Suryakant Mishra

লুটেরা পুঁজির মুখে গণতন্ত্রের বিকেন্দ্রীকরণই নতুন চ্যালেঞ্জ

রাজ্য

প্রথম বামফ্রন্ট সরকার এরাজ্যে ত্রিস্তর পঞ্চায়েত গড়ে তুলে গণতন্ত্রের বিকেন্দ্রীকরণে দিশা দেখিয়েছিল। আজকের দিনে সেই পঞ্চায়েতে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে মানুষের সংগ্রামে নতুন সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে। সাক্ষাৎকারে জানালেন সিপিআই(এম)’র পলিট ব্যুরো সদস্য সূর্য মিশ্র। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন প্রসূন ভট্টাচার্য।


----------------
গণশক্তি: আজ থেকে ৪৬ বছর আগে, ১৯৭৭ সালের ২১ জুন পশ্চিমবঙ্গে প্রথম বামফ্রন্ট সরকার তৈরি হওয়ার পরেই যে গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলি করেছিল তার মধ্যে অন্যতম ছিল পঞ্চায়েতী ব্যবস্থা গড়ে তোলা। ত্রিস্তর পঞ্চায়েত গড়ে তোলার পিছনে কী উদ্দেশ্য ছিল বামফ্রন্টের? 
সূর্য মিশ্র: বামফ্রন্ট সরকার এবং তার আগের দুটো যুক্তফ্রন্ট সরকার জোর দিয়েছিল ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণে। জ্যোতিবাবু মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পরেই বলেছিলেন, আমরা ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ চাই। তার একটা দিক হলো সারা দেশে কেন্দ্র রাজ্য সম্পর্কের পুনর্বিন্যাস করা, এর জন্য অন্যান্য রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীদের নিয়ে দেশে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু খালি কেন্দ্র থেকে রাজ্যে ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ নয়, রাজ্য থেকে নিচে, পঞ্চায়েত পৌরসভায় মানুষের হাতে ক্ষমতা তুলে দিতে গুরুত্ব দিয়েছিলেন। গ্রামীণ সম্পদের বিকেন্দ্রীকরণ না করে ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ করা যায় না। সেই জন্যই ভূমিসংস্কার, জমির পুনর্বন্টন। জমির মালিকানার বৈষম্য দূর করা। এর জন্য লড়াই আগে থেকেই গতি পেয়েছিল, সেটাকে ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ থেকে আলাদা করা যায় না। মূল অভিমুখ ছিল এটাই।
গণশক্তি: ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণের মাধ্যমে ৩৪ বছরের বামফ্রন্ট সরকার কী ধরনের সাফল্য আনতে পেরেছিল গ্রামবাংলায়?
মিশ্র: সারা দেশের মোট জমির প্রায় ২ শতাংশ পশ্চিমবঙ্গে, কিন্তু জনসংখ্যার ৮ শতাংশ ছিল পশ্চিমবঙ্গে। অর্থাৎ জমির ওপরে চাপ ছিল। কিন্তু যদি জমির পুনর্বণ্টনের হিসাব দেখা যায় তবে সেটা সর্বোচ্চ পশ্চিমবঙ্গে, ২৬ শতাংশ ছাড়িয়ে গিয়েছিল। ১৯৭৮ সালে পঞ্চায়েত হলো সার্বজনীন ভোটাধিকারের ভিত্তিতে। এর আগে ১৯৭৩ সালের একটা আইন ছিল, কিন্তু সেটা কার্যকরী হয়নি, বামফ্রন্ট সরকারে এসে সেটার ভিত্তিতেই নির্বাচন করে। তারপরে ধাপে ধাপে আইন সংশোধন করা হয়েছে, পরে নরসিমা রাওয়ের সরকারের আমলে সংবিধান সংশোধন করা হয়। এরাজ্যে তার আগেই মহিলাদের জন্য এক তৃতীয়াংশ আসন সংরক্ষণ, তফসিলি জাতি ও আদিবাসীদের জন্য আসন সংরক্ষণ এগুলি করা হয়। আমরা পঞ্চায়েতেরও নিচে ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ করতে নামি। গ্রামের মানুষ যাতে কথা বলতে পারেন, প্রকল্প নির্ধারণে এবং রূপায়ণে তাঁদের ভূমিকা নির্দিষ্ট করতে পারেন তার জন্য ‘গ্রাম সভা’ করা হয়েছিল। যারা বৈষম্যের শিকার তাঁদের পক্ষে শ্রেণি ও সামাজিক ভারসাম্যের পরিবর্তন করেছিল এগুলি যা সারা দেশে মডেল হিসাবে স্বীকৃত হয়েছিল। রাজীব গান্ধী পশ্চিমবঙ্গের পঞ্চায়েতকে মডেল বলেছিলেন, আন্তর্জাতিক স্বীকৃতিও পেয়েছিল। 
গণশক্তি: এমন ‘গর্বের পঞ্চায়েত’ কী করে ‘লুটের পঞ্চায়েতে’ পরিণত হলো? এর পিছনে কী কারণ বলে আপনি মনে করেন?
