Post Editorial 5 trillion dollar

ভারতের আমজনতা এবং ৫ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলারের কথা

উত্তর সম্পাদকীয়​


ঈশিতা মুখার্জি 
কেন্দ্রের বিজেপি সরকারের মাথা মোদী-শাহের ভাষ্যে দেশের অর্থনীতি গড়গড়িয়ে এগিয়ে চলেছে মার্কিন ডলার ৫ ট্রিলিয়নের দিকে। আর্থিক বৃদ্ধির হারে দেখা গেছে ঊর্ধ্বগতি। এরকম ঊর্ধ্বগতি আগে ছিল না। তাদের ভাষ্যে এমন কথাও থাকছে যে কোভিড পরবর্তী সময়ে ভারত যে ভাবে অর্থনীতিকে পুনরুদ্ধার করেছে, সারা বিশ্বে তা নজর কেড়েছে। সরকারের দেওয়া তথ্যে দেশের আমজনতার সন্দেহ হয়। যে দেশের অর্থনীতি এত এগিয়ে চলেছে, সেই দেশে কেন রেকর্ড হারে বেকারি বাড়ছে? যে দেশে আর্থিক বৃদ্ধির হার সারা বিশ্বে নজরকাড়া, সে দেশ কেন বিশ্ব ক্ষুধার নিরিখে তার প্রতিবেশী দেশগুলির থেকেও পিছিয়ে পড়ে? সরকারি তথ্যে দেশে দারিদ্র কমছে, কিন্তু অন্য পরিসংখ্যানে আমরা জানি যে দেশে আর্থিক বৈষম্য বাড়ছে। তাহলে ৫ ট্রিলিয়ন অর্থনীতির যে স্বপ্ন দেশবাসীকে প্রধানমন্ত্রী এবং তাঁর দলের মন্ত্রীসভা দেখিয়ে চলেছেন, বিশ্ববাসীর কাছে আমাদের দেশের যে আর্থিক উন্নতির কথা শোনা যায়, তার সাথে দেশের আমজনতার যোগাযোগ কোথায়? পরিসংখ্যানের আর্থিক বৃদ্ধি কি দেশের বেশির ভাগ মানুষের কাছে পৌঁছচ্ছে না? নাকি সরকারি পরিসংখ্যানেই গলদ আছে? একথা সঠিক যে দেশের আমজনতা সরকারি পরিসংখ্যান, আন্তর্জাতিক অর্থভাণ্ডার ভারতের আর্থিক বৃদ্ধির হার আগামী বছর কত হবে সে তথ্য নিয়ে মাথা ঘামান না। মানুষের প্রতিদিনের জীবনযাত্রার মাধ্যমে তাঁর পরিচয় হয় দেশের অর্থনীতির সাথে। কিন্তু দেশের নেতা মন্ত্রীরা যখন এই ৫ ট্রিলিয়ন ডলারের কথা বলেন,দেশের মানুষের মনে হয় তাহলে এই আর্থিক বৃদ্ধি নিশ্চয়ই ভবিষ্যতে তাঁদের সমৃদ্ধির মুখ দেখাবে।
দেশের আর্থিক বৃদ্ধি এবং দেশের মোট উৎপাদন বৃদ্ধির যত কথা নেতা মন্ত্রীদের বক্তৃতায় আছে তার ছিটেফোঁটাও চোখে দেখা যায় না দেশে এবং আমাদের রাজ্যেও।২০১৯ সালে প্রধানমন্ত্রী মোদী এই ৫ ট্রিলিয়ন ডলার অর্থনীতির কথা বলেছিলেন। ২০২২-২৩ সালে তা দাঁড়িয়েছে ৩ ট্রিলিয়ন অর্থনীতির দোরগোড়ায়। তাহলে ২০২৪ সালে দেশ যখন লোকসভা নির্বাচনের মুখে দাঁড়িয়ে, ২০১৯ সালের নির্বাচনের আগের মত আবারও ফিরে এসেছে ৫ ট্রিলিয়ন ডলারের অর্থনীতির কথা। কবে হবে? স্পষ্ট উত্তর দিয়েছেন