Post Editorial

২৮ নভেম্বর রাজভবন চলো

উত্তর সম্পাদকীয়​


সুভাষ মুখোপাধ্যায়
নভেম্বর মাস— বিপ্লবের মাস। নভেম্বর বিপ্লবের শিক্ষাকে আমাদের দেশের বর্তমান বাস্তব পরিস্থিতিতে প্রয়োগ করার কাজ এবং চর্চার মধ্যে আমরা আছি। এই সম্পর্কিত বিভিন্ন চিন্তা পথ নিয়ে ধারাবাহিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ লেখা গণশক্তি পত্রিকা সহ অন্যত্র প্রকাশিত হয়ে চলেছে। দে‍‌শের বর্তমান পরিস্থিতিতে শ্রমিকশ্রেণির দায়িত্ব গুরুত্বপূর্ণ। শ্রমিকশ্রেণির নেতৃত্বেই দেশের কেন্দ্রে আসীন স্বৈরতান্ত্রিক সরকারের বিরুদ্ধে, ধর্মীয় ফ্যাসিবাদী শক্তির বিরুদ্ধে পরিস্থিতি পরিবর্তনের লক্ষ্যে শ্রমিকশ্রেণি কাজ করে চলেছে।
দুনিয়ার প্রথম সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব পুঁজিবাদী ব্যবস্থাকে চূর্ণ করে শ্রমিকশ্রেণির নেতৃত্বে রাষ্ট্র গঠন প্রমাণ করেছিল ধনতন্ত্র-সাম্রাজ্যবাদ শ্বাসত নয়— অজেয় নয়। রাশিয়ার নভেম্বর বিপ্লব সংগঠিত হবার প্রধান উপাদান ছিল শ্রমিকশ্রেণি ও কৃষক সমাজের মৈত্রী। তারই সঙ্গে রুশ দেশে ‍‌বিভিন্ন প্রান্তে বিভিন্ন অংশের মানুষের সংগ্রাম আন্দোলনগুলিকে একত্রিত করে নিপীড়িত জনগণের সার্বিক ঐক্য তুলেছিলেন কমরেড লেনিন, যা মানুষের সংগ্রাম ও সচেতনতাকে বিপ্লবের স্তরে উন্নীত করেছিল।
বর্তমান বিশ্ব পুঁজির সঙ্কটে আতঙ্কিত পুঁজিবাদ এখন নয়া উদার একচেটিয়া লুটেরা পুঁজির রাজত্ব কায়েম করছে বিশ্বজু‍‌ড়ে। নয়া ফ্যাসিবাদ বিস্তার লাভ করছে পৃথিবীর দেশে দেশে। আমাদের দেশ তার ব্যতিক্রম নয়। গত দশ বছরে নরেন্দ্র মোদীর প্রধানমন্ত্রিত্বে দেশের বি‍‌জেপি সরকারের কাজ ও নীতি গ্রহণের মধ্যে ফ্যাসিবাদী লক্ষণগুলোই প্রকটভাবে প্রতীয়মান হয়ে চলেছে। সংসদীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ও অধিকার, ট্রেড ইউনিয়ন অধিকার, সংবিধান প্রদত্ত মৌলিক অধিকার ধ্বংস করাই ফ্যাসিবাদের কাজ। আমাদের দেশে ঠিক তেমনটাই ঘটে চলেছে। লগ্নিপুঁজি ও একচেটিয়া লুটেরা পুঁজির নির্লজ্জ পৃষ্ঠপোষকতা করে চলেছে এই সরকার।
বর্তমান সময়ে উৎপাদক সব অংশই আক্রান্ত। উৎপাদন করে কৃষক, গ্রামে উৎপাদনের সঙ্গে যুক্ত খেতমজুরগণ এবং শিল্প সহ সমাজের অন্যান্য ক্ষেত্রের প্রধান উৎপাদক শ্রমিক, শ্রমজীবী মানুষ। এই তিনটি অংশকেই কবজা করে‍ছে পুঁজিবাদ বা বর্তমান উদার বাজার অর্থনীতি। এই তিন অংশের উৎপাদক মানুষ ভয়ঙ্করভাবে আক্রান্ত। এরা আক্রান্ত হলে সমাজের কোনও অংশই ভালো থাকতে পারে না। সর্বগ্রাসী লুটেরা পুঁজি তথা ধান্দার ধনতন্ত্রের থাবায় ঘটছেও তাই। এরই সঙ্গে ব্যাপকভাবে দেশের মৌলিক শিল্প সংস্থা প্রতিষ্ঠান, দেশের সম্পদ বেসরকারিকরণের কাজ করে চলেছে দেশের ও আমাদের রাজ্যের সরকার।