মিশ্র: দীর্ঘ কারণ আছে। যেমন ভূমিসংস্কারের ফলে বর্গা ও পাট্টা মিলিয়ে প্রায় ৩০ লক্ষ মানুষ উপকৃত হয়েছিলেন। এর সঙ্গে ক্ষুদ্র সেচের ব্যবস্থা করা, উন্নত বীজ, মিনিকিট দেওয়া ইত্যাদির মাধ্যমে কৃষি উৎপাদন বাড়ল। ফলে চাল সবজি মাছ উৎপাদনে দেশে প্রথম হই। রাজ্য খাদ্যে স্বনির্ভর হলো। আগে মাইলো খাওয়ার দিন ছিল, তারপরে চাল উৎপাদনে প্রথম হলাম। মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বাড়ল, বাজার বাড়ল গ্রামে। কিন্তু একটা পর্যায়ে এসে আমরা বুঝেছিলাম যে খালি কৃষি ও ভূমি সংস্কারে হবে না, পাশাপাশি শিল্প ও পরিষেবায় বৃদ্ধি ঘটাতে হবে। নইলে উদ্বৃত্ত শ্রম কোথায় যাবে? তাই ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পে উদ্যোগ নিয়ে আমরা রাজ্যকে এক নম্বরে গিয়েছিলাম। গুজরাট আমাদের পিছনে ছিল। কিন্তু বৃহৎ শিল্প ছাড়া চলবে না। সেটা নানা কারণে পুরোটা করা গেল না। 
কিন্তু একটা অংশ প্রথম থেকেই বিরোধিতা করছিল, তারা ভূমিসংস্কারেরও বিরোধিতা করেছিল তাদের মাতব্বরি ভেঙে যাবে বলে। তাছাড়া বিরোধী শক্তি গ্রামে গণতান্ত্রিক স্বচ্ছতার ব্যবস্থা ভাঙতে চাইছিল। পশ্চিমবঙ্গে তারা সফল হতে পারতো না যদি বর্তমানের মুখ্যমন্ত্রী বিজেপি’কে ডেকে না আনতেন। এটাই ওঁর সবচেয়ে বড় অপরাধ। তারপরে প্রায় ৯০ শতাংশ তৈরি হয়ে যাওয়া মোটরগাড়ির কারখানা উনি মোদীর গুজরাটে উপহার হিসাবে পাঠিয়ে দিলেন। এর পিছনে কর্পোরেট, দেশের ও বাইরের প্রতিক্রিয়াশীল শক্তিও ছিল। তারপরে পরিবর্তন হলো, ফলে যা হওয়ার তাই হচ্ছে। এখন উলটে খাসজমি বর্গাজমি দখল হয়ে যাচ্ছে, সরকারি জমি বিক্রি করে দেওয়ার ব্যবস্থা হয়েছে। আগে অন্য রাজ্য থেকে এখানে কাজ করতে বেশি মানুষ আসতেন, এখন কাজের জন্য এরাজ্য থেকে বেশি যাচ্ছেন। বালেশ্বরের ট্রেন দুর্ঘটনায় নিহতদের তালিকা দেখলেই সেটা বোঝা যাচ্ছে। সব অর্থনৈতিক মাপকাঠিতে রাজ্য পিছিয়েছে। বামফ্রন্ট সরকার আসার আগে দারিদ্রসীমার নিচে ছিল ৭৩ শতাংশ মানুষ। বামফ্রন্ট সেটা ২৪ শতাংশে নিয়ে এসেছিল। ২০২২ সালের সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে, চারটে জেলায় দারিদ্রসীমার নিচে ৮০ শতাংশ মানুষ! এর সঙ্গে অবাধে লুট হচ্ছে। স্বাভাবিকভাবেই পশ্চিমবঙ্গের উল্লেখযোগ্য সাফল্যগুলি এখন ধংসের মুখে। 
গণশক্তি: গ্রামীণ মানুষের সর্বহারা হয়ে পড়ার উদ্বেগজনক চিত্র আপনি তুলে ধরছেন। কিন্তু অবস্থার পরিবর্তন ঘটানোর জন্য গ্রামের এই সর্বহারাদের কাছে কী প্রত্যাশা করছেন? 
