স্নিগ্ধা বন্দোপাধ্যায়
এখানেও ‘‘সমস্ত দিনের শেষে শিশিরের শব্দের মতন সন্ধ্যা আসে, ডানার রৌদ্রের গন্ধ মুছে ফেলে চিল’’। পাথরের রুক্ষতা কোথাও মসৃণ হয়ে সবুজের বনানীর ভেতর নিবিড়ভাবে নিঃশ্বাসের স্পন্দন জুগিয়ে যাচ্ছে। শ্রমের বিনিময়ে যেমন সভ্যতা তৈরি হয়, সেই সভ্যতাকে লালন করে দিনের কড়া সূর্যের আলো চুঁইয়ে পড়া গাছগাছালির ফাঁকে নরম হয়ে আসা আদুরে পাথর যেন একে অপরের মাঝে জায়গা করে দিয়েছে, তির তির করে বয়ে চলা ক্ষীণ জলের সরু স্রোতের ভেতর।
বৃহৎ প্রাচীন আসলে রাখা অভিভাবকের মতোই তিন তলা সমান মহুয়া, শিমূল, শিরীষ, অর্জুন, হরিতকী, আবার তার মাঝে বাঁশ ঝাড় পলাশ, হলুদ গাছের ছড়াছড়ি। মধ্যে ঢেউ খেলানো লালমাটির বন্য পথ, বাঘমুন্ডি ব্লকের ছাতনি গ্রামের একদিকে মাত্র ৭টি ঘর নিয়ে কোটালমারা, একে শহুরে অভিজ্ঞতায় পাড়া বললে ভুল হবে না। গোটা গ্রামে ৮২৩ জন বাসিন্দা সাক্ষরতার যার মধ্যে ৪১১ জন পুরুষ হলেও নারীর সংখ্যা ৪১২। এই গ্রামে সাক্ষরতার হার এই নেট দুনিয়ার জগতে মাত্র ২২.৯৬%। তাদের মধ্যে মহিলা সাক্ষরতার হার ১৩.৩৫%।
কোটালমারা কেমন যেন এক কোণায়, স্বাভাবিকভাবেই মনুষ্য শব্দের বা আওয়াজের আনাগোনা অনেকাংশে যৎসামান্য। চারিদিকে কান পাতলেই গাছের ডালের খসখসানি, পাতা খসে পড়া, পাখির ডাক, বাতাস বয়ে চলে, কোথাও শূন্যতার মাঝে বন পাহাড়ের আদিম বন্যতা অনেকখানি স্পষ্ট। কিছুটা দূরে এক একটা উপুড় হয়ে শুয়ে থাকা ধূসর পাহাড়ি টিলা।
আলো, আঁধারি, স্যাঁতসেতে, হরিণীর লাফিয়ে চলা মাঝে মধ্যে সর্ষে ফুলের খেত তারই মাঝে সময়কে পিঠে করে এগিয়ে নিয়ে চলেছে অঞ্চলের নারীরা। আদিবাসীর ভেতর কুড়মি, সাঁওতাল, ওরাং, বাউড়ি সম্প্রদায়ের বাস।
গোটা রাজ্য উন্নয়নের জোয়ারে ভেসে গেলেও এই অঞ্চলের মানুষদের সেই অর্থে কোনো কাজ নেই। জমি এক ফসলি, তার ওপর এ বছর প্রচুর গরমে মাটি হা-হা করেছে। ফলত বাইরে থেকে আসা লোকজনকে নিয়ে যতটুকু ব্যস্ততা, আর তাকে ঘিরেই কিছু আয় উপায়। এটুকু বাদ দিলে আলসেমি নড়াচড়া। কিন্তু পরিবারকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে অনেকখানিও। সন্তান, নিজের জন, পোষ্য, দায় দায়িত্ব, মাঠ, ফসল সমস্ত বিষয়গুলোকে ঘাড়ে চাপিয়ে একাই এখানকার মহিলারাই। রাস্তার দু পাশে খাবার, চায়ের দোকান, বিশ্রামাগার, এসব দেখভাল করা থেকে শুরু করে কাঁখে গামছা দিয়ে সন্তানকে কষে বেঁধে নিয়ে এক পাল ছাগল গোরু চড়ানো, পিঠে মুড়ির পোঁটলা বেঁধে লাঠি হাতে খালি পায়ে বিঘের পর বিঘে জমিতে হেঁটে একাই এগিয়ে চলেছে।