দেশের শাসকগোষ্ঠী ২০২৫-২৬ সালে, অর্থাৎ লোকসভা নির্বাচনের পরে। তাঁরা জানিয়েছেন আগামী দশকের মধ্যে দেশ বিশ্বে সবচেয়ে আগুয়ান অর্থনীতি হবে। বর্তমানে দেশে যে পদ্ধতিতে আর্থিক বৃদ্ধি পরিমাপ করছে, তা নিয়ে দেশের অর্থনীতিবিদদের দ্বিমত আছে। তাঁরা বলেন যে এই পরিমাপের ভিত্তি যথাযথ নয়। তা ২০১১-১২ সালকে ভিত্তিবর্ষ ধরে হিসেব করা এবং তাই মুদ্রাস্ফীতির হারের প্রভাবকে কমিয়ে দেখানো হয়েছে। কিন্তু যদি তর্কের খাতিরে ধরেও নিই আমরা যে কেন্দ্রের সরকার সঠিক পরিসংখ্যান দিচ্ছেন, এই পরিসংখ্যানের পিছনে নিশ্চয়ই দেশের মানুষ প্রশ্ন করতে পারেন এই অসম্ভব অবস্থা কিভাবে হল এবং আগামী দিনে এই ভবিষ্যতবাণী কিভাবে ফলবে? রাজ্যসভায় এই মর্মে এক প্রশ্নের উত্তরে নানা সময়ে কেন্দ্রীয় সরকারের মন্ত্রীরা উত্তর দিয়েছেন যে এই আর্থিক বৃদ্ধি সম্ভব দেশে বিনিয়োগ বৃদ্ধি করে এবং ডিজিটাল অর্থনীতির সম্প্রসারণের মাধ্যমে। 
দেশে বিনিয়োগ এবং ডিজিটাল অর্থনীতির বর্তমান চেহারা কিন্তু এই আশার কথা আদৌ বলছে না।গোল্ডম্যান স্যাক্স নামে একটি সংস্থাও বলছে যে আর্থিক বৃদ্ধি সম্ভব বেসরকারি বিনিয়োগ বৃদ্ধি পেলে।কেমন বেড়েছে বেসরকারি বিনিয়োগ ২০২৩ সালের বিভিন্ন মাসে? ২০২৩ সালের প্রথম তিন মাসেই চোখে পড়ে যে বেসরকারি বিনিয়োগ কমছে। ২০২৩ সালের শেষের দিকে দেখা যাচ্ছে যে কর্পোরেট বিনিয়োগও কমছে। বেসরকারি মুনাফা বাড়ছে; কর্পোরেট মুনাফা বাড়ছে, কিন্তু অন্তত ভারতের মাটিতে তাদের বিনিয়োগ চোখে পড়ার মত নয়।কনফেডারেশন অব ইন্ডিয়ান ইন্ডাস্ট্রিস জানাচ্ছে যে দেশের অভ্যন্তরে চাহিদা না বৃদ্ধি করলে আর্থিক বৃদ্ধি বা বিনিয়োগ সেভাবে সম্ভব নয়। রপ্তানির উপর দেশের নির্ভরতা দেশের অর্থমন্ত্রী ঘোষণা করলেও দেশের বৈদেশিক বাণিজ্যে ঘাটতি রেকর্ড মাত্রা ছুঁয়েছে ২০২৩ সালের জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর মাসে। অর্থাৎ আমাদের দেশের পণ্য এবং পরিষেবার বিদেশে চাহিদা নেই সেভাবে।রপ্তানি নির্ভর আর্থিক উন্নতির কথা ভাবার দিন শেষ এখন। কোভিডের সময়ের আগে থেকেই বিশ্ব পুঁজিবাদের সঙ্কট সব দেশকেই তাদের নিজেদের অর্থনীতির উপর ভিত্তি বাড়াতে হচ্ছে। বিশ্ব পুঁজিবাদে সঙ্কট যত বেড়েছে, তত দেশে দেশে বাণিজ্য বোঝাপড়াও কমেছে। বিশ্বায়নের নীতির কুফল বুঝতে পারছে উন্নত, উন্নয়নশীল সব দেশগুলি। তাই নিজেদের অর্থনীতির ভিত শক্ত করতে চাইছে তারা। দেশের মানুষের চাহিদা বৃদ্ধির দিকে পৃথিবীর দেশগুলি নজর দিচ্ছে। আমাদের দেশে রপ্তানি কমে আসছে দ্রুত হারে। ২০১৩-১৪ সালে মোট জাতীয় উৎপাদনের ২৫% ছিল রপ্তানি। ২০২২-২৩ সালে তা নেমে এসেছে ২২.