গৌতম রায়
হিন্দু সাম্প্রদায়িক শিবিরের সঙ্গে নানাভাবে সম্পর্ক রাখতেন মদন মোহন মালব্য, পুরুষোত্তম দাস টন্ডন, কে মুস্তাফি, শেঠ গোবিন্দ দাসের মতো রাজনৈতিক নেতারা। এঁরা কংগ্রেসের সঙ্গে সম্পর্ক রেখেও হিন্দু সাম্প্রদায়িক মৌলবাদী রাজনীতির আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা করতেন।
সেই লক্ষ্যে গীতা প্রেসকে ব্যবহার করতেন এঁরা। ১৯২৩ সালে মদনমোহন মালব্যদের সঙ্গে আর্য সমাজের সম্পর্ক তৈরি হয় বেনারসে। গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছিল গোহত্যা এবং ধর্মান্তরের পর্যায়ক্রম ঘিরে। আর্য সমাজের শুদ্ধি আন্দোলনের মূল লক্ষ্য ছিল মুসলমান সম্প্রদায়কে ঘিরে গুজব তৈরি করা। যা থেকে সাম্প্রদায়িক পরিবেশ তৈরি হয়। যাতে হিন্দি বলয়ে ব্রিটিটশ সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী জাতীয়তাবাদকে সংকীর্ণ হিন্দু জাতীয়তাবাদে রূপান্তরিত করা যায়।
১৯১৬ সালে মদনমোহন মালব্য 'বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়' প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে বিশেষ রকমের ভূমিকা পালন করেন। পরবর্তী সময়ে ১৯৪০ সাল থেকে ১৯৪৭ সালের রাজনৈতিক ঘটনাবলী এবং নানা সাম্প্রদায়িক রাজনীতির চাপান উতোরে, ত্রাণ কার্যের ছদ্মবেশে হিন্দু সাম্প্রদায়িকতা এবং হিন্দুত্ববাদী জাতীয়তাবাদকে সন্ত্রাসী চেতনার উপর প্রতিষ্ঠিত করতে গীতা প্রেস-কে ব্যবহার করেন।
নাগপুরে ১৯২৫ সালে আরএসএসের প্রতিষ্ঠা লগ্ন থেকে গীতা প্রেসের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক পরিষ্কার হয়ে যায়। গীতা প্রেসের সঙ্গে সংযুক্তরা বিভিন্ন ধরনের সাময়িক পত্রপত্রিকা প্রকাশ করতেন। ১৯২০ সাল থেকে জাতীয়তাবাদের ভাবধারাকে রাজনৈতিক হিন্দুত্ববাদী জাতীয়তাবাদে রূপান্তরিত করার লক্ষ্যে আরএসএস সক্রিয় ছিল। আজ আরএসএসের শতবর্ষের প্রাক মুহূর্তে এবং ভারতের সাধারণ লোকসভা নির্বাচনের (১৯২৪) অব্যবহিত আগে, এই গীতা প্রেস-কে ঘিরে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী হঠাৎ করে এত উৎসাহিত হয়ে পড়লেন বোঝা যাবে।
১৯২৩ সালে আরএসএস প্রতিষ্ঠার আগেই রাজনৈতিক হিন্দুত্বকে ভারতের সমাজ ব্যবস্থায় প্রতিষ্ঠিত করে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী সংগ্রামকে অকেজো করতে তৎপর ছিল হিন্দু মহাসভা। হিন্দু মহাসভা এবং আর্য সমাজের মধ্যে বেনারসে যে বোঝাপড়া হয় , সেটি পরবর্তীকালে কেবলমাত্র গীতা প্রেস নয়, সামাজিক কর্মকাণ্ডের আড়ালে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড প্রসারিত করার অন্যান্য ক্ষেত্রেও প্রসারিত হয়। আরএসএস প্রতিষ্ঠার পর্ব থেকে ভারতে সেই সময়ে প্রবাহিত জাতীয়তাবাদের চেতনাকে রাজনৈতিক হিন্দু জাতীয়তাবাদের পরিণত করতে সচেষ্ট হয়।
কংগ্রেসের ভেতরে হিন্দু সাম্প্রদায়িক- মৌলবাদী ধারাকেই প্রধান ধারায় পরিচালিত করার চেষ্টা চালান মদনমোহন মালব্য, রাজেন্দ্র প্রসাদের মতো নেতারা। তখন হিন্দু মহাসভা কংগ্রেসের বার্ষিক অধিবেশনে নিয়মিত অংশগ্রহণ করত। পরবর্তীকালে কংগ্রেসের ভেতরে মহাত্মা গান্ধীর অসাম্প্রদায়িক নেতৃত্ব এবং নেহরু-সুভাষের সমাজতন্ত্রের প্রতি আগ্রহের ধারাকে চ্যালেঞ্জ করা হতো।
বস্তুত ১৯২২ সাল থেকে হিন্দু মহাসভার সঙ্গে কংগ্রেসের দক্ষিণপন্থী সাম্প্রদায়িক অংশের বোঝাপড়া ১৯৩৭ সাল পর্যন্ত চলেছিল। সেটি আরএসএসের রাজনীতিকে প্রসারিত করবার ক্ষেত্রে একটা বড় রকমের ভূমিকা পালন করেছিল সে বিষয়ে সন্দেহের কোন অবকাশ নেই।
১৯৩৭ সাল থেকে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের বার্ষিক অধিবেশনে হিন্দু মহাসভার অংশগ্রহণের বিষয়টি সম্পূর্ণভাবে বন্ধ হয়ে যায়, মহাত্মা গান্ধী এবং তাঁর অনুগামীদের ঐকান্তিক চেষ্টার ফলে।
গীতা প্রেস জন্ম লগ্ন থেকে ধর্মীয় চেতনাকে বিকৃত করে সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গি হাজির করে। হিন্দু ধর্মের বিভিন্ন বইপত্রকে এই গীতা প্রেস কার্যত নামমাত্র মূল্যে ছেপে থাকে। এদের কাগজ, বাঁধাই ইত্যাদি অত্যন্ত উচ্চমানের হয়। ফলে খুব তলিয়ে যারা রাজনীতিকে ভাবেন না ,ধর্ম ঘিরে যাদের একটা আকর্ষণ আছে, তাদের কাছে, গীতা ইত্যাদি হিন্দুদের প্রচলিত ধর্মগ্রন্থের বিকৃত উপস্থাপনা হাজির করে।
ভারতের বিভিন্ন বিখ্যাত রেল স্টেশনে গীতা প্রেসকে আরো বেশি বেশি জায়গা দেওয়া হয়েছে। বহু সময়েই রেলের প্রচলিত নিয়ম-কানুন মানা হয়নি। রেলমন্ত্রীর দায়িত্ব নিয়ে মমতা ব্যানার্জিও অকৃপণ হাতে জায়গা বিলি করে গিয়েছেন।
Comments :0