Supreme Court

নির্বাচন কমিশনার নিয়োগের ফাইল তলব সুপ্রিম কোর্টের

জাতীয়

Supreme Court

নির্বাচন কমিশনের তথাকথিত স্বাধীনতা মুখেই, কার্যত তা পুরো ধ্বংস হয়ে গিয়েছে। নির্বাচন কমিশনের স্বাধীন ভূমিকার অবনতি নিয়ে বুধবার এই বিস্ফোরক মন্তব্য করেছে সুপ্রিম কোর্ট। একইসঙ্গে শীর্ষ আদালত প্রশ্ন তুলেছে, অবাধ ও স্বচ্ছ নির্বাচন যেহেতু গণতন্ত্রের অংশ, তাহলে কোর্ট কি নীরব থাকতে পারে? 

 

নির্বাচন কমিশনের স্বাধীন ও নিরপেক্ষ ভুমিকা নিয়ে এদিন এক জনস্বার্থের মামলায় এই মন্তব্য করেছে সুপ্রিম কোর্টের পাঁচ বিচারপতির সাংবিধানিক বেঞ্চ। বিচারপতিরা দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলেছেন, নির্বাচন কমিশনের স্বাধীন ভূমিকা বিপন্ন হয়েছে সরকারের অযাচিত হস্তক্ষেপে। নির্বাচন কমিশনার নিয়োগেও রয়েছে অনিয়ম। সম্প্রতি স্বেচ্ছা অবসর গ্রহণের পরই সরকারি ‌আধিকারিক অরুণ গোয়েলকে নির্বাচন কমিশনারের পদে নিয়োগ করেছে কেন্দ্রের বিজেপি সরকার।

 

 

 এদিন তাঁর এই নিয়োগ নিয়েও প্রশ্ন তুলেছে শীর্ষ আদালত। তাঁর নিয়োগ সংক্রান্ত ফাইল চেয়ে পাঠিয়েছে সাংবিধানিক বেঞ্চ। বিচারপতি কে এম যোসেফের নেতৃত্বাধীন পাঁচ সদস্যের সাংবিধানিক বেঞ্চে এই মামলার শুনানি চলছে। বেঞ্চের অন্য বিচারপতিরা হলেন অজয় রাস্তোগি, অনিরুদ্ধ বোস, হৃষিকেশ রায় এবং সি টি রবিকুমার।
জনস্বার্থ মামলায় আবেদনকারীর তরফে নির্বাচন কমিশনের স্বাধীন ভুমিকার অবনতি নিয়ে যে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে, তাতে কার্যত সম্মতি জানিয়েছেন বিচারপতিরা। 

 

 

 

নির্বাচন কমিশনের স্বাধীন ভুমিকার অধোগতির জন্য নিয়োগ প্রক্রিয়ায় সরকারের হস্তক্ষেপকে দায়ী করে তাঁরা বলেছেন, ‘‘কেন্দ্রের একের এক সরকার এসেছে। কিন্তু তারা কেউ নির্বাচন কমিশনের স্বাধীন সত্তার কথা ভাবেনি। বরং কমিশনের স্বাধীন সত্তা তারা ধ্বংস করে দিয়েছে। বিচারপতিরা এই প্রসঙ্গে মুখ্য নির্বাচন কমিশনারের নিয়োগ ও তাঁর কাজের মেয়াদের ক্ষেত্রে গলদের কথা তুলে ধরেছেন। তাঁরা ব‍‌লেছেন, ১৯৯৬ সাল থেকেই কোনও মুখ্য নির্বাচন কমিশনার ছয় বছরের পুর্ণ মেয়াদে পদে থাকতে পারেননি। নির্বাচন কমিশনার নিয়োগে সুনির্দিষ্ট ‌আইন না থাকার কারণে নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ নিয়েই একটি বিপজ্জনক প্রবণতা তৈরি হয়েছে। সংবিধানে নির্বাচন কমিশনার নিয়োগের পদ্ধতি নিয়ে স্পষ্ট কিছু বলা না থাকায় ক্ষমতায় থাকা সব রঙের রাজনৈতিক দলগুলি তার সুযোগ নিয়েছে, ক্ষমতার অপব্যবহার করে নিজেদের স্বার্থে নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ করে আসছে। 

 

নির্বাচন কমিশনার নিয়োগে সংবিধানের নীরবতাকে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল তাদের স্বার্থে ব্যবহার করে চলেছে।
নির্বাচন কমিশনার নিয়োগে এই সমস্যা শুরু হয়েছে টি এন শেষনের পরবর্তী সময় থেকেই। শেষণের পর আর কোনও নির্বাচন কমিশনার পুরো ছয় বছরের মেয়াদে দায়িত্বে থাকেননি। ইউপিএ সরকার হোক বা বর্তমান সরকার, সবার দিক থেকেই মুখ্য নির্বাচন কমিশনার নিয়োগে একই রকমের প্রবণতা দেখা গিয়েছে। এ এক বিপজ্জনক প্রবণতা। বিচারপতি কেএম যোসেফ একথা উল্লেখ করেই বলেন, এইভাবেই নির্বাচন কমিশনের তথাকথিত স্বাধীনতা এখন একটা মুখের কথায় পরিণত হয়েছে। 

 

