ধর্মের নামে ভাগের কথা বলে গেলেন। ‘কাজে’র কথা কিছু বললেন না অমিত শাহ্। তৃণমূলের দুর্নীতির প্রসঙ্গে কিছু বললেন, কিন্তু ‘জেলে ভরা’র কথা তুললেন না। আর মমতা ব্যানার্জির ‘ভাইপো’-কে যত্ন করে এড়িয়ে বিজেপি’র নেতাদের বিশেষ বার্তা দিয়ে গেলেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী।
বুধবার ধর্মতলায় সভা করেছে বিজেপি। ভাষণ দিয়েছেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী অমিত শাহ্। আগামী বছর লোকসভা নির্বাচন হওয়ার কথা। ২৩ মিনিটের সংক্ষিপ্ত ভাষণে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন(সিএএ) এনেছেন। বলেছেন,‘‘সিএএ দেশের আইন। আমরা লাগু করবই।’’ ২০১৯-র ডিসেম্বরে নাগরিকত্ব সংক্রান্ত ষষ্ঠ এই সংশোধনী অনুসারে শুধুমাত্র পাকিস্তান, আফগানিস্তান এবং বাংলাদেশের মুসলমান ছাড়া অন্য ধর্মাবলম্বী মানুষ ভারতের নাগরিকত্ব পেতে পারেন। ২০২৪-র লোকসভা নির্বাচনের আগে ফের সেই প্রসঙ্গ এনে ধর্মীয় বিভাজনের উত্তেজনা জাগিয়ে তুলতে চাইলেন অমিত শাহ্। বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠতে থাকা মতুয়াদেরও আশ্বস্ত করতে চাইলেন।
আর কী বললেন?
অমিত শাহ্ নিয়ে এলেন ঘুষপেটিয়া (অনুপ্রবেশকারী)-দের প্রসঙ্গ। ২০০৫-র জুনে লোকসভায় লালকৃষ্ণ আদবানির বক্তব্যের সুর ধরে পশ্চিমবঙ্গে অনুপ্রবেশ নিয়ে চিৎকার চেঁচামেচি করেছিলেন মমতা ব্যানার্জি। তখন আসনে ছিলেন লোকসভার উপাধ্যক্ষ। তাঁকে লক্ষ্য করে তাড়া তাড়া কাগজ ছুঁড়েছিলেন। সেই ঘটনার উল্লেখ করে অমিত শাহ্ এদিন বলেন,‘‘মমতা দিদি ভুলে গেলেন সেদিনের কথা? আজ পশ্চিমবঙ্গে ঘুষপেটিয়াদের আধার কার্ড, ভোটার কার্ড করার জন্য সোশাল মিডিয়ায় নম্বর দিয়ে দেওয়া হয়।’’ সম্প্রতি তৃণমূলের এক নেত্রীকে এমন বলতে শোনা গেছে। এই প্রসঙ্গেই আসামের প্রসঙ্গ তুলে অমিত শাহ্ বলেছেন,‘‘আসামে এখন বিজেপি সরকার। সীমান্ত পেরিয়ে একটি পাখিও এপারে আসতে পারে না। আর বাংলায় লাগাতার ঘুষপেটি চলছে।’’
‘পশ্চিমবঙ্গে অনুপ্রবেশ’ রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের দীর্ঘদিনের অ্যাজেন্ডা। মমতা ব্যানার্জি বিরোধী থাকাকালীন আরএসএস’র এই ইস্যুটির মুখপাত্র ছিলেন। অমিত শাহ্ এদিন মনে করিয়ে দিয়েছেন,‘‘ওপার থেকে যাঁরা এসেছেন তাঁরা এই ভারতের মাটিরই মানুষ। তাঁদের আমাদেরই মত পূর্ণ অধিকার আছে এই দেশের নাগরিকত্ব পাওয়ার।’’ এই ক্ষেত্রে মূলত হিন্দুদের নাগরিকত্বর কথা বলেছেন তিনি। তবে মমতা ব্যানার্জির মতই অমিত শাহ্ও ‘অনুপ্রবেশকারী’ বলতে মূলত মুসলমানদের বোঝান। এই দিন সেই উদ্দেশ্যেই বলেছেন। এই ক্ষেত্রেও লোকসভা নির্বাচনের আগে ‘মুসলমান-বিদ্বেষ’ জাগিয়ে তুলতে চেয়েছেন অমিত শাহ্।