৮% এ। নয়া উদারীকরণ নীতির প্রবক্তা অর্থনীতিবিদেরাই বলতে শুরু করেছেন যে আমাদের দেশকে দেশের মানুষের চাহিদার উপর নির্ভর করতে হবে। আমাদের টাকার অবমূল্যায়ন ঘটছে সমানেই। দেশের ভিতরে মুদ্রাস্ফীতি ক্রমাগতই বাড়ছে।টান পড়েছে খাদ্যসুরক্ষায় কারণ খাদ্যপণ্যের দাম ঊর্ধ্বমুখী।যেটুকু আর্থিক বৃদ্ধি চোখে পরিসংখ্যানের নিরিখে দেখা যাচ্ছে, তার কারণ সরকারের মুলধনী ব্যয় বৃদ্ধি। 
দেশে রেকর্ড হারে বেকারি জানিয়ে দিল সিএমআইই । ডিসেম্বর মাসে বেকারির হার ছুঁল ৮.৩% যা গত ১৬ মাসে সবচেয়ে বেশি। কাজেই এটা স্পষ্ট যে দেশের মানুষের আয় কমছে।মূল্যবৃদ্ধির হার কমানো যাচ্ছে না। মনরেগায় বাজেট বরাদ্দ কমার ফলে গ্রামে মানুষের কাজ নেই, আয় নেই।গ্রাম ছেড়ে মানুষ পরিযায়ী শ্রমিক হয়ে বেরিয়ে পড়েছে কাজের খোঁজে। শহরে কি কাজ আছে?শহরে কাজের ক্ষেত্র হল কারখানায় কাজ। শিল্প কারখানায় দেশে মোদী শাসনে ২০১৭ সালের পর থেকে ক্রমাগতই কমেছে। ২০১৭ সালে দেশে শিল্পকারখানায় নিযুক্ত ছিল ৫কোটি ১৩ লক্ষ শ্রমিক। ২০১৯ সালে তা কমে হল ৪কোটি ৬ লক্ষ। ২০২৩ সালে তা দাঁড়িয়েছে ৩কোটি ৫৬ লক্ষে। শিল্প কারখানায় কাজ কমছে ক্রমাগতই। পরিসংখ্যান দেখলে যেমন দেশের আর্থিক বৃদ্ধির কথা বলা যায়, সেই সরকারি পরিসংখ্যান দেখলে দেশে বেকারির এই চিত্রও দেখা যায়।কর্মসংস্থান বাড়ানোর জন্য নিঃসন্দেহে প্রয়োজন আর্থিক বৃদ্ধি।কিন্তু এই মুহূর্তে আমাদের দেশে  খাতায় কলমে আর্থিক বৃদ্ধি হলেও কর্মসংস্থানের কোনও কথা নেই। এই আর্থিক বৃদ্ধির ভিত্তি তো দেশের উৎপাদন বৃদ্ধি নয়। সরকারি তথ্য পিরিয়ডিক লেবার সার্ভে রিপোর্ট ২০২২-২৩ জানাচ্ছে যে কৃষি থেকে ৪৫.৮ % শ্রম অকৃষিক্ষেত্রে কাজের খোঁজ করছেন। সুতরাং আর্থিক বৃদ্ধি যদি অকৃষিক্ষেত্রে কর্মসংস্থান করতে না পারে, তাহলে এই বৃদ্ধি আমজনতার জীবন-জীবিকায় কোনও কাজে আসবে না। আমাদের দেশে এমনটাই ঘটছে। 
