DYFI's 'Insaaf Yatra'

হেমন্তের বাতাসে ইনসাফের ডাক

ফিচার পাতা

ক্যাপ: ৭ জানুয়ারি ব্রিগেডের মাঠে প্রতিধ্বনিত হবে রাজ্যের মানুষের জীবনের দাবি।

 

অনির্বাণ দে: বহরমপুর 

১. মাস্টারমশাইয়ের ফুলের তোড়া

থামানোর কথা ছিল না। তবুও থামাতে হল গাড়ি। বৃহস্পতিবার দুপুরে হেমন্তের বৃষ্টি রাস্তা ভিজিয়ে দিয়েছে। বৃষ্টি মাথায় নিয়েই রাস্তায় এসে দাঁড়িয়েছেন মাস্টারমশাইও। সঙ্গে গ্রামের মানুষ। ইনসাফ যাত্রীদের হাতে ফুলের তোড়া তুলে দিয়ে সটান বুকে টেনে নিলেন ধ্রুবজ্যোতি সাহাকে। ধ্রুবজ্যোতি ডিওয়াইএফআই’র রাজ্য সভাপতি। মাস্টারমশাইয়ের ভরসার হাত মাথায় নিলেন মীনাক্ষী মুখার্জিরা। ইনসাফ যাত্রা সফল হোক, আবেগ রুদ্ধ গলায় বললেন তিনি। তিনি, আতাউর রহমান। ‘মাস্টারমশাই’ নামেই চেনেন গ্রামের মানুষ। প্রাক্তন স্কুল শিক্ষক। সম্মানিত হয়েছেন রাষ্ট্রপতি পুরস্কারেও। দেশ দুনিয়ার সব খবর রাখেন। 
পঞ্চায়েত নির্বাচনের আগে এতেই আপত্তি ছিল,  তৃণমূলের।  রানিনগর ২ ব্লকের মালিবাড়ি ১ গ্রাম পঞ্চায়েতের মরিচা গ্রামে মাস্টারমশাইয়ের  পাড়ায় তাণ্ডব করেছে তৃণমূলের গুণ্ডারা। বোমাবাজিও। ফোনে তৃণমূলের পঞ্চায়েত প্রধান নিদান দিয়েছেন, শুধরে যেতে। তৃণমূলের ব্লক সভাপতি শাহ আলম সরকার তাঁকে বলছেন, সমাজের কলঙ্ক! বলেছেন, তিনি নাকি গ্রামে অশান্তির মূলে! অবাক হলেও সামলে নিয়েছেন তিনি।
তৃণমূলী নেতার মুখের ওপর তিনি মুখ খুলেছেন নিজের মতো করে। এখন যদিও এলাকায় আসেন না ওই তৃণমূল নেতা। গ্রামের মানুষের ভালবাসায় গ্রামে ফিরেছেন মাস্টারমশাই। তিনিই বৃহস্পতিবার দুপুরে বুকে টেনে নিয়েছেন ইনসাফ যাত্রীদের।  ইনসাফ যাত্রায় তাঁর উপহার তাই বাড়তি পাওনা। এমন ঘটেছে রানিনগর ২ ব্লকের দাঁড়কাটিতে। ভরদুপুরে। 
আর সন্ধ্যায় ইনসাফ যাত্রা সাগরপাড়া ঢুকতেই দ্রুত হাতে চিরকুট গুঁজে দিয়ে গেল এক ডিওয়াইএফআই কর্মীর হাতে। ছোট্ট চিরকুটে কাটাকাটা হরফে স্পষ্ট লেখা ‘ভিজেল রিসোর্স পার্সন-রা ৩/৪ মাস ধরে বেতন পায় না। প্রিয় কমরেড, আমাদের জ্বালা-যন্ত্রণার কথা তুলে ধরার জন্য অনুরোধ করছি’।
ইনসাফ যাত্রা সরব হয়েছে প্রকল্প কর্মীদের দাবি নিয়ে। মোদী জমানায় বেড়েছে ছদ্ম বেকারত্ব। হাজার অন্যায় সয়েই কাজে টিকে থাকতে হচ্ছে স্বল্প বেতনের কর্মীদের, প্রকল্প কর্মীদের। তাঁদের দাবি উঠল বেশ গুরুত্ব দিয়েই।

২. অনেক তো বৃথা দিন গেল এ সংশয়ে
আর পারা যায়? টিউশন পড়িয়ে ফিরে বলছিলেন সফিক রহমান। এমএ, বিএড। সফিক  বলছেন, তিনি কাউকে আর ডিগ্রি বলেন না। সকালে গ্রামের বাচ্ছাদের টিউশন পড়ান। মাঝে চাষের কাজে হাত লাগান। দাঁড়িয়েছিলেন ভগবানগোলা বাসস্ট্যান্ডে। শুনেছেন, মিছিলের কথা। 
ইনসাফ যাত্রার মিছিল যখন শেষ হচ্ছে ভগবানগোলায়। তখন আবার সফিকের সাথেই দেখা। জানান, কোনভাবেই বসে থাকা গেল না। রানিনগরের সইদুল ইসলামকে মিছিলে হাঁটতে বারণ করেছিল তৃণমূল। প্রতিদিন হুমকি দিচ্ছে। তারপরেও আট কিলোমিটার হেঁটেছেন সইদুল। গ্রামে চাষের কাজে মজুরি দু’শো টাকা আর কেরালায় মজুরি সাতশো টাকা। তাই সেখানেই যেতে হবে পরের মাসে। ভোটের আগে গ্রামে এসেছেন। 
 

