গৌতম রায়
প্রতিযোগিতামূলক সাম্প্রদায়িকতার আবর্তে পশ্চিমবঙ্গকে পুরোপুরি নিমজ্জিত করে এই রাজ্যে সাম্প্রদায়িক, মৌলবাদী শক্তিকে জায়গা করে দেওয়ার প্রয়াস মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের রাজনৈতিক জীবনের প্রায় প্রথম থেকেই রয়েছে। এভাবে মৌলবাদী সম্প্রদায়িক শক্তির পায়ের নিচে জমি এনে দিয়ে ভোট রাজনীতিতে তাদের ঝুলি ভরিয়ে দিতে তিনি কখনও কার্পণ্য করেন না। কিন্তু তাঁর এই রাজনৈতিক এবং ব্যক্তি স্বার্থবাদী অভিপ্রায় এই রাজ্যটিকে যে সাম্প্রদায়িকতার ঘন অন্ধকারে নিমজ্জিত করছে, সে বিষয়ে আমাদের বিশেষভাবে সতর্ক হওয়া দরকার। তা নাহলে আগামী দিনে এই রাজ্য, যাকে মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক শক্তিগুলি তাদের গবেষণাগার হিসেবে ব্যবহার করতে চাইছে, সেই জায়গাটিও অচিরেই উত্তর প্রদেশ-উত্তরাখণ্ড যেখানে বিজেপি-আরএসএস সহ সমস্ত ধরনের মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক অভিসন্ধিকে বাস্তবায়িত করবার জন্য অনেকখানি সাফল্য অর্জন করেছে, সেদিকেই পরিচালিত হবে।
নিজেকে সংখ্যালঘু প্রেমী হিসাবে পরিচয় রাখতে মমতা নানা ধরনের কাজ করেন। ওয়াকফের টাকা, যেটা মুসলমান সম্প্রদায়ের নিজেদের হকের টাকা, সেই টাকা দিয়ে তৃণমূল কংগ্রেস দলের বৃত্তের মধ্যে থাকা কিছু হাতে গোনা ইমাম-মুয়াজ্জিনদের ভাতা দেওয়া হয়। রাজ্য সরকার, রাজ্যের শাসক দল এবং তাদের দলদাস সংবাদ মাধ্যমগুলি, মুসলমানদের নিজেদের হকের টাকা ওয়াকফের সম্পত্তি থেকে ইমাম মুয়াজ্জিনদের এই ভাতা দেওয়ার বিষয়টিকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার মুসলমানদের ভাতা দিচ্ছে, এই প্রচার করে সামাজিক অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে পড়া মুসলমান সমাজের সামনে বিভ্রান্তি তৈরি করে। ফলে তাঁদের অনেকেই বিশ্বাস করে ফেলেন, এই টাকা গরিব ইমাম মুয়াজ্জিনরা পাচ্ছেন রাজ্য সরকারের কাছ থেকেই।
এই অসত্য প্রচার একদিকে যেমন গরিব মুসলমানদের মধ্যে মমতা ব্যানার্জির মুসলমান প্রেমী ইমেজ নির্মাণ করতে সাহায্য করে, ঠিক তেমনি তাঁর এই ভূমিকাকে ওনার স্বাভাবিক মিত্র আরএসএস-বিজেপি সহ হিন্দুত্ববাদীরা সাধারণ ধর্মপ্রাণ হিন্দুদের সামনে এটাকেই মুসলমান তোষণ বলে তুলে ধরে একটা ভয়ঙ্কর সামাজিক বিভাজন নির্মাণ করে। সেই বিভাজন রেখার দৌলতেই রাজনৈতিকভাবে খুব একটা সচেতন হয়ে ওঠার সুযোগ না পাওয়া, অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল মুসলমান সমাজের একটা বড় অংশ, তাঁদের সমর্থন মমতার প্রতি জ্ঞাপন করেন।
অপরপক্ষে সাধারণ হিন্দু, ধর্মপ্রাণ কিন্তু ধর্মান্ধ নন এমন মানুষ, যাঁরা খুব একটা রাজনৈতিকভাবে সচেতন হয়ে ওঠার সুযোগ পাননি, সামাজিক অর্থনৈতিকভাবেও খুব একটা শক্তিশালী নন, এমন মানুষদের মধ্যে এই ইমাম ভাতা ইত্যাদিকে কেন্দ্র করে মুসলিম তোষণের এক তথাকথিত কল্পকাহিনি অত্যন্ত সংগঠিতভাবে, আধুনিক প্রচার মাধ্যমের নানা ধরনের প্রযুক্তিকে ব্যবহার করে তুলে ধরে আরএসএস- বিজেপি।
