Women Unemployment

দেশের প্রায় ৯ কোটি মহিলা কাজের বাজার থেকে বিচ্ছিন্ন

জাতীয়

 আনতর্জাতিক  নারী দিবসে শনিবার গুজরাটে নরেন্দ্র মোদীর সভায় নিরাপত্তার দায়িত্বে পুলিশের শুধু মহিলা কর্মী ও আধিকারিকরা থাকবেন। প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তার গুরুদায়িত্ব মহিলাদের কাঁধে চাপিয়ে চটক দেখানোর চেষ্টা করা হলেও মোদী-রাজে মহিলারা আদৌ নিরাপদ? তাঁদের জীবনের, শ্রমের, সম্মান-সম্ভ্রমের নিরাপত্তা আছে? আন্তর্জাতিক মহিলা দিবসের প্রাক্কালে শুক্রবার ভারতে লিঙ্গ ভিত্তিক কর্মসংস্থানের উপর একটি রিপোর্ট প্রকাশিত হওয়ায় ফের সেই প্রশ্ন জোরালো আকার নিয়েছে। দেখা গিয়েছে, দেশের ৮ কোটি ৯০ লক্ষেরও বেশি শহুরে মহিলাই ২০২৩-’২৪ অর্থবর্ষে শ্রমবাজারের সঙ্গে যুক্ত নন। অর্থাৎ তাঁরা কোনোরকম কাজই পাননি বা করেননি। এমনিতেই দেশের নানা প্রান্তে প্রতিদিন ধর্ষণ, শ্লীলতাহানি, গার্হস্থ্য হিংসা সহ সমস্ত ধরনের নারী নির্যাতন পাল্লা দিয়ে বাড়ছে। মেয়েদের কাজের সুযোগ কমে আসা, তাঁদের আরও পিছনের দিকে ঠেলে দেওয়ার ভয়ানক প্রবণতা যে কঠিন পরিস্থিতি তৈরি করেছে, সেকথাই এই রিপোর্টের প্রতি ছত্রে তুলে ধরা হয়েছে।  
উল্লেখ করা যেতে পারে, ১৯১০ সালে কোপেনহেগেনে অনুষ্ঠিত শ্রমজীবী মহিলাদের দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক সম্মেলনে জার্মান বামপন্থী নেত্রী ক্লারা জেটকিন বছরের একটি দিনে আন্তর্জাতিক শ্রমজীবী মহিলা দিবস পালনের প্রস্তাব দিয়েছিলেন। সেই প্রস্তাব সর্বসম্মতিতেই গৃহীত হয়েছিল ওই সম্মেলনে। তারপরে বিভিন্ন দেশ বিভিন্ন দিনে তা পালন করতে শুরু করে। তবে শেষ পর্যন্ত ৮ মার্চ দিনটিকে নির্দিষ্ট করা হয়, ১৯১৭ সালের যে দিনে জার-শাসিত রাশিয়ায় ‘রুটি ও শান্তি’র জন্য ধর্মঘট শুরু করেছিলেন মহিলারা। দিনটির নাম অবশ্য দেওয়া হয় আন্তর্জাতিক মহিলা দিবস। তবে এই বছরে দিনটির প্রাক্কালে ভারতের শহুরে মহিলাদের কর্মসংস্থান নিয়ে চেন্নাইয়ের ‘গ্রেট লেকস ইনস্টিটিউট অব ম্যানেজমেন্ট’-এর তৈরি রিপোর্ট প্রকাশ্যে আসায় এটি জেটকিনের মূল প্রস্তাবটিকে নতুন মাত্রায় প্রাসঙ্গিক করে তুলল বলা যায়। এই রিপোর্টের শিরোনাম ইন্ডিয়া’স জেন্ডার এমপ্লয়মেন্ট প্যারাডক্স। রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে, গত ছ’বছরে ভারতে মহিলাদের কর্মসংস্থান ১০ শতাংশ বাড়লেও শহরাঞ্চলের এই বিপুল সংখ্যক মহিলা কাজের বাজারের বাইরে। শিক্ষিত মহিলাদের দক্ষতার কোনও ব্যবহার হয় না। ১ কোটি ৯০ লক্ষ স্নাতকোত্তীর্ণ মহিলার শিক্ষাগত যোগ্যতা এবং দক্ষতাকে ব্যবহার করার ক্ষেত্রে ভারত ব্যর্থ। এই মহিলাদের কেউ ব্যক্তিগত পছন্দে কাজে ঢোকেননি। আবার অনেকেই সামাজিক বিধিনিষেধের কোপে পড়ায় ইচ্ছা থাকলেও কাজ করতে পারেননি। মেয়েদের পড়াশোনা করানো মানে বাজে খরচ, আজও এই প্রচলিত ধারণারও কঠোর সমালোচনা করা হয়েছে রিপোর্টে। 
