100 days work

কাজ দিতে ব্যর্থ, তবু মোদীরই নীতি মেনে রাজ্যে বাতিল দেদার জব কার্ড

রাজ্য জেলা

100 days work bengali news

এক দিনে ১৫৯০ জনের জব কার্ড বাতিল করেছে পঞ্চায়েত। গত পঞ্চায়েত নির্বাচনের ফল ঘোষণার ৯ দিন পর এই ঘটনা ঘটেছে দক্ষিণ ২৪ পরগনার ক্যানিংয়ের একটি পঞ্চায়েতে।
রাজ্যে একশো দিনের কাজ নেই। কিন্তু জব কার্ড বাতিল করা চলেছে দেদার। অনেক ক্ষেত্রেই জব কার্ড বাতিলের কারণ হিসাবে লেখা হয়েছে ‘কাজ করতে ইচ্ছুক নয়’। যাঁদের কাজই দিতে পারছে না সরকার, তাঁরা ‘কাজে ইচ্ছুক নয়’— এই কথা সরকার কী করে বলতে পারে? উঠেছে প্রশ্ন।
শুধু ক্যানিং ২ নম্বর ব্লকের আঠারোবাঁকি পঞ্চায়েতেই এমন ঘটেছে, তা নয়। ওই ব্লকেরই তাম্বুলদহ ১ পঞ্চায়েতে গত ২ নভেম্বর বাতিল করা হয়েছে ২৩৩ জনের জব কার্ড। শুধু দক্ষিণ ২৪ পরগনাতেই ঘটেছে এমন? না। ঝাড়গ্রামের লালগড়ে বাতিল হয়েছে ৪৯০ জনের জব কার্ড। কোচবিহারের মহিশকুচি ১ পঞ্চায়েতে জব কার্ড বাতিল হয়েছে ৩৩ জনের, এক দিনে— গত ৩১ জুলাই। মুর্শিদাবাদের বেলডাঙা ২ ব্লকের রামপাড়া ২ পঞ্চায়েতে ৩৭২ জনের জব কার্ড বাতিল হয়েছে গত ২৬ এপ্রিল। পূর্ব বর্ধমানের খণ্ডঘোষ পঞ্চায়েতে একইভাবে একদিনে, গত ১২ অক্টোবর বাতিল হয়েছে শতাধিক গ্রামবাসীর জব কার্ড। এমন উদাহরণ রাজ্যের প্রায় প্রতিটি জেলায় আছে। 
তবে জব কার্ড বাতিল করার কারণ হিসাবে অনেক নামের পাশেই রাজ্য প্রশাসন লিখেছে— ‘ডুপ্লিকেট কার্ড’ অথবা ‘ফেক জব কার্ড’। এই ভুয়ো কার্ডগুলি ব্যবহার করে প্রচুর টাকা চুরি করেছেন তৃণমূলের নেতারা। তবে তার হিসাব বের করার কোনও উদ্যোগ কেন্দ্র বা রাজ্য সরকারের নেই। 
নতুন আর্থিক বছর শুরু হয়েছে গত ১ এপ্রিল। এই ৯ মাসে রাজ্যে ৬ লক্ষের বেশি গ্রামবাসীর জব কার্ড বাতিল হয়েছে। রাজ্যের বেশিরভাগ পঞ্চায়েত লুটতরাজ চালিয়ে তৃণমূলের দখল করা। সেই দখল করা পঞ্চায়েতগুলি ঢালাও জব কার্ড বাতিল করেছে। এই জব কার্ড বাতিলের কাজ হয়েছে মোদী সরকারের নির্দেশ অনুসারে। 
জব কার্ডের সঙ্গে আধার সংযোগ শুরু হয়েছে নরেন্দ্র মোদীর আমলে। যাঁদের আধার কার্ড নেই, তাঁদের নাম বাদ যাচ্ছে। বিজেপি’র লক্ষ্য একশো দিনের কাজে খরচ কমানো। ২০১৪-তে প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন নরেন্দ্র মোদী। তারপর থেকেই প্রথম ইউপিএ সরকারের সময়কালে বামপন্থীদের চাপে চালু হওয়া এই গ্রামীণ কর্মসংস্থান নিশ্চয়তার প্রকল্পে খরচ কমাতে উঠে পড়ে লাগে বিজেপি’র সরকার। একশো দিনের কাজের প্রকল্প যখন চালু হয়েছিল, তখন মমতা ব্যানার্জি ছিলেন বিরোধী। একশো দিনের কাজের প্রকল্পের ক্ষেত্রে রাজ্যের তৃণমূল সরকার নিঃশব্দে মেনে চলছে মোদী সরকারের নির্দেশই। সোচ্চারে শুধু টাকার দাবি জানিয়েছে তৃণমূল। কিন্তু ২০১৭-১৮ থেকেই যে রাজ্যে দেদার জব কার্ড বাতিল করা হয়েছে মোদী সরকারের দেখানো পথে, তা মমতা ব্যানার্জিরা কখনও বলেননি।