এ সবের বিরুদ্ধে শ্রমিক, কৃষক, খেতমজুর, কর্মচারীদের পৃথক পৃথক বড় বড় সংগ্রাম নিজ নিজ দাবিতে রাষ্ট্রীয় সম্পদ রক্ষা ও নিজ অধিকার রক্ষার জন্য ধারাবাহিক সংগ্রাম জারি রেখেছে দেশজু‍‌‍‌ড়ে। বর্তমানে প্রয়োজন এই সমস্ত সংগ্রামগুলিকে সংযুক্ত করে আক্রান্ত সব অংশের মানুষের ঐক্যবদ্ধ প্রতিবাদ প্রতিরোধের সংগ্রাম গড়ে তুলে স্বৈরতান্ত্রিক সরকারকে বড় ধাক্কা দেওয়া। দেশের বর্তমান অর্থনৈতিক নীতির আমূল পরিবর্তন ব্যতিরেকে দেশ ও দেশের মানুষের বাঁচার কোনও উপায় নেই। ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের মধ্য দিয়েই তেমন প‍‌রিস্থিতি প্রস্তুত করা সম্ভব। ট্রেড ইউনিয়নগুলি, কৃষক ও খেতমজুর সংগঠন সমূহ এবং কর্মচারীদের সংগঠনগুলি পারস্পরিক মৈত্রী গড়ে তুলতে দীর্ঘদিন চেষ্টা করে যাচ্ছিল। পরিস্থিতির প্রয়োজনে ট্রেড ইউনিয়নগুলির যুক্ত মঞ্চ, কৃষক খেতমজুরদের সংযুক্ত মোর্চা, ট্রেড ইউনিয়ন মঞ্চের সঙ্গে কর্মচারী সংগঠনগুলি যুক্ত হয়ে নিজ নিজ পর্যায়ে ধর্মঘট, সাধারণ ধর্মঘট, বছরভর ঐতি‍‌হাসিক কৃষক অবস্থান সংগঠিত করেছে। এখন সময় এই সব শক্তিগুলির সার্বিক ঐক্যের ও ব্যাপক সংগ্রামের। তার প্রথম প্রতিফলন ঘটেছে গত ৫ এপ্রিল দিল্লিতে শ্রমিক, কৃষক, খেতমজুরদের সংগঠনের ঐতিহাসিক সমাবে‍‌শের মধ্য দিয়ে। সার্বিক ঐক্য প্রচেষ্টার ধারাবাহিকতা নভেম্বর বিপ্লবের শিক্ষাকে সামনে রেখে বাস্তবায়িত করা সম্ভব হয়েছে দেশের সমস্ত কৃষক সংগঠনের সংযুক্ত মোর্চা, কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়ন সমূহের যুক্ত মঞ্চ এবং কর্মচারীদের বিভিন্ন ফেডারেশনের যৌথ কনভেনশন। সেই কনভেনশন থেকে সরকারের বিশ্বাসঘাতকতার বিরুদ্ধে দেশব্যাপী প্রতিবাদ আন্দোলন শেষে সাধারণ মানুষের জীবনজীবিকা রক্ষার দাবি সহ নির্দিষ্ট দাবিতে সারা দেশে ২৬-২৭-২৮ নভেম্বর অবস্থান এবং ২৮ নভেম্বর সব রাজ্যে রাজভবন অভিযান ও রাজ্যপালের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রীর কাছে স্মারকলিপি প্রদানের কর্মসূচি ঘোষিত হয়েছে।