সেখান থেকে সাধারণ ধর্মপ্রাণ হিন্দু, কিন্তু ধর্মান্ধ নন এমন মানুষদেরও খুব সহজেই ‘রাজনৈতিক হিন্দু’তে পরিণত করে নিজেদের ভোট বাক্স ভারী করবার এক ভয়ঙ্কর কৌশল অবলম্বন করেছে।
মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক শক্তি আরএসএস-বিজেপি এবং প্রতিযোগিতামূলক সাম্প্রদায়িক শক্তি তৃণমূল কংগ্রেস বা তাদের সহযোগী বিভিন্ন ধরনের সংগঠন আছে, যারা ঠিক আরএসএস’র মতোই সামাজিকতার একটা আবরণ রেখে সরাসরি রাজনৈতিক পক্ষ অবলম্বন করে। তাদের এই পারস্পরিক বোঝাপড়ার ভিত্তিতে গোটা পশ্চিমবঙ্গ এখন একটা বড় রকমের সামাজিক সঙ্কটের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে।
এই প্রতিযোগিতামূলক সাম্প্রদায়িকতায় ভারসাম্য রক্ষার খেলাটা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মুখ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব পাওয়ার পর থেকে অত্যন্ত বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে করে চলেছেন। ইমাম মোয়াজ্জিন ভাতা দেওয়ার পর যখন হিন্দু সম্প্রদায়িক শিবির থেকে পুরোহিত ভাতার দাবি উঠলো, মমতা কিন্তু সেই দাবি পূরণ করতেও সময়ক্ষেপ করেননি। কিন্তু মজার কথা হলো, এই পুরোহিত ভাতা প্রদানের ক্ষেত্রে ভাতা প্রাপকদের আর্থ-সামাজিক অবস্থার কোনোরকম সমীক্ষা হয়নি। অবশ্য ইমাম-মোয়াজ্জিনদের ক্ষেত্রেও কোনও সমীক্ষা হয়নি।
ফলে বহু ক্ষেত্রেই পৌরহিত্য করে জীবিকা নির্বাহ করেন এমন মানুষদের একটা বড় অংশ, যাঁরা অর্থনৈতিকভাবে অত্যন্ত করুণ অবস্থায় আছেন, তাঁরা কিন্তু এই পুরোহিত ভাতার সুযোগ পান না। স্বভাবসুলভ ভাবেই মমতা বা তাঁর দল এই পুরোহিত ভাতা প্রদানের ক্ষেত্রে তাঁদের দলীয় বৃত্ত এবং অবশ্যই আরএসএস’র সাথে সংযোগকেই মূলত ভাতা প্রদানের ক্ষেত্রে প্রধান মাপকাঠি হিসাবে দেখেছেন।
প্রতিযোগিতামূলক সাম্প্রদায়িকতার ক্ষেত্রে বাঙালি হিন্দুদের নানা ধর্মীয় উৎসব মমতার কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ। দুর্গোৎসবকে কেন্দ্র করে যেভাবে ক্লাবগুলোকে রাজকোষ থেকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় টাকা দেন, তাদের বিদ্যুৎ বিলের ক্ষেত্রে ছাড় দেন, সরকারি অনুমতির ক্ষেত্রে নানা ধরনের বাড়তি সুযোগ দেন, এগুলো ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধানের মূল নির্যাসকে সম্পূর্ণ অবজ্ঞা করে।
এই সমস্ত ঘটনাক্রমের সঙ্গে বেশ কয়েক বছর ধরে সাগরদ্বীপে কপিলমুনির আশ্রমকে ঘিরে মকর সংক্রান্তি, অর্থাৎ পৌষ মাসের শেষ দিনে যে ধর্মীয় উৎসব হয়, তাকে ঘিরে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নিজে এবং তাঁর প্রশাসনের পক্ষ থেকে সেই একইরকম প্রতিযোগিতামূলক সাম্প্রদায়িকতার পালে হাওয়া দেওয়ার অবস্থান গ্রহণ করেছে। কপিলমুনির আশ্রমকে কেন্দ্র করে সাগরদ্বীপে যে মেলা হয়, সেই মেলাটি পশ্চিমবঙ্গের সর্ব বৃহৎ মেলা।
