NARODA GAM MASSACRE

নারোদা গাম গণহত্যাতেও ছাড় অভিযুক্ত ৬৭-কেই

জাতীয়

gujrat pogrom naroda gam amit shah bjp rss gujrat bengali news মুক্তির পরে মায়া কোদনানি সহ বাকি অভিযুক্তরা

ঠিক বিকেল সাড়ে পাঁচটায় বিশেষ বিচারপতি এস কে বকশি রায় শোনাতেই আদালতের বাইরে স্লোগান উঠল ‘জয় শ্রী রাম’। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ১১জন মানুষকে পুড়িয়ে মেরে ফেলায় অভিযুক্তরা খালাস পেতেই আওয়াজ উঠল ‘ভারত মাতা কি জয়’। গণহত্যায় অভিযুক্ত বিজেপি’র প্রাক্তন মন্ত্রী মায়া কোদনানি সহ জীবিত অভিযুক্তদের আত্মীয়-দলবল তখন রীতিমতো জয়ের উল্লাসে মেতে উঠেছে।

 
শুধু নরেন্দ্র মোদীর তৎকালীন মন্ত্রীসভার সদস্যই নয়, বৃহস্পতিবার আমেদাবাদের বিশেষ আদালত ২০০২-এর নারোদা গাম গণহত্যায় জীবিত ৬৭জন অভিযুক্তকেই বেকসুর খালাস করে দিয়েছে। তাদের মধ্যে আছে বজরঙ দলের নেতা বাবু বজরঙ্গী ও ভিএইচপি নেতা জয়দীপ প্যাটেলও। এদের কেউ যদিও এখন জেলে ছিল না। নরেন্দ্র মোদী প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর যেভাবে একে একে সব দাঙ্গাবাজরা জেলের বাইরে চলে এসেছে, সেই পথেই মায়া কোদনানি, বাবু বজরঙ্গীরাও এখন জেলের বাইরেই ছিল। এদিন আদালতের রায়ে তারা সকলেই অভিযোগ থেকে মুক্ত হলো।

দাঙ্গাবাজদের এমন খালাস পাওয়া নিয়ে বিভিন্ন মহলে ব্যাপক ক্ষোভ তৈরি হয়েছে। অনেকেই এর বিরুদ্ধে মুখও খুলেছেন। সিপিআই(এম) পলিট ব্যুরোর সদস্য সুভাষিনী আলির কথায়, ‘এই হলো সংস্কারী হওয়ার সুবিধা’। বিলকিস বানোর ধর্ষকদের আগাম মুক্তিতে গুজরাট সরকার এমনই যুক্তি দিয়েছিল। বলা হয়েছে, ওই অপরাধীরা সংস্কারী। তাই ওদের ছাড়া হয়েছে। 


২০০২ গোধরা পরবর্তী গণহত্যা পর্বে আমেদাবাদ সিটির এই নারোদা গামে উগ্র-হিন্দুত্ববাদীরা মুসলিম সম্প্রদায়ের ১১জনকে পুড়িয়ে মেরেছিল। নারোদা থানায় দায়ের করা এফআইআর অনুযায়ী, ২৮ ফেব্রুয়ারি নারোদা গাম এলাকার মুসলিম মহল্লা, কুম্ভার বাস এলাকায় হামলা চালিয়ে বেশ কিছু ঘরবাড়িতে আগুন লাগিয়ে দিলে ১১জন মুসলিমের মৃত্যু হয়।

গুজরাট গণহত্যার তদন্তে নিযুক্ত নানাবতী কমিশন বেশ কয়েকজন সাক্ষীকে উদ্ধৃত করে রিপোর্ট দিয়েছিল, ‘মুসলিমরা সেদিন ওখানে পুলিশের থেকে কোনও সাহায্য পায়নি। তাঁদের দুষ্কৃতীদের হাতে ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল। পুলিশ সেখানে সন্ধ্যার পর পৌঁছেছিল। 

বেশ কিছু পুলিশ অফিসারই কমিশনকে জানিয়েছিলেন, তাঁরা নারোদা গামে পৌঁছাতে পারেননি কারণ তাঁরা তখন কাছের নারোদা পাটিয়ার আরও গুরুতর পরিস্থিতি সামলাচ্ছিলেন। একইসঙ্গে হামলা চালিয়ে সেখানে হিন্দুত্ববাদীরা পুড়িয়ে-পিটিয়ে-কুপিয়ে খুন করেছিল ৯৭জন মুসলিমকে।


গণহত্যার সময়ের যে নয়টি বড় ঘটনার তদন্ত করেছে সুপ্রিম কোর্ট নিযুক্ত বিশেষ তদন্তকারী দল (সিট), নারোদা গাম গণহত্যা তারই একটি। এবং বিশেষ আদালতেই এর শুনানি চলছিল। গত ৫ এপ্রিল সওয়াল-জবাব শেষ হয়। এই মামলায় ৮৬জন অভিযুক্ত ছিল। এদের বিরুদ্ধে ভারতীয় দণ্ডবিধির ৩০২ ধারা (খুন), ৩০৭ ধারা (খুনের চেষ্টা), ১৪৩ ধারা (বেআইনি সমাবেশ), ১৪৭ ধারা (দাঙ্গা), ১৪৮ ধারা (মারাত্মক অস্ত্র নিয়ে দাঙ্গা), ১২০ বি ধারা (অপরাধমূলক ষড়যন্ত্র) এবং ১৫৩ ধারা (দাঙ্গার জন্য উসকানি)। ৮৬ অভিযুক্তের মধ্যে ১৮জনের মামলা চলাকালীন মৃত্যু হয়।