সমাজের উৎপাদক এবং গুরুত্বপূর্ণ অংশের এই ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন সংগ্রামের নতুন ইতিবাচক দিক উন্মোচিত করছে। আগামী ২৮ নভেম্বর আমাদের রাজ্যে লক্ষাধিক মানুষের সমাবেশ ‘রাজভবন চলো’ কর্মসূচিকে সফল করতে প্রস্তুত হচ্ছে। আক্রান্ত অন্য অংশের মানুষ সংগ্রামের পথেই আছেন। রাজ্যজুড়ে চলছে যৌবনের ‘ইনসাফ যাত্রা’— নারী সমাজ তাদের দাবিতে রাস্তায় আন্দোলনে। ‘রাজভবন চলো’ কর্মসূচি এই সমস্ত সংগ্রামরত অংশকে এক সূত্রে গ্রথিত করে কেন্দ্র এবং রাজ্য সরকারকে অত্যাচারের জবাব দিতে প্রস্তুতির অনুঘটকের কাজ করবে। আক্রান্ত সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশের মানুষকে ঐক্যবদ্ধ ও সংগঠিত করার শ্রমিকশ্রেণির যথাযথ দায়িত্ব পালনে এই রাজভবন অভিযান কর্মসূচি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি ধাপ।
আমাদের দেশের বর্তমান সরকারের সমস্ত নীতি ও সিদ্ধান্ত দেশ ও দেশের মানুষের স্বার্থবিরোধীই শুধু নয়, এ‍‌ই সরকারের সমস্ত আচরণে ফ্যাসিবাদের সব লক্ষণগুলো‍‌ই দেখা যাচ্ছে। আগামী বছর নির্বাচনে আরএসএস নিয়ন্ত্রণাধীন এই ভয়ঙ্কর শক্তি পুনর্বার ক্ষমতায় আসার সুযোগ পেলে একথা ধরে নেওয়াই যায় যে গোটা দেশের সর্বনাশ হবে শুধু নয়, ইতালির ফ্যাসিস্ট মুসোলিনীর কট্টর সমর্থক আরএসএস দেশে ফ্যাসিবাদ প্রতিষ্ঠায় ভয়ঙ্করভাবে সক্রিয় হবে।
ইতিহাসের শিক্ষা হলো যে ফ্যাসিবাদ রাষ্ট্র শক্তি দখল করেই থেমে থাকে না— দমনপীড়ন ছাড়াও লগ্নিপুঁজির তথা ধান্দার ধনতন্ত্রের পৃষ্ঠপোষক এই শক্তি সব সময় একটা সংখ্যলঘু অংশকে শত্রু হিসাবে চিহ্নিত করে তাদের উপর চরম বিরোধিতা এবং নির্মম ব্যবহার করে সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ থেকে বিচ্ছিন্ন করে। আর সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশকে ধর্মীয় উন্মাদনা সৃষ্টি করে একদিকে নিজেদের ভোট ব্যাঙ্ক তৈরি করে অন্যদিকে বি‍‌ভেদের বীজ বপন করে আক্রান্ত মানুষকে ঐক্যবদ্ধ হবার কাজ বিঘ্নিত করে।
বর্তমানে আমাদের দেশ আমাদের রাজ্যের দিকে নজর দিলে এ‍‌ই সমস্ত প্রবণতাগুলি প্রত্যক্ষ করা যাবে। মানুষের দৈনন্দিন জীবনযাপন যত কঠিনতর হয়ে পড়বে ততই সেই বিষয়গুলি আড়াল করে ধর্মীয় উন্মাদনা সৃষ্টি করা হবে যা সমস্ত প্রচারমাধ্যমকে দিকে ব্যাপক প্রচার করানো হবে। সেজন্য দেশের প্রায় সব সংবাদমাধ্যমকে নিজেদের কব্জায় নেওয়ার কাজ সম্পন্ন করা হয়েছে অনেক আগেই।