এই মেলা উপলক্ষে ভক্তদের দেওয়া যে পরিমাণ অর্থ কপিলমুনি আশ্রমের তহবিলে পড়ে এমনটা পশ্চিমবঙ্গে কোনও সম্প্রদায়ের কোনও মেলা ঘিরেই হয় না। এই মেলাটি দীর্ঘকাল ধরে চলছে। মেলায় যাত্রীদের যাতায়াতের ব্যাপার, সাময়িকভাবে তাঁদের থাকবার ব্যবস্থা করা, সাধারণত যা হোগলা পাতার ঘর দিয়েই তৈরি করা হয়, পয়ঃপ্রণালীর ব্যবস্থা ইত্যাদি বিষয়গুলি স্বাধীনতার পরবর্তীকাল থেকে যখন যে রাজনৈতিক দলেরই সরকার ক্ষমতায় থেকেছে, তাঁরা যথাসাধ্য প্রশাসনিক সহযোগিতা করেছে। মানুষের নিরাপত্তা, চিকিৎসা, নিরাপদ যাতায়াত ব্যবস্থা করা সরকারের দায়িত্বের মধ্যেই পড়ে।
বামফ্রন্ট সরকার ক্ষমতায় থাকাকালীন জলপথজনিত দুর্গমতাকে অতিক্রম করে যাত্রী যাতায়াতের সুবিধার জন্য নানারকমের প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিয়েছিল। এক্ষেত্রে বামফ্রন্ট সরকারের পরিবহণ দপ্তর, স্বাস্থ্য দপ্তর, জনস্বাস্থ্য কারিগরি দপ্তর ইত্যাদির ভূমিকা ছিল উল্লেখযোগ্য।
কপিলমুনির আশ্রমটির পরিচালক হলো উত্তর প্রদেশের অযোধ্যার হনুমান গড়ি আখড়া। তবে সাধারণ ধার্মিক মানুষ এই আখড়ার প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করতে মোটেই যান না, তাঁরা যান তাঁদের নিজস্ব ধর্মীয় বিশ্বাস থেকে কপিলমুনির প্রতি ভক্তির টানে। ঐতিহাসিক বাবরি মসজিদের ভিতরে স্বাধীনতার অব্যবহিত পরে, তালা ভেঙে একটি ধাতব মূর্তি রেখে, রামচন্দ্র স্বয়ং প্রকটিত হয়েছেন বলে হিন্দুত্ববাদীদের যে শিবাকীর্তন, তারপর ওই বিতর্কিত অংশে পূজা-অর্চনা— এই গোটা ব্যাপারটি ধারাবাহিকভাবে চালিয়ে এসেছে এই হনুমান গড়ি আখড়া।
পরবর্তীতে ঐতিহাসিক বাবরি মসজিদ ধ্বংসের পর সেই ধ্বংসস্তূপের উপর আদালতের নির্দেশকে অবলম্বন করে তড়িৎ গতিতে যে ব্যাপক ব্যয়বহুল রাম মন্দির হিন্দুত্ববাদীরা নির্মাণ করেছে, তার সার্বিক পরিচালনার দায়িত্বে রয়েছে এই হনুমান গড়ি আখড়া। ধর্মীয় সংগঠন বলে নিজেদের দাবি করলেও আরএসএস বৃত্তের একটি বিশেষ রকমের শক্তিশালী এবং উল্লেখযোগ্য অংশ হলো এই হনুমান গড়ি আখড়া। সাম্প্রতিক অতীতে রামনবমীকে ঘিরে গোটা হিন্দু সম্প্রদায়িক শিবিরের যে তাণ্ডব, এই রামনবমীর পালনের ধারাটা হিন্দুত্ববাদীর আত্মস্থ করেছে এই হনুমান গড়ি আখড়াতে পালিত উৎসবের ভেতর দিয়েই।
হনুমান গড়ি আখড়ার পক্ষ থেকে অযোধ্যায় প্রথম রামনবমী পালনকে কেন্দ্র করে মুসলমান বিদ্বেষের মানসিকতা ছড়ানো হয়েছিল। তার আগে কিন্তু ফৈজাবাদ জেলার বিভিন্ন প্রান্তে হিন্দু-মুসলমান একইসঙ্গে সহঅবস্থান করে যে যাঁর মতো ধর্মীয় উৎসব, আচার-আচরণ পালন করতেন, কোথাও ভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে বিবাদ সংঘাতের এতোটুকু চিহ্ন দেখতে পাওয়া যায়নি। বস্তুত ওয়াজেদ আলীর শাসনকালে যে অযোধ্যার ইতিহাস আমরা পাই, সেই ইতিহাস ছিল হিন্দু মুসলমানের পারস্পরিক সহাবস্থানের ইতিহাস। যার নির্যাস হিসাবে গড়ে উঠেছিল যৌথ সংস্কৃতিক প্রবাহ।