নির্বাচন কমিশনের স্বাধীনতা পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে গিয়েছে।
এদিকে নির্বাচন কমিশনার নিয়োগে ব্যবস্থা বদলের কথা ওঠায় কেন্দ্রের পক্ষে অ্যাটর্নি জেনারেল আর ভেঙ্কটরামানি তাতে তীব্র আপত্তি জানান। তিনি বলেন, সংবিধানে কোথাও বলা হয়নি নির্বাচন কমিশনার নিয়োগের জন্য সংসদে আইন প্রণয়ন করতে হবে। এতে বিচারবিভাগের হস্তক্ষেপের প্রয়োজন পড়ে না। প্রসঙ্গত, বর্তমানে সরকারি আমলাদের থেকে প্রধানমন্ত্রী নাম পছন্দ করে তাঁকে নির্বাচন কমিশনারের পদে নিয়োগ করে থাকেন। এই ব্যবস্থা বহাল রাখার পক্ষেই সওয়াল করেছেন ভেঙ্কটরামানি। কেন্দ্রের এই বক্তব্যের কঠোর সমালোচনা করেই বিচারপতিরা বলেছেন, কেন্দ্রে যারাই শাসনে আসুক, সেই শাসক দলের অযৌক্তিক একগুঁয়েমির জন্য নিয়োগে এই ব্যবস্থা রয়ে গিয়েছে। 

 

 

তারা নিজেদের স্বার্থেই এই ব্যবস্থায় কোনও পরিবর্তন আনতে চায় না। এখন প্রশ্ন হলো, যখন গণতন্ত্রের স্বার্থে নির্বাচনে স্বচ্ছতা সুনিশ্চিত করা জরুরি, তখন তা বজায় রাখার প্রশ্নে সুপ্রিম কোর্ট কি নীরব থাকতে পারে?
এই প্রসঙ্গে অ্যাটর্নি জেনারেল তথা কেন্দ্রের উদ্দেশে বিচারপতিরা আরও বলেছেন, ‘‘আপনাদের এই ক্ষেত্রে কিছু ব্যবস্থা নেওয়া উচিত বলেও গত ৩০ বছর কোনও ব্যবস্থাই নেননি। এখনও কি তবে কোর্টের নীরব থাকা উচিত? যদি এই বিষয়ে আইন তৈরি করার প্রয়োজন হয়, তাহলেও আর কত দিন আপনারা বলে যাবেন, আইন দরকার নেই। ইতিমধ্যে ৭০ বছর পার হয়ে গিয়েছে। ‌আর কত দিন আপনাদের সময় দরকার হবে? আপনারা নির্বাচন কমিশন এবং মুখ্য নির্বাচন কমিশনার ও দুই নির্বাচন কমিশনারের দিকে তাকান। নির্বাচনের সব ক্ষমতা ও দায়িত্ব তাঁদের উপর থাকলেও তিন কমিশনারের কার্যত ভঙ্গুর ও বিপন্ন অবস্থা। 

 

 

 

গুরুত্বপুর্ণ হলো, একটা ব্যবস্থা গড়ে তোলা প্রয়োজন। সেখানে এক জন সেই চরিত্রের মানুষ দায়িত্বে থাকবেৌ যিনি বলবেন, ‘কেউ কোনও পরিস্থিতিতে আমাকে বুলডোজ করে সরিয়ে দিতে পারবেন না। তিনি প্রধানমন্ত্রী হোন বা যে কেউ হোন। কাউকে আমি কেয়ার করি না।’ এই কারণে নিয়োগের একটা প্রক্রিয়া থাকা এখানে জরুরি।’’
এই মামলায় নির্বাচন কমিশনার পদে অরুণ গোয়েলের নিয়োগ নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়েছে। এদিন আইনজীবী প্রশান্ত ভূষণ এই নিয়োগে বেনিয়মের কথা উল্লেখ করে বলেন, অরুণ গোয়েল ছিলেন কর্মরত সরকারি আধিকারিক। হঠাৎ দেখা গেল, তাঁর জন্য নিয়ম মতো অবসরের আগে স্বেচ্ছা অবসরের ব্যবস্থা করিয়ে তাঁকে নির্বাচন কমিশনারের পদে নিয়োগ করা হলো। গত সোমবার গোয়েল দায়িত্বও গ্রহণ করেছেন। এদিন মামলা গ্রহণেই আপত্তি জানান অ্যাটর্নি জেনারেল। আপত্তি খারিজ করে বিচারপতিরা জানান, কী পদ্ধতিতে নিয়োগে হয়েছে, তা আদালতের জানা দরকার। 

 

 

তাই অবিলম্বে অরুণ গোয়েলের নিয়োগের ফাইল আদালতে জমা দেওয়ার নির্দেশ দেন বিচারপতিরা। 
এদিকে, নির্বাচন কমিশন নিয়ে সুপ্রিম কোর্ট কেন্দ্রের যে সমালোচনা করেছে তাকে স্বাগত জানিয়েছে বিভিন্ন বিরোধী দল। কংগ্রেস, জনতাদল (ইউ), বামপন্থী দলগুলি সহ বিভিন্ন দল এই নিয়ে প্রতিক্রিয়ায় জানিয়েছে, মোদী সরকার নির্বাচন কমিশনকেই দুর্বল করে ফেলেছে। সুপ্রিম কোর্ট নির্বাচন কমিশন নিয়ে আজ যা  মন্তব্য করেছে, তা খুই উদ্বেগজনক বিষয়। মোদী সরকারের আমলে গণতন্ত্র যে বিপন্ন, তা-ই স্পষ্ট হয়েছে বিচারপতিদের কথায়।

Comments :0

Login to leave a comment