Washington Post

ছাঁটাই রুখতে ধর্মঘট, স্তব্ধ ওয়াশিংটন পোস্ট

আন্তর্জাতিক

 ক্ষতিপূরণ ছাড়াই কর্মী ছাঁটাই এবং উন্নত বেতন কাঠামোর চুক্তি সইয়ে কর্তৃপক্ষের টালবাহানার প্রতিবাদে সাংবাদিক ও সংবাদকর্মীদের ধর্মঘটে স্তব্ধ হয়ে রইলো বিশ্ববিখ্যাত মার্কিনী দৈনিক ‘দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট’র সব ছাপাখানা। বিশ্বের তাবৎ সংবাদমাধ্যম জগৎকে সচকিত করে বৃহস্পতিবার টানা চব্বিশ ঘণ্টা এই ধর্মঘট করেছেন কয়েক হাজার সাংবাদিক। তাঁদের পাশে দাঁড়িয়ে কর্মবিরতি করেছেন সংবাদপত্রটির অসাংবাদিক কর্মীরাও। আপাতত একদিনের প্রতীকী ধর্মঘট করলেও সংবাদপত্রটির সর্বস্তরের কর্মীদের সংগঠন ‘দ্য ওয়াশিংটন-বাল্টিমোর পোস্ট গিল্ড’ সাফ জানিয়ে দিয়েছে, কর্পোরেট মালিকের শোষণ ও যথেচ্ছাচার বন্ধ না হলে এই লড়াই থামবে না। ভবিষ্যতে আরও বড় ধর্মঘট হবে।
বিশ্ব পুঁজিবাদের পীঠস্থান হিসাবে পরিচিত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে লাগাতার ছাঁটাইয়ের মুখে এখন একের পর এক সংস্থায় ট্রেড ইউনিয়ন গড়ে তুলছেন কর্মীরা, শামিল হচ্ছেন ধর্মঘটেও। কিন্তু ওয়াশিংটন পোস্ট’র মতো বহুল পরিচিত ও প্রচারিত একটি সংবাদপত্রে সর্বাত্মক ধর্মঘটের খবরে সারা বিশ্বের সংবাদমাধ্যম নড়েচড়ে বসেছে। এর আগে ১৯৭৫-৭৬ সালে টানা কুড়ি সপ্তাহ ধর্মঘট করেছিলেন ওয়াশিংটন পোস্ট’র সাংবাদিক ও সংবাদকর্মীরা। তারপরে এটিই তাঁদের সম্মিলিত এবং জোরালো প্রতিবাদ।
একরাশ ক্ষোভ উগরে দিয়ে ধর্মঘটী সাংবাদিকরা জানাচ্ছেন, বৃহদাকার বিপণন সংস্থা আমাজনের মালিক জেফ বেজোসের হাতে ওয়াশিংটন পোস্ট যাওয়ার পরে সংস্থায় ছাঁটাই, বঞ্চনা এবং যথেচ্ছাচার আরও তীব্র হয়েছে। গত বছরেই ওয়াশিংটন পোস্ট থেকে ছাঁটাই করা হয়েছিলো ৪০ জনকে। এবার আরও ৯৪০ জনকে ছাঁটাইয়ের পরিকল্পনা করেছে কর্তৃপক্ষ। এই অন্যায় কিছুতেই মেনে নেওয়া হবে না।
সাংবাদিক-সংবাদকর্মীদের সংগঠন ওয়াশিংটন-বাল্টিমোর পোস্ট গিল্ডের প্রতিনিধিরা জানিয়েছেন, কর্তৃপক্ষের অদক্ষ পরিচালনার খেসারত সাংবাদিকদের ঘাড়ে চাপানো হচ্ছে। ন্যায্য প্রাপ্যও মেটানো হচ্ছে না। গত দেড় বছর ধরে কাজের শর্ত, বেতন এবং ভাতা কাঠামো উন্নত করার দাবি জানানো হচ্ছে। কিন্তু এব্যাপারে সাংবাদিক-সংবাদকর্মীদের সঙ্গে কোনও চুক্তিতেই আসতে চাইছে না মালিকপক্ষ।
কর্পোরেট মালিক জেফ বেজোসের আচরণে ধিক্কার জানিয়ে ওয়াশিংটন পোস্টের সাংবাদিকরা বলছেন, এবার এই সংবাদপত্রেও আমাজনের সংস্কৃতি চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে। ওদের একটাই নীতি, ‘শ্রমিক-কর্মীদের নিংড়ে নাও, তারপরে ছুঁড়ে ফেলে দাও’। তাঁদের আক্ষেপ, সংবাদ সংগ্রহ থেকে সংবাদ পরিবেশনা— সব রকমের ঝুঁকি নিয়ে দিনরাত পরিশ্রমের মাধ্যমে আমরা সংবাদপত্রটিকে বারবার খ্যাতির শীর্ষে তুলে এনেছি। এমনকি মালিকপক্ষের ভুল পরিচালনার মাশুল সামলে পত্রিকার আর্থিক মুনাফাও যথাসম্ভব বাড়িয়ে তুলেছি। কিন্তু এখন আমাদেরই ছাঁটাই করে দিতে উদ্যত হয়েছে ওরা।