মিশ্র: আমি মনে করি, এটাই চ্যালেঞ্জ। বামফ্রন্ট সরকারের পঞ্চায়েতের কারণে এই গরিবরাই উপকৃত হয়েছিলেন, ভূমিসংস্কারের ফলে উপকৃতদের ৭৩ শতাংশই ছিলেন আদিবাসী, তফসিলি, আদিবাসী, ওবিসি, সংখ্যালঘু। এই অংশটার মধ্যে জাতি ধর্ম ইত্যাদি নিয়ে ভাগাভাগি প্রায় চলে গিয়েছিল। কিন্তু বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী আরএসএস-বিজেপি’কে এখানে ডেকে আনার পরে তারা বিভাজনের সোশাল ইঞ্জিনিয়ারিং করছে। যেমন আদিবাসী ও কুর্মিদের মধ্যে বিরোধ লাগিয়ে দেওয়ার চেষ্টা হচ্ছে। ধর্মের নামেও বিভাজন করা হচ্ছে। তবে মানুষ লড়াইয়ের ময়দানে যখনই একজোট হচ্ছে এই অপকৌশল আর কাজে দিচ্ছে না। 
গণশক্তি: কিন্তু পঞ্চায়েত নির্বাচনের মনোনয়ন পর্ব ঘিরে যে ধরনের হিংসাত্মক ঘটনা দেখা গেল, এবং তারপরেও রাজ্যের সরকার ও নির্বাচন কমিশনকে সুপ্রিম কোর্টে গিয়ে কেন্দ্রীয় বাহিনী ঠেকানোর চেষ্টা করতে দেখা গেল, তাতে কি মনে হয় গ্রামের মানুষ অবাধে তাঁদের মতপ্রকাশ করতে পারবেন পঞ্চায়েত নির্বাচনে? 
মিশ্র: সরকার পঞ্চায়েতের মাধ্যমে ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ করবে কিনা তা সরকারের রাজনৈতিক সদিচ্ছার ওপরে নির্ভর করে। সেটা এই সরকারের নেই। এদের আমলে কোনও নির্বাচন অবাধ ও শান্তিপূর্ণ হয়নি। এই সরকার আসার পরেই যিনি রাজ্য নির্বাচন কমিশনার ছিলেন তিনি অবাধ নির্বাচনের জন্য লড়াই করেছিলেন, কিন্তু এককভাবে লড়ে তিনি কী করতে পারেন! তারপরে একজন কমিশনার না পেরে রাজ্যপালের কাছে গিয়ে পদত্যাগ পত্র দিয়ে এলেন। আমরা বামফ্রন্ট সরকারের থেকে সংবিধান সংশোধন হওয়ার আগেই রাজ্য নির্বাচন কমিশনারের স্বাধীন মর্যাদা নিশ্চিত করেছিলাম। আমি যখন মন্ত্রী ছিলাম, আমার মনে আছে একজন নির্বাচন কমিশনারের বিরুদ্ধে আমাদের লোকেরা অভিযোগ জানিয়েছিল, কিন্তু আমি বা সরকার থেকে কেউ নির্বাচন কমিশনারকে একটি কথাও বলিনি, টেলিফোনও করিনি। আর এখনকার নির্বাচন কমিশনার তো সরকারের কথায় চলেন। তিনি নির্বাচনী আইন পড়েছেন কিনা সন্দেহ। তাহলে যারা ব্লকে বাধা পাওয়ায় মনোনয়ন জমা দিতে পারলেন না তাঁদের মহকুমা শাসকের কাছে জমা দেওয়ার সুযোগ দিলেন না কেন? কেন্দ্রীয় বাহিনীর ভূমিকা আমরা আগে দেখেছি, তারা এলেই সমাধান হয়ে যাবে এমনটা আমরা বলছি না। কিন্তু হাইকোর্টের রায়ের পরেও কমিশনার সুপ্রিম কোর্টে গেলেন কেন? লজ্জা হওয়া উচিত। গণতন্ত্রের ওপরে নির্লজ্জ আক্রমণ চলছে। কিন্তু এরা ইতিহাস তৈরি করতে পারবে না। মানুষ প্রতিরোধের ময়দানে আছেন, সেই লড়াই চলবে, শেষপর্যন্ত মানুষই ইতিহাস তৈরি করবে। 