আমাদের রাজ্য সরকার ব্যস্ত উৎসব, দীর্ঘসময় ধরে দুর্গাপূজা, দুর্গাপূজার কার্নিভাল আর কেন্দ্রের ব্যস্ত রামমন্দির নির্মাণকে আসন্ন লোকসভা নির্বাচনে ব্যবহার করতে। বিজেপি’র পোস্টার বয় যোগী আদিত্যনাথ অন্য রাজ্যের ভোট প্রচারে গিয়ে দাবি করছেন — বিজেপি’কে জয়ী করুন — নির্বাচিত বিধায়করা আপনাদের রামমন্দির দর্শন করাতে নিয়ে যাবে। ভাবা যায়? একটা ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রে এই প্রচার যখন দেশের সব সম্পদ লুট হচ্ছে, কাজ নেই, শ্রমের মূল্য কমছে কৃষকের আত্মহত্যা বাড়ছে, ব্যাপকভাবে বাড়ছে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম— সে সব কিছু নয়— শুধু ধর্মের নামে ভোট।
এই সবের বিরুদ্ধে যেমন মানুষের ঐক্য গড়ে তুলতে হবে তেমনি বিভ্রান্ত মানুষকে সচেতন করতে হবে। জীবনজীবিকার আশু দাবির আন্দোলনে তাদের শামিল করতে হবে। এ‍‌ই সমস্ত কাজই জরুরী এবং এই মুহূর্তে অবশ্য করণীয় বিষয়।
সংযুক্ত কিষান মোর্চা ও ট্রেড ইউনিয়ন সংগঠন সমূহ, কর্মচারী সংগঠনগুলির যৌথ আহ্বানে রাজভবন অভিযানে যে দাবিগুলিকে আশু দাবি হিসাবে সামনে রাখা হয়েছে সেগুলি হলো —
ফসলে ন্যূনতম সহায়ক মূল্য গ্যারান্টি আইন-প্রণয়ন করতে হবে।
১০০ দিনের কাজ চালু করতে হবে— বকেয়া মজুরি দিতে হবে।
বিদ্যুৎ আইন সংশোধনী বিল ও স্মার্ট মিটার বাতিল করো।
রাষ্ট্রীয় সম্পদ বেসরকারি লুটেরাদের হাতে তুলে দেওয়া চলবে না।
শ্রমকোডের নামে শ্রমিকের অর্জিত অধিকার কেড়ে নেওয়া চলবে না।
দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি রোধ করতে হবে।
কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে।
অসংগঠিত ও সকল ক্ষেত্রের শ্রমজীবী মানুষের জীবন ও কাজের নিরাপত্তা এবং পর্যাপ্ত সামাজিক সুরক্ষা দিতে হবে।
এই আশু দাবিগুলির ব্যাপক প্রচার শেষে ২৮ নভেম্বর রাজভবন অভিযান তৃণমূল কংগ্রেস এবং বিজেপি’র কৌশলী দ্বৈরথ সৃষ্টির  চেষ্টার মুখোশ খুলে দিতে যেমন সাহায্য করবে তেমনই সাধারণ মানুষকে আসল শত্রু চিনতে সাহায্য করবে। মানুষের মধ্যে আস্থার সৃষ্টি করবে।
রাভবন অভিযান কর্মসূচি গড়ে ওঠা সব অংশের আক্রান্ত মানুষের ঐক্যকে যেমন শক্তিশালী করবে ঠিক তেমনভাবেই সেই ঐক্য মজবুত এবং সরকারকে আঘাত হানার যোগ্য করে তুলবে ও ঐক্যের বিপ্লবী মিলন ঘটাতে সক্ষম হবে।
সংসদীয় ব্যবস্থার মধ্য দিয়েই ফ্যাসিবাদী শক্তি ফ্যাসিবাদ কায়েম করতে সচেষ্ট তখন সংসদীয় ব্যবস্থার মধ্য দিয়েই বর্তমান স্বৈরাচারী কেন্দ্রের সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করতে হবে। দেশের বর্তমান পরিপ্রেক্ষিতে এটাই হবে বিপ্লবী কাজ ও আশু করণীয়।
 

Comments :0

Login to leave a comment