কী কী কারণে শহুরে মহিলারা শ্রম বাজারে অংশ নেওয়া থেকে বিরত রয়েছেন? এই রিপোর্টে বিশেষজ্ঞরা মনে করেছেন, পরিবারের প্রত্যেকের যত্ন নেওয়ার দায়িত্ব সাধারণভাবেই বাড়ির মহিলা সদস্যদের ঘাড়ে ঠেলে দেওয়া হয়। এই কাজ একমাত্র তাঁদেরই করার কথা, এমন ভাবনা সমাজে গেঁথে বসেছে। বাড়ির বাইরে বেরিয়ে কাজ করতে না পারার পিছনে এটি একটি গুরুতর কারণ। পাশাপাশি কাজের সুব্যবস্থাপনা সহ একাধিক প্রতিবন্ধকতা উপেক্ষা করে উচ্চশিক্ষিত মহিলারা দেশের অর্থনীতিতে পুরোদমে যুক্ত হতে পারেন না। অথচ সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে, পুরুষদের কর্মসংস্থানের গতি মহিলাদের ছাড়িয়ে যাচ্ছে। ‘পিরিওডিক লেবার সার্ভে’, ‘ন্যাশনাল হেলথ সার্ভে’ ও ‘টাইম ইউজ সার্ভে’র তথ্য পর্যালোচনা করে এই রিপোর্ট তৈরি করা হয়েছে। মূলত ২০ থেকে ২৪ বছর বয়সি পুরুষ এবং মহিলাদের এই রিপোর্টের আওতায় রাখা হয়। আরও উল্লেখযোগ্য বিষয় তুলে ধরে রিপোর্টে বলা হয়েছে, উচ্চশিক্ষিত পরিবারগুলিতে লিঙ্গ বৈষম্য প্রকট। এমনকী স্বামী-স্ত্রী দু’জনেই রোজগার করেন, দু’জনেই উচ্চশিক্ষিত, তারপরেও সেই পরিবারে লিঙ্গ-অসমতা দেখা যায়। সমীক্ষায় উঠে এসেছে, ৬২ শতাংশ পরিবারে সম যোগ্যতায় শিক্ষিত হয়েও স্বামীরাই স্ত্রীদের থেকে বেশি আয় করেন। আশঙ্কার বিষয় হলো, রোজগেরে মহিলারাও শ্বশুরবাড়িতে অত্যাচার সহ্য করে নিচ্ছেন। তাঁরা গাহর্স্থ্য হিংসার অভিযোগ দায়ের করতে চান না। ৪১ শতাংশ পরিবারে বাড়ির সমস্ত দায়িত্ব মহিলাদের উপরেই, বেশিরভাগ ঘরের কাজই তাঁদের করতে হয়। শহুরে মহিলাদের পরিস্থিতিই যদি এমন হয়, তাহলে গ্রামে কী অবস্থা? সেই প্রশ্ন উঠে আসছে স্বাভাবিকভাবেই।
‘ইন্টারন্যাশনাল লেবার অর্গানাইজেশন’ (আইএলও) তাদের রিপোর্টে বলেছে, এই গতিতে চললে কর্মসংস্থানের হারে লিঙ্গসাম্য আসতে ১৯০ বছর লেগে যাবে। কেন্দ্রীয় সরকারের সাম্প্রতিক একটি সমীক্ষা থেকে উঠে এসেছে এক নিদারুণ তথ্য, ১৫ থেকে ৫৯ বছর বয়সি ৪১ শতাংশ মহিলা পরিবারের প্রত্যেকের যত্নে নজর রাখেন। আর পুরুষের ক্ষেত্রে এই পরিসংখ্যান ২১.৪ শতাংশ, কার্যত অর্ধেক। মোদী সরকার এই রিপোর্ট নিয়ে বিস্তর মাতামাতি করে বলেছিল, এর থেকে বোঝা যাচ্ছে, ভারতের সামাজিক পরিকাঠামো অনুযায়ী, বাড়ির যাবতীয় কাজকর্মের দায়িত্ব মহিলারাই বহন করে থাকেন। পরিবারের অন্যদের দেখভাল করার দায়িত্ব তাঁদেরই। 
এদিন ‘দিল্লি ইউনিয়ন অব জার্নালিস্টস’ কাজের পরিসরে মেয়েদের দুরবস্থার বিষয়টি উল্লেখ করে এক বিবৃতিতে বলেছে, ভারতীয় সাংবাদিকতাতেও এই প্রবণতাই দেখা যায়। নিউজরুমে আরও মহিলাদের প্রয়োজন। তবেই পেশা হিসাবে সাংবাদিকতা আরও উজ্জ্বল হয়ে উঠবে।

Comments :0

Login to leave a comment