কালেরবেলা গড়িয়ে পড়তেই সেটা নিয়ে টনক নড়েছে তাহল মাথা উঁচু করে বাঁচার নিজেদের পরিচয় তৈরি করার, যা সম্ভব একমাত্র লেখাপড়ার মধ্যে দিয়ে। গোটা গ্রামে বা পাড়ায় হাতে গুণে লেখাপড়া জানা মানুষকে দিয়ে নিজেদের ঝালিয়ে তোলার চাহিদা তৈরি হচ্ছে। বিশেষত মেয়েদের মধ্যেই।
যেসব সরকারি স্কুলে যে একজন দু’জন টিমটিম করে শিক্ষক-শিক্ষিকারা আসেন খেয়াল হলে, রোদে পুড়ে, ধুলোয় মিশমিশে চাবুক তৈরি করতে বিন্দমাত্র কসরত করতে ছাড়ছে না। ৬-৮ বছর এবং তার উপরে স্কুলে যাওয়া মেলের দল। পাহাড়ি বাস স্টপেজে প্রত্যেক ভিড়ের ভেতর ওঠানামা করছেন নারী শ্রমিকেরা। পাহাড়ী রাস্তা ধরে এক কোণে কোটালমার। গ্রামে বাচ্চা ছেলেমেয়ের দল এবং অন্য পাড়া থেকে আসা মোট ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে গড়ে উঠেছে ‘পলাশবাড়ি পাঠশালা’। সেখানে বাচ্চাদের সাথে স্লেট পেন্সিলের সাথী হতে ইচ্ছে প্রকাশ করেছে, ছোট্ট বাচ্চাদের মায়েরা। সবিতা, কৌশল্যা, বাহামনি, খুনুকা, চামেলী, কৌশল্যা, লীলা, গুরুমণি, মল্লিকা এদের গায়ে এবার আলো এসে পড়েছে। এ যেন পরাধীন সভ্যতার শৃঙ্খল মোচন। মুক্তির আলো।
এঁদের পরবর্তী প্রজন্ম পাঠশালার দেওয়া পোশাক গায়ে শীতের রোদ মেখে দেশের জাতীয় সঙ্গীতের উচ্চারণে যখন গলা মেলাচ্ছে, তখনই যেন এক বৃত্ত সম্পূর্ণ হওয়া শুরু হলো, লাইন করে গোবর লেপে দেওয়া উঠোনে হাত জোড় করে ভারতভাগ্য বিধাতার জয় গান গেয়ে ওঠে, এ যেন কালের চাকা নড়ে ওঠে, রমেশ, রাখাল, মঞ্জু এই তিন শিক্ষকের দল, ওদের পথের দিশারী। কলকাতা থেকে যাওয়া স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা (হৃদান) শহর থেকে একটু একটু করে সাধ্যমতো ব্ল্যাকবোর্ড, চক, ডাস্টার, বই, পোশাক নিয়ে চলেছে, এ যেন ‘রানারে’র দল। ‘রাত শেষ হয়ে সূর্য উঠবে কবে’ — এই আশা নিয়ে এগিয়ে চলার শপথ রাখে।
তখনকার ১৯৪৮ থেকে ১৯৫৬ সালের ভেতর মানভূম বাংলা ভাষার আন্দোলনের ইতিহাস জানলে বোঝা যায় পৃথিবীর দীর্ঘতম ভাষা আন্দোলন। সেই ১৯৫৬ সালে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যে মানভূম ভেঙে পুরুলিয়া জেলা হয়। সেই ইতিহাসকে বাঁচিয়ে রাখতেই শিক্ষার সচেতনতা বাড়িয়ে তোলা প্রয়োজন এবং সেখান থেকেই আসল যে কোনো জনজাতির উন্নতি হওয়া সম্ভব। এই উপলব্ধি কিছুটা হলেও অনুভব করলেন অযোধ্যা পাহাড়ের কিছু সংখ্যক মায়ের। কে বলতে পারে আগামী দিনের ভাবী শিক্ষিত প্রজন্ম এখান থেকে বেরিয়ে কলুষমুক্ত শিক্ষিত সমাজ গড়ে তুলবে, হয়তো তা সময়ই উত্তর দেবে।
Comments :0