৩/ ‘যাদের হাত ফ্যাকাশে হয় ক্ষারে’
হাতে গাঁদা ফুলের মালা। দাঁড়িয়েছিল জেসমিনা। পিঠে বইয়ের ব্যাগ। ইনসাফ যাত্রা জাফরের ছাগলের হাটে পৌঁছাতেই ছুঁড়ে দিয়েছে ফুল। এসেছে ইনসাফ যাত্রা দেখতে। বাড়িতে দাদার ফোনে ইনসাফ যাত্রার ভিডিও দেখে ইচ্ছে হয়েছে নিজের চোখে দেখার।  ফ্যাকাশে হাত নিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসে দাঁড়িয়েছেন সামসেরগঞ্জের ফুলসোনা খাতুন। মোবাইল ফোনে রেকর্ড করার চেষ্টা করছেন ইনসাফ যাত্রার ভিডিও। লালপুরে বিড়ি বাঁধছিলেন আসমানি বেওয়া। পাশে বসে কথা শুনেছেন ডিওয়াইএফআই নেতা ধ্রুবজ্যোতি সাহা। 
না-ইনসাফি মজুরি আর নয়। সরকার যা মজুরি ঠিক করেছে, সেই মজুরি শ্রমিকদের দিতে হবে। বন্ধ করতে হবে হাজার বিড়িতে একশ দেড়শ বিড়ি বাদ দেওয়া। আওয়াজ উঠেছে জঙ্গিপুরে ইনসাফ যাত্রায়। কেন বেহাল দশা গ্রামীণ স্বাস্থ্য কেন্দ্রের? প্রশ্ন করেছে ভগবানগোলার রানিতলা। মুর্শিদাবাদের মহিলাদের অধিকাংশই ভুগছেন রক্তাল্পতায়। সেখানে সরব হয়েছে, স্বাস্থ্যের অধিকারের দাবি। 
মুর্শিদাবাদে মহিলাদের মধ্যে রক্তাল্পতার তথ্য সামনে এনেছে   ন্যাশনাল ফ্যামিলি হেলথ সার্ভে-৫ । এই সার্ভে থেকে প্রকাশিত তথ্যে দেখা গিয়েছে,  মুর্শিদাবাদ  জেলার ১৫ থেকে ৪৯ বছর বয়সি মহিলাদের মধ্যে ৭৭.৬ শতাংশই  রক্তাল্পতায় ভোগেন।  এনএফএইচ -৪ এ এই হার ছিল ৫৭.৫ শতাংশ। কোভিড পরবর্তী কালে আরও বেড়েছে স্বাস্থ্যর সঙ্কট। মুর্শিদাবাদের প্রায় এগারো লক্ষ বিড়ি শ্রমিকদের মধ্যে ৯৫ শতাংশই মহিলা। বিড়ি বেঁধে সামান্য আয় তার উপর তামাক পাতার সাথে ঘর করার প্রভাব পড়েছে বিড়ি শ্রমিকদের স্বাস্থ্যেও। দক্ষিণ দিনাজপুরের সীমা রায় হাঁটছেন প্রথম দিন থেকেই। ইনসাফ যাত্রায় পা মিলিয়ে দেখেছেন, চা বাগানে মহিলা শ্রমিকদের যন্ত্রণা। আর সামসেরগঞ্জ, লালগোলায় এসে শুনেছেন বিড়ি শ্রমিকদের বঞ্চনার আখ্যান। তৃণমূল নেতারাই বিড়ি মালিক। খাদের কিনারে বিড়ি শ্রমিকরা। এদের জন্য ইনসাফ চাইতেই হবে, বলছেন সীমা। 

৪.‘যখন গহীন রাতে আন্ধার পথে চমকায় বিজলী’ 
বুধবার সকালে হরিহরপাড়ার নিয়ামতপুরে শহীদ কমরেড রেন্টু শেখের বাড়িতে জড়ো হয়েছিলেন আশেপাশের গ্রামের মানুষও। সেই বাড়িতে যান ইনসাফ যাত্রার প্রতিনিধিরা। রেন্টু শেখের স্ত্রী জান্নাতুন বিবি জানিয়েছেন, এখনও অধরা খুনিরা। হুমকি দিচ্ছে, কেস তুলে নেওয়ার। আওয়াজ ওঠে রক্ষা করতে হবে বুথ, রক্ষা করতে হবে গ্রাম। 

৪ / ‘আহ্বান, শোন আহ্বান’ 
ইনসাফ যাত্রায় ফারাক মেজাজে,  বলছেন যাত্রায় শামিল যুব কর্মীরা। মীনাক্ষী মুখার্জি বলেছেন, এই যে দুই মাসেরও বেশি সময় আমাদের সব স্তরের কর্মীরা রাস্তায় থাকছেন। একটানা। ইস্যু একটাই, ইনসাফ চাই। কাউকে কোথাও এক ইঞ্চি জমি ছাড়া হবে না। বিজেপি আর তৃণমূলের সাজানো এজেন্ডায় লড়াই নয়। লড়াই হবে মানুষের দাবিতে।  গ্রাম শহরে যে অন্যায় চলছে, তার প্রতিকার চাই। রাজ্যে কর্মসংস্থান চাই।

Comments :0

Login to leave a comment