RAHUL GANDHI

উপহাস উপেক্ষা করে বাজিমাত সেই রাহুলেরই

জাতীয় লোকসভা ২০২৪

‘পাপ্পু’, ‘শাহজাদা’ যে ‘শের’ হয়ে যাবে কল্পনাই করেননি মোদী-শাহরা! আর নানা ভাবে রাহুল গান্ধীকে অপদস্ত করার প্রশ্নে সর্বক্ষণ তাঁদের লেজুড় ছিল ‘গোদী মিডিয়া’ অথবা বিজেপি’র আইটি সেল। লোকসভা ভোটের ফল বেরনোর পর এই গোটা বাহিনীরই অন্তত মুখ লুকানোর জায়গা থাকা উচিত নয়। কংগ্রেস নেতা প্রমাণ করে দিয়েছেন এবারের ভোটে তিনিই ‘বাজিগর’, তাঁকে উপহাস বা কটাক্ষ করে লাভের লাভ কিছুই হলো না। ধর্মীয় জিগির, বুলডোজার কিংবা মন্দির রাজনীতির অভিমুখের বদলে কীভাবে সংবিধান, গণতন্ত্র, গরিব মানুষ, কৃষকের সঙ্কট, শ্রমিকের দুর্দশা ভোটের ইস্যু হতে পারে— তা আবার চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলেন তিনি। একারণেই তিনি জোর গলায় বলতে পারেন, ‘দেশের গরিব মানুষ সগর্বে জানিয়ে দিয়েছে যে, তারা মোদীকে চায় না, শাহকেও চায় না।’ মঙ্গলবার সাংবাদিক সম্মেলনেও মোদীদের বড় ধরনের ধাক্কা দেওয়ার জন্য স্বভাবসিদ্ধ বিনম্রতার সঙ্গে অভিনন্দন জানালেন গরিব ভারতবাসীকে।
কীভাবেই না হেনস্তা করা হয়েছে তাঁকে! নেতাদের নানা ধরনের তির্যক মন্তব্যই শুধু নয়, বিজেপি’র আইটি সেলের তৈরি করা রাহুলকে নিয়ে কদর্য ‘মিম’-ও প্রচার করা হতো ঢালাওভাবে। অত্যন্ত সাধারণ এক অভিযোগের ভিত্তিতে তাঁর সাংসদ পদ পর্যন্ত কেড়ে নেওয়া হয়েছিল। সাংসদ পদ যাওয়ার অজুহাতে তাঁকে ‘ঘরচ্যুত’-ও করা হয়েছিল। রাহুল সহ গোটা গান্ধী পরিবারকে নিশানা করাই অভ্যাস করে ফেলেছিলেন মোদী। কিন্তু রাহুল গান্ধী এসবকে গুরুত্ব না দিয়ে নিজের লক্ষ্যে কাজ করে গিয়েছেন সমানতালে। পালটা আক্রমণে না গিয়ে রাজনীতিতে ধীরে ধীরে জ্বলন্ত ইস্যুকে সামনে তুলে এনেছেন, প্রথম কোনও কংগ্রেসের নেতা হিসাবে আঘাত হানতে দ্বিধা করেননি মোদী-ঘনিষ্ঠ কর্পোরেটদের বিরুদ্ধে। তীব্র ভাষায় বিঁধেছেন মোদীর ‘তানাশাহী’-কেও।
সূত্রপাত অবশ্যই ‘ভারত জোড়ো যাত্রা দিয়ে’। কন্যাকুমারী থেকে কাশ্মীর পর্যন্ত পদযাত্রা করলেন ‘দেশ বাঁচানোর’ স্লোগান তুলে। বললেন, দেশের সামনে এখন মূল লড়াই হলো ‘ভারত জোড়ো’ মতাদর্শের সঙ্গে ‘ভারত তোড়ো’ ভাবনার। দেশের মানুষের প্রকৃত সমস্যার কথা তুলে ধরলেন গোটা যাত্রাপথে। বার বার বলার চেষ্টা করেছেন, মোদীরা ধর্মীয় মেরুকরণের মধ্যে দিয়ে দেশের বিভাজন চান। এজন্যই ভারতকে জুড়তে তিনি পদযাত্রায় বেরিয়েছেন। পথে বহু মানুষের সঙ্গে মেলামেশা করেছেন, তাঁদের কথা শুনেছেন মনোযোগ দিয়ে। ব্যাপক সাড়া পেলেন গোটা যাত্রাপথে। ভারত জোড়ো যাত্রা তাঁর চারিত্রিক অনেক বদল ঘটিয়েছে বলেও স্বীকার করেছিলেন রাহুল গান্ধী। পদযাত্রার ফাঁকে একবার হালকা ছলেই তিনি বলেছিলেন, ‘‘এখন তিনি আগের চেয়ে অনেক বেশি ধৈর্যশীল হয়ে উঠেছেন। অনেক মন দিয়ে ঠান্ডা মাথায় শুনছেন মানুষের কথা। আট ঘণ্টা ধরে ব্যস্ত থাকলে এখন আমি মোটেই রেগে যাই না। আগে দু’ঘণ্টাতেই ভীষণ রেগে যেতাম। আবার আগের চেয়ে অনেক ধৈর্য সহকারে মানুষের কথা শুনছি। যা আমাকে অনেক বেশি ঋদ্ধ করছে।’’ এই ধৈর্যশীল রাহুলের কাছেই রাজনৈতিক মারপ্যাঁচে হার মানতে বাধ্য হলেন মোদী। গোটা নির্বাচনী প্রচারপর্বে মোদী-শাহ সহ বিজেপি নেতারা রাহুল গান্ধীকে তাঁর পরিবার এবং ব্যক্তিগতভাবে আক্রমণ করলেও তিনি পালটা জবাব না দিয়ে উলটে দেশের সামনে এখন যেসব প্রকৃত ‘মুদ্দা’, তাই বারংবার বলে এসেছেন ধৈর্য সহকারে।