১৯৪৭ সালের পর থেকে বাবরি মসজিদ দখলের লক্ষ্যে হিন্দুত্ববাদীদের বিভিন্ন কার্যক্রম, আর তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে এই হনুমান গড়ি আখড়ার রাজনৈতিক এবং আর্থিক সাফল্য শুরু হয়েছিল। সাগরদ্বীপে কপিলমুনির আশ্রম ঘিরে যে ব্যাপক পরিমাণ আয় হয় ভক্তদের দানের থেকে, সেই পুরো টাকাটাই হনুমান গড়ি আখড়া কিন্তু অযোধ্যায় তাদের কেন্দ্রীয় দপ্তরে নিয়ে চলে যায় পশ্চিমবঙ্গ থেকে। অথচ ওই মেলাকে কেন্দ্র করে একটা ব্যাপক অঙ্কের টাকা ধারাবাহিকভাবে প্রতিবছর পশ্চিমবঙ্গ সরকার খরচ করে যায়। অতীতে কংগ্রেস বা বামফ্রন্ট আমলেও এর কোনও অন্যথা হয়নি। কিন্তু হনুমান গড়ি আখড়ার পক্ষ থেকে যাত্রী স্বাচ্ছন্দ্য থেকে শুরু করে জনস্বাস্থ্য, কোনও বিষয়েই সাগরদ্বীপে একটি পয়সাও খরচ করা হয় না।
ধীরে ধীরে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার নিজেদের কোষাগার থেকে সাগর মেলাকে ক্রমশ আরএসএস’র যে সমস্ত রাজনৈতিক কর্মসূচি, যেগুলিকে তারা রাজনীতি না বলে সামাজিক কর্মসূচি বলে একটা সুগার কোটিং দিয়ে সাধারণ মানুষের কাছে উপস্থাপিত করে, সেই লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে চলেছে।
অতীতে আমরা দেখেছি, এই কপিলমুনি আশ্রমের মধ্যে হনুমান গড়ি আখড়ার শীর্ষ সাধু, যারা অযোধ্যায় বাবরি মসজিদের ধ্বংসস্তূপের উপর বিতর্কিত রাম মন্দির তৈরির জন্য অত্যন্ত সোচ্চার ছিল, তারা সংবাদ মাধ্যমের সামনে রাজনৈতিক কথা বলতেও দ্বিধাবোধ করেনি।
মকর সংক্রান্তিকে ঘিরে তৃণমূলের সরকার কপিলমুনি আশ্রম সংলগ্ন সাগর তীরবর্তী অঞ্চলে সাগর আরতির সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এই সাগর আরতি কারা করতে পারবেন তার জন্য সরকারের তরফ থেকে একটি নির্দেশিকা জারি করা হয়েছে। আরতির অধিকারী ব্রাহ্মণদের কি কি বৈশিষ্ট্য থাকা দরকার এবং তাদের সহযোগিতা করবার জন্য যে সমস্ত মহিলারা থাকবেন, তাদেরও কি ধরনের গুণাবলীর প্রয়োজন, সেগুলি সরকারি বিজ্ঞপ্তি জারি করে সাধারণ মানুষকে জানানো হয়েছে। সরকারি কোষাগারের টাকাতেই গোটা আরতি পর্ব সংঘটিত হবে।
এই আরতি উপলক্ষে যে সমস্ত জিনিসপত্রের দরকার, তা সে ঢাকঢোল থেকে শুরু করে নারকোলের ছোবড়া, সবকিছুই আসবে সরকারি কোষাগারের টাকা থেকে। আরতি যারা করবে, তাদের নানা ধরনের ধর্মীয় পোশাক অর্থাৎ নামাবলী ইত্যাদি ইত্যাদি সেগুলিও আসবে সরকারি কোষাগারের টাকায়। সহযোগিতার জন্য যে সমস্ত মহিলাদের নিযুক্ত করা হবে, তাঁদের লাল পাড়ের শাড়ি ইত্যাদিও আসবে সরকারি কোষাগারের টাকায়।