কর্তৃপক্ষের অবশ্য সাফাই, চলতি ইন্টারনেট-যুগে যথেষ্ট বিজ্ঞাপন জুটছে না মুদ্রণ সংবাদমাধ্যমে। বিজ্ঞাপনের সিংহভাগই যাচ্ছে ডিজিটাল মাধ্যমে। তাছাড়া সাম্প্রতিক সময়ে সংবাদপত্রের বিক্রিও কমেছে। চলতি আর্থিক বছরে সংস্থায় আনুমানিক ১০কোটি ডলার লোকসানের আশঙ্কাও করা হচ্ছে। তাই সংস্থাকে লাভজনক রাখতে কর্মী ছাঁটাই ছাড়া পথ নেই। এর মধ্যেই নভেম্বরের গোড়ায় ওয়াশিংটন পোস্টের চিফ এক্সিকিউটিভ তথা প্রকাশক পদে উইল লুইস নামে এক ব্যক্তিকে নিয়োগের ঘোষণা করা হয়েছে। ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল’র প্রাক্তন প্রকাশক লুইসের আনুষ্ঠানিক দায়িত্ব নেওয়ার কথা আগামী ২ ডিসেম্বর। কিন্তু জানা গিয়েছে, কাজে যোগ দেওয়ার আগেই মালিকের ইচ্ছাপূরণে সাংবাদিক ও অসাংবাদিক কর্মীদের বেপরোয়া ছাঁটাইয়ের ছক কষে নিয়েছেন তিনি।
লুইসের নিয়োগ-ঘোষণার সময়েই জেফ বেজোস প্রকাশ্যে জানিয়ে দিয়েছেন, ‘‘নিউজরুমের আকার আরও অন্তত ১০ শতাংশ ছাঁটতে হবে এখনই।’’ এর আগে গত অক্টোবরেই ওয়াশিংটন পোস্টের অন্তর্বর্তী চিফ এক্সিকিউটিভ প্যাটি স্টোনেসিফারও আরও অন্তত ২৪০ জনকে ছাঁটাই করার কথা প্রকাশ্যেই শুনিয়ে দিয়েছিলেন।
তবে মালিক-কর্তৃপক্ষের এসব যুক্তি সরাসরি উড়িয়ে দিয়ে ধর্মঘটী সাংবাদিকরা স্পষ্ট বলেছেন, এই হারে কর্মী ছাঁটাই হলে বিশ্বখ্যাত এই সংবাদপত্রের মান এবং ধার কিছুই ধরে রাখা যাবে না। তাতে আখেরে ক্ষতি এই ঐতিহ্যবাহী সংবাদপত্রেরই। অথচ সংস্থার সঠিক পরিচালনায় কর্তৃপক্ষ সচেষ্ট হলেই আর্থিক পরিস্থিতি সামলানো সম্ভব। ধর্মঘটের আগেই এক ভিডিও বার্তায় পত্রিকার তাঁরা জানিয়েছিলেন, নিজেদের জীবন বিপন্ন করে বিভিন্ন যুদ্ধ, বিশ্বব্যাপী মহামারী সহ স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক স্তরের সমস্ত ঘটনার সংবাদ সংগ্রহ করেছেন সাংবাদিকরা। তাঁদের ভূমিকার কারণেই বহু শক্তিশালী প্রতিষ্ঠানের গাফিলতি প্রকাশ্যে এসেছে এবং দায়িত্ব পালনে বাধ্য হয়েছে সেসব প্রতিষ্ঠান। বিশ্বে সম্মান বেড়েছে সংবাদপত্রের। তাই ন্যায়সঙ্গত বেতনই আমাদের প্রাপ্য।
১৮৭৭ সালে প্রতিষ্ঠিত দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট’এ সাংবাদিক ও সংবাদকর্মীদের বেতন ও অন্যান্য সুবিধা বৃদ্ধির দাবিতে গত ১৮ মাস ধরেই কর্তৃপক্ষের সঙ্গে দরকষাকষির আলোচনা চালাচ্ছিল ওয়াশিংটন পোস্ট গিল্ড। কিন্তু কর্তৃপক্ষের অনমনীয় মনোভাবের জেরে পরে গিল্ড প্রকাশ্যে জানিয়ে দেয়, ন্যায়সঙ্গত বেতন এবং কর্মক্ষেত্রে যুক্তিযুক্ত শর্তের দাবি মানতে রাজি হয়নি কর্তৃপক্ষ। তাই ধর্মঘট ছাড়া অন্য পথ নেই তাদের সামনে। 
ধর্মঘটী এক সাংবাদিক ক্যামেরার সামনে বলেছেন, ‘‘আমি বেঁচে থাকার মতো বেতন পাওয়ার যোগ্য। আমি মুদ্রাস্ফীতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ বর্ধিত বেতন পাওয়ার যোগ্য। আমি জাতি বা লিঙ্গ নির্বিশেষে আমার সহকর্মীদের সমান বেতন পাওয়ার যোগ্য। আমি চাকরির সুরক্ষা পাওয়ার যোগ্য, যা আমার এত বছরের কাজের যথাযথ মূল্য দেবে। কিন্তু মালিক কোন কথাই শুনতে রাজি হচ্ছে না। তাই আমরা আজ প্রতিবাদের রাস্তায়।’’-

 

Comments :0

Login to leave a comment