তবে রামমন্দিরের প্রসঙ্গে মমতা ব্যানার্জিকে আড়াল করার চেষ্টা করেছেন শাহ্। এদিন বলেছেন,‘‘কংগ্রেস, তৃণমূল রামমন্দির বাধা দেওয়ার চেষ্টা করেছিল। মোদীজী রাম মন্দিরের শিলান্যাস করেছিলেন। আগামী বছরের প্রথমে মোদীজী রাম মন্দিরের উদ্বোধনও করবেন।’’ প্রসঙ্গত, মমতা ব্যানার্জি রাম মন্দিরের পক্ষে ছিলেন। অটল বিহারী বাজপেয়ীর নেতৃত্বে ১৯৯৮-র এনডিএ’র নির্বাচনী ইশ্তেহারে রাম মন্দির নির্মাণের কর্মসূচি ছিল। সেই ইশ্তেহারে মমতা ব্যানার্জির সই ছিল। এখনও মসজিদ ভেঙে মন্দির নির্মাণের বিরোধিতা তিনি করেন না। বরং তিনিও মন্দির বানাচ্ছেন সরকারি টাকায়, তা বিভিন্ন সভায় বলে উগ্র হিন্দুত্ববাদীদের খুশি করতে চান।
তৃণমূলের বিরুদ্ধে ওঠা গোরু, কয়লা পাচার, নিয়োগ দুর্নীতির উল্লেখ করে অমিত শাহ্ মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জিকে উদ্দেশ্য করে বলেছেন,‘‘যিনি দুর্নীতির সহায়ক তিনি কী করে দুর্নীতির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবেন?’’ তার আগে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী মুখ্যমন্ত্রীকে উদ্দেশ্য করেই বলেছেন,‘‘মমতা দিদি আপনি জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক, অনুব্রত মণ্ডল, পার্থ চ্যাটার্জিকে কেন সাসপেন্ড করছেন না বলুন।’’
কিন্তু এই প্রসঙ্গেই ৮বছর ২ মাস আগে বৌবাজারে অমিত শাহ্ বলেছিলেন,‘‘আমরা দোষীদের সবাইকে জেলে ভরব।’’
রাজ্যে দুর্নীতিগ্রস্ত সবাইকে ‘জেলে ভরার’ কথা ছিল। নরেন্দ্র মোদীও সেই প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন রাজ্যবাসীকে। কিন্তু সারদা কেলেঙ্কারি, নারদ স্টিং অপারেশন থেকে হালের কয়লা, গোরু পাচার, নিয়োগ দুর্নীতি— কোনও তদন্তই শেষ করেনি কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থাগুলি। অভিযুক্ত অনেক তৃণমূল নেতাই এখন বিজেপি’র হর্তা কর্তা। বুধবার তাই ২০১৪-র ৭ সেপ্টেম্বরের মত ‘সবাইকে জেলে ভরব’-র প্রতিশ্রুতি কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রীর থেকে পাওয়া যায়নি।
তেমনই আসেনি অভিষেক ব্যানার্জির কথা। রাজ্যে বিজেপি’র নেতারা, বিশেষত শুভেন্দু অধিকারি বারবার ‘ভাইপো’-র চুরির কথা বলেন। তিনিও এদিনের সভায় ‘মমতা চোর’ বলেছেন। ‘তৃণমূলের সব চোর’ স্লোগান দিয়েছেন। কিন্তু ‘ভাইপো চোর’? না, একবারও বলেননি। আর অমিত শাহ্র ভাষণে ‘ভাইপো’ এসেছে মাত্র একবার, কয়েক সেকেন্ডের জন্য। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী বলেছেন,‘‘মমতা দিদি এখন দূর্গানাম জপ করেন, জেরায় কেউ যেন ভাইপোর নাম না বলে!’’