নদীকে ঘিরে ধর্মীয় আরতির ইতিহাস ভারতে খুব প্রাচীন নয়। এটি হরিদ্বারে হারকি পিয়ারী ঘাটে একেবারে ধর্মীয় দ্যোতনায় শুরু হয়েছিল। সেই আরতি পর্বের সঙ্গে কখনো কোনোরকম হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির সংযোগ ছিল না। আটের দশকের মাঝামাঝি সময়কাল পর্যন্ত বেনারসের দশাশ্বমেধ ঘাট বা সংলগ্ন ঘাটগুলিতে কিন্তু কোনোরকম আরতির ব্যবস্থা ছিল না।
ঐতিহাসিক বাবরি মসজিদ ধ্বংসের পর গোটা ভারত জুড়ে যে ধরনের সাম্প্রদায়িক রাজনীতির বাড়বাড়ন্ত শুরু হয়, তার ফলশ্রুতি হিসাবেই নয়ের দশকের মাঝামাঝি সময়কাল থেকে বেনারসে দশাশ্বমেধ ঘাটকে কেন্দ্র করে এই গঙ্গা আরতির সূচনা। হিন্দুত্ববাদী শক্তি ক্রমশ সংসদীয় রাজনীতিতে যত শক্তিশালী হয়ে উঠেছে, ততোই বেনারসে এই গঙ্গা আরতির হিন্দুত্বকরণ ঘটেছে। মোদি কেন্দ্রে ক্ষমতায় আসবার অব্যবহিত আগের সময়কাল, তখন বেনারসের এই গঙ্গা আরতির পর, যে মাইকগুলি দিয়ে আরতির সময় বিভিন্ন ভজন কীর্তন পরিবেশন করা হতো, সেই মাইকগুলি থেকেই আরএসএস’র রাজনৈতিক স্লোগানগুলি ধ্বনিত হতে শুরু করে। পরবর্তীকালে এই আরতির গোটা প্রক্রিয়ার মধ্যেই প্রচলিত ধর্মীয় রীতিনীতি কমজোরি হতে থাকে, শক্তিশালী হয় ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহারের নানা ধরনের রীতিনীতি।
পশ্চিমবঙ্গে আরএসএস’র হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির প্রচার ও প্রসার এবং বাংলা ও বাঙালির সামাজিক জীবনে আরএসএস তাদের সাংস্কৃতি ভাবনাকে গেঁথে দেওয়ার লক্ষ্যে বাবুঘাটে রাজ্য সরকারের বদান্যতায় গঙ্গা আরতি শুরু করে। তারপর দেখা যায় মফস্বলের বিভিন্ন জায়গায় গঙ্গা আরতি। আরএসএস-বিজেপি-সঙ্ঘ পরিবারের শাখাগুলি এবং তৃণমূল কংগ্রেস কার্যত তাদের সাথে প্রতিযোগিতায় নেমে পড়ে।
সাগর মেলা উপলক্ষে সাগর আরতির যে বিজ্ঞপ্তি রাজ্য সরকারের পক্ষ থেকে জারি করা হয়েছে, সেখানে যারা আরতি করবেন, তাদের ড্রেস কোড হিসাবে ধুতি পাঞ্জাবি এবং নামাবলীর কথা বলা হয়েছে। পোশাক ব্যবহার সংক্রান্ত মমতা সরকার বিজ্ঞপ্তি থেকেই বুঝতে পারা যাচ্ছে, কোনোরকম ধর্মীয় অনুভূতির প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়ে এই সাগর আরতির আয়োজন করা হচ্ছে না। কারণ, প্রচলিত হিন্দু ভাবধারায় এবং হিন্দু ধর্মের প্রাতিষ্ঠানিক দ্যোতনায় কোনও অবস্থাতেই কোনোরকম সেলাই করা বস্ত্র পরে ধর্মীয় আচরণ বা রীতিনীতি পালন করতে পারা যায় না। মমতার সরকার, সাগর আরতির বিজ্ঞপ্তিতে আরতিকারীদের যে পোশাক বিধি দিয়েছে, তা থেকেই বুঝতে পারা যাচ্ছে, গোটা হিন্দুত্ববাদী শিবিরের রাজনৈতিক স্বার্থকে চরিতার্থ করে, হিন্দু মুসলমানের বিভাজন রেখাটা পশ্চিমবঙ্গের বুকে আরও তীব্র করে দেওয়ার জন্য কি ধরনের খেলা মমতা খেলতে শুরু করেছেন, আর এই কাজে তাদের দোসর একাংশের সংবাদ মাধ্যম।
Comments :0