আসলে তিনি যে জনগণের থেকে উঠে এসেছেন এটাই প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করে গিয়েছেন অহরহ। পদযাত্রায় যেমন মানুষের সঙ্গে মিশে হেঁটেছেন, তেমনই ট্রাক চালকদের দুঃখের কথা শোনার জন্য রাতে উঠে পড়েছেন ট্রাকেও। তাঁকেই কখনও দেখা গিয়েছে কুকুরছানাকে আদর করতে, রাস্তায় নেমে একে তাকে জড়িয়েও ধরতে।
শুধু ভারত জোড়ো যাত্রায় রাহুল গান্ধী দেশের দক্ষিণ প্রান্তকে মুড়েছিলেন উত্তরের সঙ্গে। বেশ কিছুদিন বিরতির পর লোকসভা ভোটের আগে দেশের পূর্ব অংশের সঙ্গে পশ্চিম অংশ জুড়ে দিতে তিনি বের হন ‘ভারত ন্যায় যাত্রা’য়। এবারও মানুষ তাঁকে দু’হাত তুলে আশীর্বাদ করলেন। বার বার বলে গেলেন, তিনি দেশের সংবিধান এবং গণতন্ত্র রক্ষার লড়াইয়ে নেমেছেন। রামমন্দির নির্মাণের পাশাপাশি মোদীরা যত ধর্মের জিগির তুলে বিরোধীদের বিঁধতে চেয়েছেন, রাহুল গান্ধী ততবার বেকারত্ব, মূল্যবৃদ্ধি, সংরক্ষণ, সংবিধান রক্ষার লড়াই বলে পালটা চাল দিয়েছেন। নির্বাচনী সভাগুলিতে নিয়ম করে হাতে সংবিধান তুলে ধরে বলতেন, ‘মোদীরা ক্ষমতায় এলে সংবিধানই আর রাখবে না। দেশের দলিত, আদিবাসী, পিছিয়ে পড়া সম্প্রদায় বঞ্চিত হবেন সংরক্ষণ থেকে।’ প্রচারে তুলে ধরেছেন রুটি রুজির কথা। কংগ্রেস এবার অনেক বেশি নমনীয়তা দেখিয়ে বিরোধীদের নিয়ে ‘ইন্ডিয়া’ মঞ্চ গড়ে তুলে মোদীদের বিরুদ্ধে লড়ছে। এব্যাপারেও রাহুল গান্ধী গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। কংগ্রেস এবার ৫৪৩-র মধ্যে ৩২৮ আসনে লড়াই করে ইন্ডিয়া মঞ্চের অন্য দলগুলির জন্য ছেড়ে দিয়েছে ২১৫ আসন। মোদীকে হারানোই পাখির চোখ করেছিল কংগ্রেস, ভারত জোড়ো যাত্রার মধ্য দিয়ে যে সূত্র বেঁধে দিয়েছিলেন রাহুল গান্ধীই। হয়তো সম্পূর্ণ সফল হননি রাহুল, কিন্তু ‘মোদী মিথ’-কে বড় ধাক্কা দিতে পেরেছেন বলাই যায়।
লোকসভা ভোটের প্রচারে সারা দেশ চষে বেড়িয়েছেন। একটার পর একটা সভা করেছেন। একই সঙ্গে কেরালার ওয়েনাড এবং উত্তর প্রদেশের রায়বেরিলি থেকে লড়াই করে দু’টো আসনেই জয় হাসিল করে নিয়েছেন। তার মধ্যে রায়বেরিলিতে জিতেছেন রেকর্ড ব্যবধানে। একজন সেনাপতি হিসাবে যেভাবে সামনে থেকে লড়াই চালানো উচিত, সেভাবেই লড়েছেন। সেই লড়াইয়ে শামিল করে নিয়েছেন দেশের অধিকাংশ বিরোধী শক্তিকে।
তাঁর সভায় ভিড় উপচে পড়তে দেখা গিয়েছে। বার বার হাতে লাল মলাটের সংবিধানের প্রতিলিপি তুলে ধরে রক্ষার আহ্বান জানিয়েছেন দেশবাসীকে। জনগণও তাঁর আহ্বানে পুরো না হলেও ভালোমতোই সাড়া দিয়েছে। 
 

Comments :0

Login to leave a comment