আর্থিক বৃদ্ধির সাথে সঙ্গতিহীন আরও একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা ঘটছে আমাদের দেশে। দেশের পরিবারগুলির আর্থিক সঞ্চয় এবং সম্পদের পরিমাণ কমছে। অন্যদিকে অনেক বেশি পরিবার ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়েছে। ক্ষুদ্র ঋণসংস্থার চাপে আত্মহত্যা করতেও বাধ্য হচ্ছে অনেক মানুষ। ২০২৩ সালে দেশের মানুষের ঋণগ্রস্ততা গত বছরের তুলনায় দ্বিগুণ হয়েছে। এগুলি সরকারি পরিসংখ্যান। তাই এর মধ্যে মহাজনের কাছ থেকে ঋণ বা ক্ষুদ্র ঋণসংস্থার কাছ থেকে ঋণের কোনও হিসেব নেই।আর্থিক বৃদ্ধির ফলে দেশের শ্রমজীবী, কৃষিজীবী মানুষের মজুরি তো বৃদ্ধি পায়নি, বরং মজুরি ক্রমাগতই কমে এসেছে।খাদ্যপণ্য এবং নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্যবৃদ্ধির হার এতই বেশি যে প্রকৃত মজুরি ক্রমাগতই কমে এসেছে এ দেশে। কৃষক-শ্রমিক আত্মহত্যা ঘটেই চলেছে এ দেশে। 
তাহলে এই আর্থিক বৃদ্ধির সুফল পেল কারা? আর্থিক বৃদ্ধির সুফল নিশ্চিতভাবেই পেয়েছে কর্পোরেট গোষ্ঠী যাঁদের মুনাফা বেড়েছে। মজুরি কমেছে, মুনাফা বেড়েছে এবং এই বৃদ্ধির মধ্যে মুনাফার অংশ বেশি। দেশে কোভিডের সময়েও কোটিপতির সংখ্যা এবং তাদের সম্পদ দুইই বেড়েছে। দেশের সাধারণ পরিবারগুলির সম্পদ কমেছে এই কয় বছরে এবং কোটিপতিদের সম্পদ বেড়েছে-সরকারি পরিসংখ্যানেই এই কথা প্রমাণিত। 
দেশের সরকার অবশ্য আগামী দিনে অর্থাৎ লোকসভা নির্বাচনের পরে আর্থিক বৃদ্ধির গ্যারান্টি হিসেবে ডিজিটাল অগ্রগতির কথা সামনে এনেছে। কিন্তু ২০২২ সালের অক্সফ্যাম রিপোর্ট আমাদের জানিয়েছে যে আমাদের দেশে ডিজিটাল বৈষম্য অনেক বেশি। এই বৈষম্য খারাপ থেকে অতি-খারাপের দিকে যাচ্ছে। এছাড়াও দেশে নানাধরনের সামাজিক বৈষম্য আর্থিক বৈষম্যকে বাড়িয়ে দিয়েছে। রয়েছে গ্রাম-শহর বৈষম্য, রয়েছে জাতপাতের বৈষম্য, রয়েছে লিঙ্গ বৈষম্য। ঐতিহাসিক ভাবে এই বৈষম্য আরও বেশি বৈষম্যে রূপান্তরিত হচ্ছে। তাই দেশের সরকার বড়াই করে বললেও ইন্টারনেট সকলের কাছে পৌঁছানোর কোনও ব্যবস্থা সরকার করেনি। তাহলে এই ডিজিটাল অর্থনীতিতে আমাদের দেশের আমজনতার স্থান কোথায়?
দেশ এগচ্ছে হাতে গোনা কয়েকজন মানুষের জন্য, কিন্তু দেশের বেশির ভাগ মানুষের প্রতিদিনের বেঁচে থাকার সাথে তার সম্পর্ক নেই এ কথা বললেও কম বলা হবে। দেশের বেশির ভাগ মানুষের সাথে এই আর্থিক বৃদ্ধির ঠিক উল্টো সম্পর্ক। আর্থিক বৃদ্ধি যত দেখিয়ে বড়াই করবে সরকার, তত বেশি দেশে বাড়বে বেকারি, অনাহার, দারিদ্য, বৈষম্য।

Comments :0

Login to leave a comment