গণশক্তি: প্রতিরোধের ময়দানে আপনি লড়াকু মানুষের প্রতি যেভাবে ভরসা প্রকাশ করছেন তার ভিত্তিতেই সর্বশেষ প্রশ্নটা করি। যদি এবারের পঞ্চায়েত নির্বাচনে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের এই সংগ্রামে মানুষ জয়ী হয় তাহলে যে নতুন পঞ্চায়েত আমরা দেখতে পাবো গুণগত ভাবে সেটা কেমন হবে? এই তীব্র সংগ্রামের কোনও প্রভাব তাতে দেখা যাবে? 
মিশ্র: পশ্চিমবঙ্গে গণতন্ত্রকে বিকেন্দ্রীভূত করতে আমরা গ্রাম স্তর পর্যন্ত নামতে পেরেছিলাম, পশ্চাৎপদ গ্রামকে চিহ্নিত করতে পেরেছিলাম, গ্রামের মানুষকে উন্নয়নের জন্য সরকারি টাকা দেওয়ার ব্যবস্থা করতে পেরেছিলাম, কিন্তু অডিট রিপোর্টে সমস্ত হিসাব স্বচ্ছ থাকতে হবে। এখনকার চ্যালেঞ্জ হলো, সারা দেশে এবং এরাজ্যের পঞ্চায়েতেও লুটেরা পুঁজির আক্রমণ চলছে। কোনও উৎপাদন হচ্ছে না, কেবল লুট হচ্ছে। এই অর্থনৈতিক পরিস্থিতির মধ্যে, যেখানে সরকার গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে, বিকেন্দ্রীকরণের বিরুদ্ধে, তার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে পঞ্চায়েতকে কাজ করতে হবে। এটা নতুন চ্যালেঞ্জ, নতুন সম্ভাবনাও আছে এরমধ্যে। ওপর থেকে জ্যোতি বসু পঞ্চায়েত নির্বাচনের ঘোষণা করলেন, বামফ্রন্ট সরকার রাজনৈতিক সদিচ্ছা দেখালো, তার মধ্যে ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ করা আর সদিচ্ছাহীন সরকারের বিরুদ্ধে লড়াই করে মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা দুটো এক নয়। এটা নতুন পর্ব। মানুষের অপরিসীম ক্ষমতা আছে। আজকের চ্যালেঞ্জের মুখে মানুষ নতুন পথ দেখাতে পারবে, যেখানে পঞ্চায়েত খালি সরকারের ওপরে নির্ভরশীল হয়ে থাকবে না, গ্রাম থেকে স্বনির্ভর বিকেন্দ্রীভূত গণতন্ত্র গড়ে উঠবে। মানুষই মানুষের পাশে এগিয়ে আসবে। মহামারীর সময়ে যদি স্বেচ্ছাসেবকরা শিক্ষা, জনস্বাস্থ্য, ক্যান্টিন চালিয়ে মানুষের পাশে থাকতে পারে, সমবায় স্বনির্ভর গোষ্ঠী যদি ঠিকমতো চালানো যায়, তাহলে নতুন করে স্বনির্ভর পাড়া, স্বনির্ভর গ্রাম, স্বনির্ভর শহর এবং তার ভিত্তিতে স্বনির্ভর রাজ্য ও দেশ গড়ে তোলার লড়াই জোরদার হবে।  

Comments :0

Login to leave a comment