প্রতি বছরই নতুন জব কার্ড হয়। রাজ্যের গ্রামোন্নয়ন দপ্তর সূত্রে জানা গিয়েছে, ২০১৭-র এপ্রিল থেকে ২০২৩-র ডিসেম্বর পর্যন্ত রাজ্যে নতুন জব কার্ড হয়েছে ৮০ লক্ষ ৮৬ হাজার ৭৮৬ জন গ্রামবাসীর। আর এই ৬ বছর ৯ মাসে জব কার্ড বাতিল হয়েছে ১ কোটি ২৫ লক্ষ ৫১ হাজার ৭৮৫ জনের। অর্থাৎ বাতিল হয়েছে ৪৪ লক্ষ ৬৪ হাজার ৯৯৯ জনের জব কার্ড। এই জব কার্ড বাতিল হয়েছে মূলত সেই নামে আধার কার্ড না থাকায়। এর একাংশ ভুয়ো ছিল। আর একাংশ সেই সব গরিব গ্রামবাসীর, যাঁদের আধার কার্ড হয়নি, কিংবা যাঁরা কাজের সূত্রে দীর্ঘ দিন অন্য জেলায় বা রাজ্যে আছেন।
রাজ্যে জব কার্ড বাতিলের কাজ অনেক আগেই শুরু হয়েছে। প্রমাণ রাজ্যের গ্রামোন্নয়ন দপ্তরের ২০১৭-র ৫ জুলাইয়ের নির্দেশিকা। প্রত্যেক জেলা শাসককে চিঠি দেওয়া হয়েছিল রাজ্যের গ্রামোন্নয়ন দপ্তরের পক্ষ থেকে। চিঠির শিরোনাম ছিল— ‘ভুয়ো জব কার্ড প্রসঙ্গ’। চিঠির মোদ্দা অজুহাত ছিল, প্রতিটি রাজ্যেই ভুয়ো জব কার্ড আছে বলে কেন্দ্রীয় গ্রামোন্নয়ন মন্ত্রক চিহ্নিত করেছে। পশ্চিমবঙ্গেও সেই ভুয়ো জব কার্ডের মাধ্যমে ‘ভূতুড়ে সুবিধাভোগী’র অ্যাকাউন্টে টাকা ঢুকেছে। অনেক জব কার্ডধারীই হয় মৃত, নয়তো বাইরে চলে গিয়েছেন কাজের খোঁজে। এই পরিস্থিতিতে আরও গতি আনতে হবে ভুয়ো জব কার্ড চিহ্নিত করে তা বাদ দেওয়ার কাজে।
আসলে এর পিছনে ছিল অন্য অঙ্ক। লোক কমিয়ে দিতে পারলে গড় কাজের দিন বেড়ে যায়। মমতা ব্যানার্জি বারবার ঘোষণা করেছেন যে, তিনি গড় কাজের দিন বাড়িয়ে দিচ্ছেন। মুখ্যমন্ত্রীর ঘোষণা বাস্তবায়িত করতে এই কৌশল নিয়েছিল রাজ্য সরকার। 
কিন্তু দু’টি অসুবিধা হচ্ছিল। প্রথমত, যাঁরা প্রকৃতই গরিব, তাঁদের অনেকেই একশো দিনের কাজ থেকে ছিটকে যাচ্ছিলেন। মানুষের ক্ষোভ বাড়ছিল। দ্বিতীয়ত, সামান্য ভুয়ো জব কার্ডও খারিজ হয়েছে। তাতে চুরির সুযোগ কমছিল তৃণমূল কংগ্রেসের নেতাদের।
তবে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন সিপিআই(এম)’র পঞ্চায়েত প্রধানরা। ২০১৮-র পঞ্চায়েত নির্বাচনের আগে পর্যন্ত বাদুড়িয়ার রামচন্দ্রপুর পঞ্চায়েতের প্রধান ছিলেন রবিউল হক। তিনি জানিয়েছেন, ‘‘আমার কাছে একটি কাগজ পাঠানো হয়েছিল প্রশাসনের পক্ষ থেকে। সেখানে অনেকগুলি পরিবারের নাম ছিল। বলা হয়েছিল, এদের জব কার্ড বাতিল হবে। আপনি সই করুন। আমি বলে দিয়েছিলাম, গরিবের জব কার্ড কাটা যাচ্ছে। তাতে আমি সই করব? কক্ষনো নয়। আমাদের চাপেই প্রথম ইউপিএ সরকারের আমলে রেগা চালু হয়েছিল। এখন সেই আমিই সই করব জব কার্ড কাটায়? কে ভুয়ো, কে আসল চিহ্নিত করার ক্ষেত্রে আধার কার্ড কোনও মাপকাঠি হতে পারে না। আমি সই করিনি। কোনও দিন করবও না।’’


 

Comments :0

Login to leave a comment