Editorial

৫৬ ইঞ্চি এখন ৩৬

সম্পাদকীয় বিভাগ

প্রথম দু’দফার নির্বাচন হতেই বিশ্বগুরুর ৫৬ ইঞ্চি ছাতি ৩৬-য়ে  নেমে গেছে। সাত দফা ভোট শেষ হলে সেই ছাতি কোথায় গিয়ে ঠেকবে সেটা আর কয়েকদিন পরই স্পষ্ট হয়ে যাবে। হেলায় জেতার সেই ঔদ্ধত্যপূর্ণ বাগাড়ম্বর, অতিমাত্রার আত্মবিশ্বাস, বিরোধীদের তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করার সেই দাম্ভিক আচরণ দ্রুত হাওয়ায় মিলিয়ে যাচ্ছে। সবকা সাথ সবকা বিকাশের এখন কালেভদ্রে একবার উচ্চারিত হয়। আরএসএস-বিজেপি-র ভোট বৈতরণীর প্রধান, বলা যায় একমাত্র কান্ডারি টের পাচ্ছেন এলাম, লড়লাম, জিতে গেলাম, ব্যাপারটা অতটা সহজ নয়। ভারতের জনগণ মোদী-শাহদের খাস তালুকের প্রজা নন যে দলে দলে তাঁদের পেছনে লাইন দেবেন। এটা বহুদলীয় গণতন্ত্রের দেশ। নানা ধর্ম, ভাষা, জাতিগোষ্ঠী, সাংস্কৃতির এই ভারতে আছে ধর্মনিরপেক্ষ গণতন্ত্রের সংবিধান। উগ্র জাতীয়তাবাদী, কট্টর দক্ষিণপন্থী, ধর্মান্ধ হিন্দুত্ববাদীদের খাস তালুক নয় এই দেশ। তাই সর্বাধিনায়কের কপালের ভাঁজ ক্রমশ গভীর হচ্ছে। সব হিসাব গুলিয়ে যাচ্ছে। দেখতে শুরু করেছেন অনিশ্চয়তার সিঁদুরে মেঘ।
ভেবেছিলেন অনেক কিছু। উচ্চাশা ছিল লাগাম ছাড়া। নির্বাচনের ঢাকে কাঠি পড়তেই ঘটা করে অধিবেশন ডেকে ঢাকঢোল পিটিয়ে দলের কর্মী-সমর্থক তথা গোটা দুনিয়াকে জানিয়ে দিলেন বিজেপি হেসে খেলে জিতে যাবে ৩৭০ আসন। আর জোটগতভাবে এনডিএ ছাড়িয়ে যাবে ৪০০ আসন। প্রথম দফার ভোটের আগে পর্যন্ত এটাই ছিল মোদীর প্রচারের সার কথা। বলেছেন তারা তৃতীয়বারের জন্য শুধু ক্ষমতায় আসছেন না দুই তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে বিরোধীদের কার্যত অস্তিত্বহীন করে দেবেন। দলের অন্য নেতা-মন্ত্রীরা ৪০০ আসনের লক্ষ্যমাত্রার ব্যাখ্যা দিয়ে বলেছেন সংবিধান বদলে দিয়ে হিন্দুত্ব রাষ্ট্র গঠনই তাদের লক্ষ্য। মোদী স্বয়ং ইঙ্গিত দিয়েছেন ভোটের পর এমন কিছু ঘটবে যাতে গোটা পৃথিবী চমকে যাবে। এমনকি এটাও বলেছেন দশ বছর ধরে তিনি শুধু ট্রেলার দেখিয়েছেন, ভোটের দেখাবেন গোটা ছবি। এছাড়াও তিনি বলে বেড়াতেন ফাইভ ট্রিলিয়ন ডলারের অর্থনীতির কথা। তাঁর তৃতীয় দফার সরকারই ভারতকে তৃতীয় বৃহত্তম অর্থনীতিতে পরিণত করবেন। ২০৪৭ সালে ভারত হবে আমেরিকার মতো উন্নত দেশ। দশ বছর পরই ভারতে অলিম্পিকের আয়োজন করছেন। ভারতে এক মহামানবের উদয় হয়েছে। তার কাছে অসাধ্য কিছু নেই। তিনি সবই করে দেবেন। কিন্তু ক্রমাগত প্রতিশ্রুতিভঙ্গকারী কোনও নেতা যে সাধারণের প্রতারক হিসাবে গণ্য হয় সেটা তাঁর জানা ছিল না। মানুষ এই স্বপ্নের ফেরিওয়ালেকে যে চিনে ফেলেছেন সেটাও তিনি টের পাচ্ছিলেন না।
টনক নড়েছে প্রথম দফার ভোট গ্রহণের পর। বুঝেছেন হাওয়া তাদের মতো করে বইছে না। তাই প্রথম দফার ভোটের পর থেকেই ভাষণে ৩৭০ বা ৪০০ আসন নেই। ডিলিট হয়ে গেছে সবকা সাথ সবকা বিকাশ। ভুলেও উচ্চারণ করছেন না মূল্য বৃদ্ধির কথা, কাজের কথা, রুজি রোজগারের কথা, মানুষের দৈনন্দিন জীবনের দুর্দশার কথা। তিনি ফিরে গেছেন  নাগপুরের প্যাভিলিয়নে। দু’হাতে প্রবলভাবে আকড়ে ধরেছেন ধর্মীয় ও সাম্প্রদায়িক এবং জাতপাতের বিভাজনের রাজনীতিকে। খড়কুটোর মতো আঁকড়ে মুসলিম বিদ্বেষকে। হিন্দুত্ববাদী ধর্মান্ধ রাজনীতিই এখন তার প্রধান আশ্রয়। পাশাপাশি অনর্গল মিথ্যাচারে ভরে উঠছে তার ভাষণের ডালা। দেশ দুনিয়া দেখছে ২০১৪ এবং ২০১৯ সালে যে প্রবল মোদী হাওয়া ছিল সেটা ২০২৪ সালে নেই। মোদী সেটা যত অনুভব করছেন ততই তার ভীতি ও হতাশা বাড়ছে। আরএসএস বড় আশা করে সবকিছু তুলে দিয়েছিল মোদীর হাতে। এযাত্রায় বোধহয় আর বৈতরণী পার হওয়া যাবে না।

Comments :0

Login to leave a comment