছে যে, ইতালি ও জার্মানির ফ্যাসিস্ত নাৎসিদের মতো ভবিষ্যতে আরএসএস-ও একই ভূমিকা নেবে ৷

আরএসএস ও বিজেপি সম্পর্কে পার্টি কর্মসূচি 
পার্টি কর্মসূচির ৭.১৪ নং ধারায় উল্লেখ করা হয়েছে: ‘‘বিজেপি কোনও সাধারণ বুর্জোয়া দল নয়, কেননা ফ্যাসিস্ত ধাঁচের রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সঙ্ঘ তাদের পরিচালনা করে, আধিপত্য করে ৷ বিজেপি ক্ষমতায় আসায় রাষ্ট্রযন্ত্রের বিভিন্ন সংস্থায় প্রবেশের সুযোগ পাচ্ছে আরএসএস ৷ হিন্দুত্ব মতাদর্শ পুনরুত্থানবাদকে মদত দেয়, হিন্দু রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ভারতের মিশ্র সংস্কৃতিকে প্রত্যাখ্যান করে ৷’’
আমাদের কাজ:
পার্টি কর্মসূচির উপরোক্ত মূল্যায়নের প্রেক্ষাপটে এবং ২৩তম পার্টি কংগ্রেসের গৃহীত সিদ্ধান্ত আমাদের করণীয় কাজকে নির্দিষ্ট করে দেয় ৷
হিন্দুত্ব এবং হিন্দু ধর্ম যে এক নয় তা মানুষের কাছে নিয়ে যেতে হবে ৷ হিন্দুত্ব ওদের একটা রাজনৈতিক কর্মসূচি, তা মানুষের বোধের মধ্যে আনতে হবে ৷ হিন্দুত্ববাদীদের বিরুদ্ধে মতাদর্শগতভাবে, রাজনৈতিকভাবে ও সাংগঠনিকভাবে লড়াইকে তীব্র করতে হবে ৷ পার্টি কংগ্রেস যে চারটি কাজের প্রতি গুরুত্ব আরোপ করেছে, সেকাজে যত্নশীলভাবে প্রয়াসী হতে হবে: ১) পার্টির স্বাধীন শক্তির বিকাশ, ২) বামশক্তির ঐক্য ও শক্তিবৃদ্ধি, ৩) বাম ও গণতান্ত্রিক শক্তির ঐক্য প্রসারিত করা, ৪) সমস্ত ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক চেতনাসম্পন্ন ব্যক্তি ও গোষ্ঠীকে নিয়ে বৃহত্তর মঞ্চ গড়ে তোলা ৷ শ্রেণিআন্দোলন ও গণআন্দোলনের সাথে সাথে মতাদর্শগত, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে লড়াইকে জারি রাখতে হবে। 
বর্তমান সময়ের লড়াই গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা এবং দেশের সংবিধান রক্ষার লড়াই৷ দেশ ও দেশের মানুষকে রক্ষার লড়াই। পরিস্থিতির মধ্যে জটিলতা থাকলেও আমাদের সামনে এগনোর নতুন সম্ভাবনাও তৈরি হয়েছে ৷ সেই সম্ভাবনাকে বাস্তবায়নের লক্ষ্যে আমাদের পথ চলতে হবে। ফ্যাসিবাদের উত্থানের সমস্ত অপচেষ্টাকে পরাস্ত করে জিততেই হবে ৷ আমরা জিতবই এই প্রত্যয়ই সোচ্চারে ঘোষিত হোক ৷

Comments :0

Login to leave a comment