একজনকে আগেই আদালত খালাস করে দিয়েছে। যে যে ধারায় অভিযোগ ছিল, সেইসব অপরাধের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড। যদিও ইতিমধ্যেই জামিনে থাকা ৬৭জনকেও এদিন বিশেষ আদালত বেকসুর খালাস করে দিল। 

স্পেশাল প্রসিকিউটার সুরেশ শাহ জানিয়েছেন, ২০১০ সালে মামলার শুনানি শুরু হয়েছিল। দীর্ঘ ১৩ বছরে বাদী বা বিবাদি পক্ষ মিলে আদালতে ২৪৪জনের সাক্ষ্য নেওয়া হয়েছে। চার বছর আগেই যদিও এই মামলার সাক্ষ্যপ্রমাণ পেশ শেষ হয়ে গেছে। মোট ছজন বিচারপতি এই মামলা শুনেছেন।


২০১৭সালের সেপ্টেম্বরে খোদ অমিত শাহ মায়া কোদনানির হয়ে সাক্ষী দিতে হাজির হয়েছিলেন আদালতে। ৬৭ বছর বয়সি মোদীর একসময়ের মন্ত্রী কোদনানির অজুহাত ছিল, তিনি নাকি সেদিন গণহত্যার সময়ে নারোদা গামে ছিলেন না। বরং তিনি ছিলেন গুজরাট বিধানসভায় এবং পরে গিয়েছিলেন সোলা সরকারি হাসপাতালে। এই অজুহাতের সাক্ষ্য প্রমাণ দিতে বর্তমানে দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে আদালতে তলব করার আরজি জানিয়েছিলেন তিনি। 

এবং অমিত শাহ সেই মতো এসে সাক্ষ্য দিয়ে যান, ‘মায়া কোদনানিকে তিনি সেদিন সকাল সাড়ে আটটার সময় বিধানসভায় এবং পরে ১১টা, সওয়া এগারোটা নাগাদ সোলা হাসপাতালে দেখেছেন।’ মায়া কোদনানি খালাস হওয়ার ক্ষেত্রে এই সাক্ষ্য যথেষ্টই গুরুত্ব পেয়েছে বলে তথ্যাভিজ্ঞ মহলের মত। যদিও ২০১৮ সালে সিট বিশেষ আদালতকে বলেছিল, অমিত শাহের সাক্ষ্য মোটেই বিশ্বাসযোগ্য নয়।

 
সাক্ষ্যপ্রমাণ হিসাবে কোদনানি, বজরঙ্গী ও অন্যান্য অভিযুক্তদের মধ্যে ফোন কলের বিস্তারিত পেশ করা হয়েছিল। আদালতকে সাংবাদিক আশিস খেতনের স্টিং অপারেশনের ভিডিওটিও দেওয়া হয়েছিল। সেই ভিডিওতে বাজু বজরঙ্গী বলেছে, ‘যখন আমি একজন মুসলিম মহিলার গর্ভের ভ্রুণকে তরোয়ালের মাথায় তুলে নাচাচ্ছিলাম, আমার নিজেকে মহারানা প্রতাপ মনে হচ্ছিল।’

এই কোদনানিরই ২৮ বছর জেল হয়েছিল নারোদা পাটিয়া গণহত্যায়। কিন্তু গুজরাট হাইকোর্টের রায়ে এখন মুক্ত। এবার ছাড় পেলেন নারোদা গাম গণহত্যা থেকেও। দুই নারোদায় গণহত্যায় চালানোয় পেশায় চিকিৎসক মোদীর এই মন্ত্রীই মূল কাণ্ডারি ছিলেন বলে অভিযোগ। তবে আজ শুধু কান্ডারিই নয় বেকসুর খালাস পেয়ে গেল বাবু বজরঙ্গী সহ গণহত্যার সমস্ত অভিযুক্তই।


রায়ের পর বাইরে যখন ‘জয় শ্রীরাম’ স্লোগান উঠেছে তখন মায়া কোদনানির মন্তব্য, ‘সত্যের জয় হলো। আর নারোদা গামে হিংসার শিকার হয়েছিলেন তাঁদের পরিবারের পক্ষে আইনজীবী শাহশাদ পাঠান জানিয়েছে, এই বেকসুর খালাসের রায়কে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে তাঁরা গুজরাট হাইকোর্টের দ্বারস্থ হবেন। তাঁর কথায়, ‘প্রশ্নটা তো রয়েই গেল, পুলিশের উপস্থিতিতে কারা সেদিন ১১জন মানুষকে পুড়িয়ে মারল?
 

Comments :0

Login to leave a comment