তাহলে? ‘ভাইপো’ চোর — এটি বলছেন না অমিত শাহ্। যে ক’জন তৃণমূল মন্ত্রী, নেতা গ্রেপ্তার হয়েছেন এখনও, তাদেরও কেউই অভিষেক-ঘনিষ্ট নন। ‘ভাইপো’র নাম’ এখন নেওয়া যাবে না, অমিত শাহ্ কী তাই কায়দা করে বুঝিয়ে গেলেন বিজেপি’র নেতা, কর্মীদের? এই প্রশ্ন এদিনই করতে শোনা গেছে শোনা গেছে সভার পরে, পূর্ব মেদিনীপুরের দীর্ঘদিনের শুভেন্দু অধিকারী-অনুগামী দুই নেতাকে। এই প্রশ্ন আরও অনেকের।
অমিত শাহ্’র এদিনের মোদ্দা আহ্বান কী? প্রথমত, ২০২৪-এ ‘বাংলা থেকে বিজেপি-কে এত আসনে জেতান যাতে মোদীজী প্রধানমন্ত্রী হতে পারে।’ দ্বিতীয়ত,‘২০২৪-এ জিতলেই ২০২৬-এ (বিধানসভা নির্বাচনে) দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্টতা নিয়ে বিজেপি সরকার গড়বে।’ তৃতীয়ত, ‘সোনার বাংলা’ গড়বে বিজেপি। এটি অবশ্য পুরানো স্লোগান। ২০২১-র বিধানসভা নির্বাচনের আগেই এই স্লোগান মোদী-অমিত শাহ্র মুখ থেকে শোনা গেছে। কিন্তু কেন বিজেপি’র সরকার চাই? অমিত শাহ্ বলেছেন,‘‘দুর্নীতি বন্ধ করতে, ঘুষপেটিয়া থামাতে, রাজনৈতিক হানাহানি ঠেকাতে বিজেপি’র সরকার চাই। কমিউনিস্টরা পারবে না। তৃণমূল থাকলে তা হবে না।’’
কিন্তু ২০২০-র ৯ জুন ভার্চুয়াল সভায় ঠিক এই প্রসঙ্গেই অমিত শাহ্ কী বলেছিলেন? সেদিন তাঁর দাবি ছিল,‘‘বিজেপি জিতলে দুর্নীতি থাকবে না। তোলা আদায় থাকবে না। ঘুষপেটিয়া (অনুপ্রবেশ) থাকবে না। বোমাবাজি থাকবে না। বেরোজগারি (বেকারি) থাকবে না।’’
বুধবার ‘বেরোজগারি’ উচ্চারণ করেননি অমিত ভাই শাহ্। রাজ্যের সিএএ নয়, ‘কাজ’ চাই। বিজেপি, অমিত শাহ্র অ্যাজেন্ডায় তা নেই। কাজের দাবিতে আন্দোলন করছেন বামপন্থীরা— লাগাতার। এদিন অমিত শাহ্কে নিয়ে কপ্টার যখন বাংলার মাটি ছাড়ছে, তখন বন্ধ কারখানাগুলির ধাক্কায় ধুঁকতে থাকা জেলার আসানসোলের দিকে এগিয়ে চলেছে যৌবনের ইনসাফ যাত্রা— যে যাত্রায় কাজের দাবিই প্রধান দাবি।
AMIT SHAH KOLKATA
‘ভাইপো’কে ছুঁলেনই না অমিত শাহ্, ভাগের কথা রইল, ‘কাজে’র কথা নেই
×
Comments :0